ক্যাসিনোকাণ্ডে গেণ্ডারিয়ার ধনকুবের এনু-রুপন গ্রেপ্তার

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৩, ২০২০; সময়: ২:১৩ অপরাহ্ণ |
ক্যাসিনোকাণ্ডে গেণ্ডারিয়ার ধনকুবের এনু-রুপন গ্রেপ্তার

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : ক্যাসিনোর টাকায় সম্পদের পাহাড় গড়া রাজধানীর গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক এনু, তার ভাই একই কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক রুপন ভূঁইয়াকে অবশেষে গ্রেফতার করা হয়েছে।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) তাদের গ্রেফতার করে। সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফারুক হোসেন শীর্ষ দুই আসামিকে গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করলেও এই দুজনের নাম পরিচয় জানাতে রাজি হননি। তিনি বলেন, দুপুরে সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত জানানো হবে।

আইনশৃংখলা বাহিনীর একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছেন গ্রেফতার শীর্ষ সন্ত্রাসীরাই গেণ্ডারিয়ার ত্রাস এনু ও রুপন।

ক্যাসিনো ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের শুরুর দিকে গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর এনু-রুপন ও তাদের দুই সহযোগীর বাসা থেকে ৫ কোটির বেশি টাকা, ৮ কেজি স্বর্ণ ও ৬টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়। এ ঘটনায় গেণ্ডারিয়া, সূত্রাপুর ও ওয়ারী থানায় ৭টি মামলা হলেও এখনও এনু-রুপন এবং তাদের দুই সহযোগী হারুন অর রশিদ ও আবুল কালাম গা ঢাকা দেন। মামলাগুলোর মধ্যে মানি লন্ডারিং আইনের ৪টি মামলার তদন্ত করছে সিআইডি।

শুধু কাঁড়ি কাঁড়ি নগদ টাকা নয়, পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকাতে এনু-রুপনের বাড়ি আর প্লটের সংখ্যা মেলাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে সিআইডি। কারণ প্রাথমিক অনুসন্ধানেই যা পাওয়া গেছে তাতে হতবাক না হয়ে উপায় নেই। এখন পর্যন্ত এনু-রুপনের মালিকানাধীন ১৯টি বহুতল বাড়ি ও একাধিক প্লটের সন্ধান মিলেছে।

সিআইডি কর্মকর্তারা বলছেন, ক্যাসিনোর অন্ধকার জগৎ তাদের কাছে ধরা দেয় অনেকটা আলাদিনের চেরাগ হয়ে। দুই যুবলীগ নেতার দৃশ্যমান কোনো আয়ের উৎস নেই। কয়েকটি সাইনবোর্ডসর্বস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে তারা অর্থ লুকানোর চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হন।

এনু এবং রুপন ভুঁইয়ার ব্যাংক হিসাব সংক্রান্ত দলিলপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, পুরনো ঢাকার কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের শাখায় এনু ও রুপনের নামে একের পর এক হিসাব খোলা হয়। সবচেয়ে বেশি হিসাব খোলা হয় ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক ও স্ট্যান্ডান্ড চার্টার্ড ব্যাংকে।

বড় অঙ্কের অর্থ জমা রাখার কারণে ব্যাংকগুলো এনু-রুপনকে বিশেষ ব্যাংকিং সুবিধা দিতে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় মাতে। বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে এনু-রুপন ভিআইপি গ্রাহক হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

ব্যাংক হিসাব বিবরণী অনুযায়ী অজ্ঞাত উৎস থেকে এনু-রুপনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোতে নিয়মিত বড় বড় অঙ্কের অর্থ জমা হয়। এভাবে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের নয়াবাজার শাখায় সালমান এন্টারপ্রাইজ নামে একটি অ্যাকাউন্টে (নম্বর ০১৩৬১১০০০১৬৯৮৬) জমা হয় ১৭ কোটি ৭৭ লাখ।

সিপলু কম্পিউটার নামে নয়াবাজার শাখার আরেকটি অ্যাকাউন্টে (নম্বর ০১৩৬১১০০০০০১৩১১০) জমা হয় ২৬ কোটি এবং এনু-রুপন স্টিল কর্পোরেশন নামে ঢাকা ব্যাংকের বংশাল শাখায় (হিসাব নম্বর ০২১০১০০০০০০১২৯৬৩) জমা হয় ৩ কোটি ৮৬ লাখ ৮০ হাজার।

এভাবে নিয়মিত কোটি কোটি টাকা জমা হয় এনু-রুপন স্টিল হাউসের নামে প্রাইম ব্যাংকের বংশাল শাখায় (হিসাব নম্বর ১২২৩১০৯০০০৭১৮৫), এনামুল হক এনু নামে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় (হিসাব নম্বর ০১২৭৯৩৭৩৩০১), ব্র্যাক ব্যাংকের নবাবপুর শাখায় (হিসাব নম্বর (ক্লাসিক) ১৫০২১০০৫৬০৯২৮০০১), এনু-রুপন স্টিল কর্পোরেশন প্রিমিয়ার ব্যাংকের বংশাল শাখায় (হিসাব নম্বর ০১১৯১১১১০০০০৮৬০৭) এনামুল হক এনু নামে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড গুলশান শাখায় (হিসাব নম্বর ০১৯১৬৮২৮১০) ও (হিসাব নম্বর ০২৯১৬৮২৮১০১)।

এনামুল হক এনু ও রুপন ভূঁইয়ার যৌথ নামে স্ট্যান্ডাড চার্টার্ড ব্যাংকের কাকরাইল ক্যাশ অফিসে ভিআইপি সার্ভিস নামে একটি বিশেষ হিসাব খোলা হয় (নম্বর ১৮৩৬৭৯২৮৪০১)। এই অ্যাকাউন্ট থেকে বিদেশে বিপুল অঙ্কের অর্থ পাচার করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এছাড়া রুপন ভুঁইয়ার নামে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড মতিঝিল শাখায়ও একটি বিশেষ অ্যাকাউন্ট আছে। যার নাম দেয়া হয়েছে ভিআইপি কারেন্ট অ্যাকাউন্ট (নম্বর ০১২৭৯৩৭৯২০১)। পুরনো ঢাকার বাইরে ইস্টার্ন ব্যাংকের শান্তিনগর শাখায় দুটি অ্যাকাউন্ট খোলা হয় এনু-রুপন স্টিল হাউসের নামে। যার নম্বর যথাক্রমে ১১৪৫৬২০০৪৬৯৫৪ এবং ১১৪১২৯০০০১০৮৮।

বিভিন্ন ব্যাংকে বড় অঙ্কের নগদ অর্থ জমার পাশাপাশি এনু ও রুপনের নামে স্থায়ী আমানত হিসাবে বিপুল অঙ্কের স্থায়ী আমানত বা এফডিআর করা হয়। সবচেয়ে বেশি এফডিআর আছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে। এ ব্যাংকের নয়াবাজার শাখাতে এনামুল হক এনুর নামে আছে ১১টি এফডিআর।

এতে আছে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এছাড়া ঢাকা ব্যাংকের ৬টি স্থায়ী আমানত হিসাবে জমা আছে ১ কোটি ৪ লাখ ১১০ টাকা। মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ধোলাইখাল শাখায় দুটি এফডিআর অ্যাকাউন্টে ৬৭ লাখ এবং প্রাইম ব্যাংকের বংশাল শাখার দুটি এফডিআর অ্যাকাউন্টে আছে ৬২ লাখ টাকা।

এনুর ছোট ভাই রুপন ভুঁইয়ার নামেও একাধিক ব্যাংকে স্থায়ী আমানত হিসাবে অঢেল টাকা জমা আছে। শুধু ঢাকা ব্যাংকেই রুপনের নামে ৮টি এফডিআর পাওয়া গেছে। ঢাকা ব্যাংকে তার নামে জমা আছে ১ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এছাড়া ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের নয়াবাজার শাখায় রুপন ভুঁইয়ার নামে ১০টি এফডিআর আছে।

এতে জমাকৃত অর্থের পরিমাণ ২ কোটি ৪৫ লাখ। রুপন ভুঁইয়ার আত্মীয় জ্যোতি ভুঁইয়ার নামেও একাধিক এফডিআর অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। এর মধ্যে ঢাকা ব্যাংকেই খোলা হয় ৪টি এফডিআর। এখানে জমা আছে ৬১ লাখ টাকা।

মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ধোলাইখাল শাখায় রুপন ভুঁইয়ার দুটি এফডিআর সংক্রান্ত দলিল হাতে পায় সিআইডি। এগুলোর নম্বর হল যথাক্রমে ১১৫৯৬৪৭১৬৭২১৫০৭ এবং ১১৫৯৪১১০০৯৮৬৮৪৪। এ দুটি অ্যাকাউন্টে জমা আছে ৬৫ লাখ ৮৮ হাজার ৮৯২ টাকা। প্রাইম ব্যাংকেও রুপন ভুঁইয়ার তিনটি এফডিআর আছে। এগুলোতে জমা টাকার পরিমাণ ৮৮ লাখ টাকা।

ব্যাংকে গচ্ছিত বিপুল অঙ্কের নগদ টাকা ছাড়াও এখন পর্যন্ত এনু এবং রুপনের নামে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ২০টি বহু মূল্যবান বাড়ির সন্ধান মিলেছে।

এগুলো হল ৪০ গুরুদাস সরদার লেনে ২০ তলা নির্মাণাধীন বাড়ি, ১ নম্বর নারিন্দা লেনে ৪ তলা বাড়ি, ৬/২ গুরুদাস সরদার লেনে একটি নির্মাণাধীন বাড়ি, ৩৯ নম্বর শরৎগুপ্ত রোড (দাদা ভাই বাড়ি) ১৬ কাঠা জায়গা, ৬৯ শাহ সাহেব লেনে ১০ তলা বাড়ি, ৭৩ নম্বর শাহ সাহেব লেনে আরেকটি বাড়ি, ১২৪/৫ ডিস্টিলারি রোড মুরগিটোলায় ৭ তলা বাড়ি, ৩৯ ডিস্টিলারি রোডে আরেকটি পুরনো বিল্ডিং, ওয়ারী এলাকার লালমোহন শাহ স্ট্রিটে ৪টি বাড়ি আছে।

এগুলো হল ১০৫ নম্বর হোল্ডিংয়ে ১০৬ নম্বর হোল্ডিংয়ে ১০ তলা ভাড়ি (মমতাজ ভিলা), ১২২/এ ১২১ এবং ১০৩ নম্বর হোল্ডিংয়ে আরও দুটি বাড়ি, ৪৪/বি ভজহরি সাহা স্ট্রিটে ৪ তলা বাড়ি, ৭১/১ দক্ষিণ মৈসুন্দি এলাকায় আরেকটি বাড়ি, ধোলাইখাল হানিফ গার্মেন্টের সঙ্গে বাঁধন এন্টারপ্রাইজ নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মুরগিটোলা মোড়ে এনু-রুপন স্টিল হাউস, কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়া এবং মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে দুটি বিশাল বাংলোবাড়ি।

এদিকে ধনকুবের এনামুল হক এনু ও রুপন ভূঁইয়ার ৩৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের খোঁজ পাওয়ার পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দুটি মামলা করেছে। ২৩ অক্টোবর সংস্থাটির ঢাকা-১ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলা দুটি করেন দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশিদ চৌধুরী ও মোহাম্মদ নেয়ামুল আহসান গাজী।

এ দুই ভাইয়ের বাসায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার জব্দ করার ১ মাস পর ওই মামলা করে দুদক। এর আগে র‌্যাব তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং, বিশেষ ক্ষমতা আইন ও অস্ত্র আইনে তিন থানায় ৭টি মামলা করে।

মামলা দায়েরের পর দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য বলেন, অনুসন্ধানে দুই ভাইয়ের ৩৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের খোঁজ পাওয়ায় মঙ্গলবার কমিশনের সভায় মামলার অনুমোদন দেয়া হয়। দুদক সূত্র জানায়, শেষ পর্যন্ত গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি এনু এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রুপনের অবৈধ আয়ের পরিমাণ শতকোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে