রাজশাহীতে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা সত্বেও প্রশাসনের উদাসীনতায় চলছে পুকুর খনন

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৪, ২০২০; সময়: ৫:২০ অপরাহ্ণ |
রাজশাহীতে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা সত্বেও প্রশাসনের উদাসীনতায় চলছে পুকুর খনন

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজশাহীর পুরো জেলা জুড়েই নির্বিচারে কৃষিজমিতে চলছে পুকুর খনন। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও থেমে নেই পুকুর খনন। নানাভাবে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গসহ স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন ও থানা পুলিশকে ম্যানেজ করে চলছে এসব অবৈধ কাজ কারবার। এ কারণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার বিঘা ফসলি জমি। আবার প্রশাসন থেকে অভিযান চালালেও কাজে আসছে না। ধোরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে পুকুরখনন সিন্ডিকেট সদস্যরা। এ নিয়ে সাধারণ জনগণের মাঝে দেখা দিয়েছে অসন্তোষ। আর জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে প্রশাসনের খবরদারি নিয়েও।

জানা গেছে, পুলিশ প্রশাসনের নাকের ডোগা দিয়ে পুকুরখনন কাজে ব্যবহৃত মাটি বোঝাই অবৈধ ট্রাক্টর গ্রামীণ পাকা রাস্তার বারোটা বাজাচ্ছে। আবার উপজেলা প্রশাসন থেকে দিনে অভিযান চালিয়ে যে পুকুর খনন বন্ধ করা হচ্ছে, রাতেই আবার সেই পুকুর খনন করা হচ্ছে। প্রশাসনের অভিযানের আগেই পুকুরখননকারিরা টের পেয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সচেতনমহল অভিযুক্তের তীর ছুড়ছে উপজেলা প্রশাসনের ও থানা পুলিশের ওপরে। তারা বলছেন কোন কোন সদস্য পুকুরখনন সিন্ডিকেটের সাথে আঁতাত করে চলেছে বলেই অভিযানে সাফল্য আসছে না। আবার কোনো কোনো উপজেলায় ভুক্তভোগীরা প্রশাসনের সহযোগিতাই পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে কয়েক বছরে পুকুরসহ অন্যান্য কারণে শুধুমাত্র এই জেলায় কৃষিজমি কমেছে প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর (এক লাখ সাড়ে ১২ হাজার বিঘা)।

রাজশাহীতে উপর্যুপরি পুকুর খননের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসী আদালতের শরণাপন্ন হন। আদালত রাজশাহীর বাগমারা, পবা, গোদাগাড়ী, দুর্গাপুর ও পুঠিয়া উপজেলায় পুকুর খননের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তবে বর্তমানে তানোর উপজেলায় প্লেগ রোগের মত ধেয়ে চলছে পুকুরখননযজ্ঞ। সেখানে নাকি উপজেলা ও থানা প্রশাসনকে ঘুষ দিলেই গোপনভাবে পুকুরখননের অনুমতি মিলছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুকুরখনন সদস্যের এক সদস্য এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন দিনে রাতে সগৌরবে চলছে পুকুরখনন। এ তথ্যের সত্যতা মিলেছে।

গত বৃহস্পতিবার রাতে সরোজমিন দেখা গেছে পবার বাগধানির পর থেকে তানোরের রাস্তার দুধারে লাইটের ছড়াছড়ি। ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলে তিনিও এ তথ্য জানান। এরপরও দু-একটি উপজেলায় প্রশাসন পুকুর খননের বিরুদ্ধে অভিযান চালালেও লাভ হচ্ছে না। পবা উপজেলায় প্রশাসন নিয়মিতই অভিযান চালাচ্ছে। তারপরও উপজেলার বড়গাছি, দারুশা, দর্শনপাড়া এলাকায় দিনের আলোতেই চলছে পুকুর খনন।

বিশেষ করে পবা উপজেলার দারুশা হাওয়ার মোড়ে ১০০বিঘা তিন ফসলি কৃষি জমিতে অবাধে চলছে পুকুরখনন। এই পুকুরেই তিনটি এস্কেভেটর (মাটি খননকারি মেশিন) প্রায় ৫০টি ট্রাক্টর দিয়ে ওই এলাকার বিভিন্ন স্থানে মাটি বহন হচ্ছে। এতে ওই এলাকার গ্রামীণ রাস্তার বারোটা বেজেছে। শনিবার সরোজমিন গিয়ে এর শতভাগ সত্যতা মিলেছে। সেখানে পুকুরখননের ছবি তুলতেই সাত-আটজন ঘিরে ধরে প্রশ্ন শুরু করেন। প্রথমেই বলেন, আপনি কার নির্দেশে ছবি তুলছেন। আপনি জানেন এখানে কত মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে? আর একটি ছবি তুললে যন্ত্র ভেঙ্গে ফেলা হবে। আর এই প্রশ্নগুলো করছিলেন পুকুরখননকারি নিজেই। তার নাম মিনারুল ইসলাম। তিনি ঔদ্বত্ত্য আচরণসহ বলেন, ‘এই পুকুরে চারবার অভিযান হয়েছে। তাতে আমার খরচ বাড়ছে। কিন্তু খননকাজ বন্ধ নেই। এই পুকুরখননে অনেকেই আমার কাছে থেকে সুবিধা নিয়েছে এবং নিচ্ছে। আপনি বোঝেন না, অভিযান চলার পরেও কিভাবে পুকুরখনন চলছে’।

খোঁজ নিয়ে জানা যায় মিনারুল ইসলাম পুকুরখনন বিষয়ে এলাকায় চ্যালেন্স ছুড়েছে। তার পুকুরখনন বন্ধ করার ক্ষমতা উপজেলা ও স্থানীয় থানা পুলিশ করবেন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক শিক্ষক বলেন, মিনারুলের পুকুরখননই ব্যবসা। এই এলাকায় এসিল্যান্ড অফিস ও থানার সাথে সেই যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। হাওয়ার মোড়ের পুকুরের জন্য জলাবদ্ধাতা দেখা দিবে। এছাড়াও পুকুরখননের জন্যই কৃষি শ্রমিকদের বেকারত্ব বাড়ছে। অনেকে কাজ না পেয়ে প্রতিদিন শহরে ডালি-কোদাল নিয়ে কামলা খাটছে। একদিন পুকুরখননের কারণেই খুন-খারাবির আশংকা করছেন তিনি। দর্শনপাড়া ইউনিয়নের কোপাকান্দি মোড়েও চলছে অবাধে পুকুরখনন। পুকুরখনন সিন্ডিকেটের সদস্য কোপাকান্দির বাবু। জানা যায় বাবু বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাজশাহী প্রধান অফিসে কর্মরত আছেন। তার পুকুরখননে কয়েকদিন আগে পবা সহকারি কমিশনার ভূমি আবুল হায়াত অভিযান চালিয়ে বন্ধ করে দিয়েছেন। তবে এখন অবাধে চলছে খননকাজ।

অপরিকল্পিত পুকুরখননে শুধু যে ক্ষেতের ক্ষতি ও জলাবদ্ধতা হচ্ছে তাই নয়। পুকুরখননের কাজে ব্যবহৃত এক্সেভেটর ও মাটি পরিবহনে ট্রাক্টরে গ্রামীণ সংযোগ সড়কগুলো মরণ ফাঁদে পরিণত হচ্ছে। যে কারণে রাস্তাগুলো বছর খানেকের মধ্যেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের প্রতি জনগণের কমছে আস্থা, বাড়ছে বিদ্বেষ।

এলাকায় পুকুরখনন বিষয়ে কর্ণহার থানার অফিসার্স ইনচার্জ আনোয়ার আলী তুহিন বলেন, পুকুরখনন বন্ধের উদ্যোগ পুলিশ প্রশাসনের এখতিয়ার বহির্ভূত। রাস্তায় অবাধে অবৈধ ট্রাক্টর চলাচল বন্ধে তিনি পদক্ষেপ নিবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

পবা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবুল হায়াত বলেন, পুকুর খনন কেউ করছে- এমন অভিযোগ পাওয়া গেলে অবশ্যই অভিযান চালানো হচ্ছে। এ বছর পবা উপজেলায় ৩০-৩২টি অভিযান চালানো হয়েছে। ২৫টি ড্রেজার মেশিন ধ্বংস করা হয়েছে। কিন্তু দু-এক দিন পর তারা আবার খনন শুরু করে। এতে সামাজিক সচেতনতা জরুরী। আগামীতে অব্যাহতভাবে মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হবে।

এদিকে একই অবস্থা চলছে জেলার অন্য উপজেলাগুলোয়। তানোরের চান্দুড়িয়া এলাকার বিলের প্রায় সিংহভাগ জমি এখন পুকুর হয়ে গেছে। রাজশাহী কৃষি বিভাগ বলছে, কয়েক বছর ধরেই গোদাগাড়ী, পবা, তানোর, বাগমারা, দুর্গাপুর, পুঠিয়া, মোহনপুর, বাঘা ও চারঘাট এলাকায় ফসলি জমিতে পুকুর-দিঘি খননের হিড়িক চলছে। প্রতি বছরই ছোটবড় ১ হাজার পুকুর কাটা হচ্ছে।

গত আট বছরে নতুন ৫ হাজার পুকুর কাটা হয়েছে। এসব পুকুরের কারণে হাজার হাজার হেক্টর জমিতে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। তবে কৃষি বিভাগ পুকুরখননে বিরাগভাজন হলেও মৎস্য অফিস অনেকটা বিষয়টি এড়িয়ে চলছেন।

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে