সোয়া চার কোটি টাকা উদ্ধারে আদালতে যাবে রাজশাহীর শ্রমিকরা

প্রকাশিত: জানুয়ারি ২২, ২০২০; সময়: ১১:৪০ অপরাহ্ণ |
সোয়া চার কোটি টাকা উদ্ধারে আদালতে যাবে রাজশাহীর শ্রমিকরা

নিজস্ব প্রতিবেদক : বর্তমান পরিষদ ক্ষমতায় আগের আগে রাজশাহী জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে গত দুই বছরেই অন্তত সোয়া চার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। ইউনিয়নের নেতৃত্বে থাকা নেতারা শ্রমিকদের এই টাকা লোপাট করেছেন। এক শ্রমিক নেতার স্ত্রী এবং মেয়েও টাকা নিয়েছেন ইউনিয়ন থেকে। নির্বাচনের পর নতুন কমিটি দায়িত্ব নিলে অর্থ লোপাটের ভয়াবহ চিত্র ধরা পড়েছে। শ্রমিকরা এই টাকা উদ্ধার করতে এখন চেষ্টা শুরু করেছেন। প্রয়োজনে তারা আদালতে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের কমিটির মেয়াদ শেষ হলে ২০১৭ সালের ২৪ মে নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। সেদিন ভোট গণনা শেষ হলেই বহিরাগত একটি সন্ত্রাসী বাহিনী ভোটকেন্দ্রে হামলা চালায়। এ সময় গোলাগুলির ঘটনাও ঘটে। ব্যালট বাক্স ছিনতাই করা হয়। মাথা ফাটিয়ে দেয়া হয় নির্বাচন কমিশনারদেরও। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করা হয়। এরপর ২১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। এতে আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পান শ্রমিক নেতা কামাল হোসেন রবি।

তিন মাসের জন্য এই কমিটি গঠন হলেও দুই বছরেরও বেশি সময় তারা দায়িত্ব পালন করেন। এই সময়ই নানা অনিয়ম চলে ইউনিয়নে। অবশেষে গত বছরের ২২ জুন রাজশাহী এসে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খান ওই আহ্বায় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। তিনি নির্বাচন আয়োজনের জন্য রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনকে দায়িত্ব দিয়ে যান। গঠন করা হয় নতুন একটি আহ্বায়ক কমিটিও। এই কমিটি গত ৪ অক্টোবর নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। এই নির্বাচনে আহ্বায়ক কমিটিতে থাকা নেতাদের ভরাডুবি ঘটে।

নির্বাচনে সভাপতি নির্বাচিত হন জাহাঙ্গীর আলম। আর সাধারণ সম্পাদক হন মাহাতাব হোসেন চৌধুরী। নতুন কমিটি গত বৃহস্পতিবার রাজশাহীর শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল চত্বরে বিশেষ সাধারণ সভার আয়োজন করে। এতে ইউনিয়নের প্রায় ২ হাজার ৪০০ শ্রমিক অংশ নেন। সেখানেই সাধারণ সম্পাদক মাহাতাব হোসেন চৌধুরী গত দুই বছরে ইউনিয়নের টাকা তছরুপের চিত্র তুলে ধরেন। ঘোষণা দেন লোপাট হওয়া এই টাকা আদায়েরও।

বিশেষ সাধারণ সভায় শ্রমিকদের সামনে তুলে ধরা হিসাব মতে, ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত শ্রমিক হাসপাতালের নামে আদায় করা ৫২ লাখ ১১ হাজার ৭২০ টাকা শ্রমিক নেতা কামাল হোসেন রবির কাছে আছে। মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের নওদাপাড়া বাস টার্মিনালের ঢাকা কোচের কাউন্টার বিক্রির ৭৩ লাখ ১৪ হাজার টাকাও তার কাছে। রশিদের মাধ্যমেই তিনি এই টাকা গ্রহণ করেছেন।

এছাড়া ২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে গত বছরের ১৩ মে পর্যন্ত কামাল হোসেন রবি, তার স্ত্রী রেখা বেগম এবং মেয়ে প্রিয়াঙ্কা খাতুন ইউনিয়ন থেকে মোট ৪৮ লাখ ৯৫ হাজার টাকা গ্রহণ করেছেন। অথচ রেখা এবং প্রিয়াঙ্কা ইউনিয়নের কেউ নন। এছাড়া ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে ৪০ শতাংশ হিসাবে পাওয়া ৭০ লাখ টাকাও আত্মসাত হয়েছে। এসবের বাইরে মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের ভবন বিক্রির ৭০ লাখ টাকা চেকের মাধ্যমে গ্রহণ করেছেন রবি। ন্যাশনাল ট্রাভেলস, দেশ ট্রাভেলস, হানিফ এন্টার প্রাইজ ও শ্যামলী পরিবহনের কাছে কাউন্টার বিক্রি করা ১ কোটি ২১ লাখ টাকাও লোপাট হয়েছে।

ইউনিয়নের সাধারণ সভায় আহ্বায়ক কমিটির অস্বাভাবিক ব্যয়ের চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। আহ্বায়ক কমিটি ২০১৭ সালের ১ জুন থেকে ২০১৯ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত মোট আয় দেখিয়েছে ২ কোটি ৬৬ লাখ ৪৫ হাজার ৫৩০ টাকা। আর ব্যয় দেখিয়েছে ২ কোটি ৫৬ লাখ ৫১ হাজার ১১৯ টাকা। স্থিতি দেখিয়েছে ৯ লাখ ৯৪ হাজার ৪১১ টাকা। কিন্তু নির্বাচনের আয়োজক কমিটি দায়িত্ব নেয়ার সময় এই টাকাও ব্যাংকে পায়নি। ব্যাংকে ছিলো ১ লাখ ৩২ হাজার টাকা।

কামাল হোসেন রবির আহ্বায়ক কমিটি দুই বছরেই সাংগঠনিক ব্যয় দেখিয়েছে ২৮ লাখ ৬ হাজার ২৭৫ টাকা। আপ্যায়ন দেখিয়েছে ৩ লাখ ৩ হাজার ৪৯৯ টাকা। এছাড়া চিকিৎসা বাবদ ২০ লাখ ৭৩ হাজার ৩০৮ টাকা, সাহায্য ১৬ লাখ ৩৩ হাজার ৮২১ টাকা, মনোহারী ৫৯ হাজার ১৭১ টাকা, ছাপা খরচ ৩ লাখ ৪৯ হাজার ৯০৩ টাকা, লৌকিকতা ১ লাখ ৩০ হাজার ২৭৫ টাকা, নিরীক্ষা ফি ৮৬ হাজার ৭০০ টাকা, বোনাস ৫ লাখ ৮ হাজার ২০০ টাকা, মামলা খরচ ৯ লাখ ৫১ হাজার ৩৯৭ টাকা, কর্মকর্তা ভাতা ২৭ লাখ ২৭ হাজার ৫০০ টাকা, কর্মচারী বেতন ১২ লাখ ৭২ হাজার ৮৫০ টাকা এবং কমিশন ৮ লাখ ৯৫ হাজার ২৯৩ টাকা খরচ দেখিয়েছে। আর শুধু সভা বাবদই খরচ দেখানো হয়েছে ১৬ লাখ ৬৯ হাজার ৯৩ টাকা। অথচ আহ্বায়ক কমিটি বড় কোনো সভাই করেনি।

বিশেষ সাধারণ সভায় নতুন সাধারণ সম্পাদক এসব খরচের বিবরণ তুলে ধরে শ্রমিকদের কাছে জানতে চান সব ঠিক আছে কি না। তখন শ্রমিকরা সবাই চিৎকার শুরু করেন। তারা বলেন, সব খরচ অস্বাভাবিক। এমন অস্বাভাবিক খরচ দেখিয়ে ইউনিয়নের টাকা লোপাট করা হয়েছে বলে তারা অভিযোগ করেন। এ সময় শ্রমিকরা ঘোষণা দেন, আহ্বায়ক কমিটিতে থাকা নেতাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হবে। নিজেদের রক্ত পানি করা টাকা তারা আত্মসাত করতে দেবেন না বলেও ঘোষণা দেন।

জানতে চাইলে জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের নতুন কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাহাতাব হোসেন চৌধুরী বলেন, সব টাকা শ্রমিকের। সেগুলো শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় হবে। কিন্তু কেউ শ্রমিকদের টাকা দিয়ে নিজের কোটিপতি হবেন এটা মেনে নেওয়া হবে না। লুটপাট করা টাকা আদায়ে শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ। আইনগত প্রক্রিয়া হোক আর যেভাবেই হোক শ্রমিকদের টাকা আদায় করা হবে।

অভিযোগের বিষয়ে জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক আহ্বায়ক কামাল হোসেন রবি বলেন, বিশেষ সাধারণ সভাটিই নিয়মতান্ত্রিকভাবে হয়নি। আর সেখানে যেসব অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে সেগুলো মিথ্যা। এগুলো বর্তমান কমিটির বানানো। টাকা যদি লুটপাটই হয় এবং ব্যয় যদি অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়েই থাকে তবে তারা আইনের আশ্রয় নিতে পারে। সেখানেই সমাধান হবে।

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে