করোনা-কালের স্মার্টফোনগাথা

প্রকাশিত: এপ্রিল ৩০, ২০২০; সময়: ৩:৩৯ অপরাহ্ণ |
করোনা-কালের স্মার্টফোনগাথা

পদ্মাটাইমস ডেস্ক :

কোনো বিষয়ে আপনার মনোযোগের স্থায়িত্ব কতক্ষণ?

কী মনে হচ্ছে, যে লেখাটি এইমাত্র আপনি পড়তে শুরু করেছেন, তা কি পূর্ণ মনোযোগের সঙ্গে শেষ করতে পারবেন? নাকি এরই মধ্যে স্ক্রল করে দেখে নিয়েছেন লেখাটির দৈর্ঘ্য এবং তারপর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে এত বড় লেখা পড়ার কোনো মানে হয় না? নাকি— এখন সময় নেই, পরে পড়া যাবে— এই অজুহাতে এরই মধ্যে সরে পড়েছেন?

প্রিয় পাঠক, এখনো যদি আপনি লেখাটিতে থাকেন, তাহলে আপনাকে অভিবাদন। চলুন দেখি, এই করোনার স্থবির সময়ে ‘স্মার্টফোন’ ও এর ব্যবহার কীভাবে আপনার জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে।

করোনাভাইরাস ও স্মার্টফোন

জ্বর, শ্বাসকষ্ট আর বুকে ব্যথার উপসর্গ নিয়ে কোভিড-১৯ নামের যে ভাইরাসটি ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আত্মপ্রকাশ করেছিল চীনের উহান প্রদেশে, এখন তা সারা পৃথিবীর ২১০টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। আজকের দিন পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৩১ লাখ ৯৩ হাজার ৯৬১ জন। মারা গেছেন ২ লাখ ২৭ হাজার ৬৪৪ জন। নতুন সংক্রমণ রোধ করতে বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই চলছে লকডাউন।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে মার্চের ২৬ তারিখ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। এরই মধ্যে পঞ্চম দফায় ছুটি বাড়িয়ে ৫ মে পর্যন্ত করা হয়েছে। প্রায় সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ। ঘরের মধ্যে সবাইকে একরকম বন্দি জীবনযাপন করতে হচ্ছে। এর ফলে সময় কাটাতে স্মার্টফোনের সঙ্গে আপনার সখ্যতা বেড়েছে আগের চেয়ে আরও বেশি।

ফেসবুক, ইউটিউব, মেসেঞ্জার কিংবা হোয়াটসঅ্যাপে কাটছে আপনার অবসর। মিনিটে মিনিটে ব্রাউজ করছেন নিউজ সাইটগুলো। দেখছেন করোনাভাইরাসের সর্বশেষ আপডেট। সবমিলিয়ে আপনার সময়টা হয়ে উঠেছে স্মার্টফোনময়।

এটা অনস্বীকার্য যে, স্মার্টফোন ছাড়া আধুনিক জীবন অচল। ঘুম থেকে উঠে আবার ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আপনার জীবনকে ঘিরে রেখেছে এই উজ্জ্বল-চৌকো-যন্ত্রটি। ডিস্কাউটের গবেষণা বলছে, একজন সাধারণ মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী দিনে গড়ে ২ হাজার ৬১৭ বার তার ফোন স্পর্শ করেন। তাই আপনি নিজেও হয়তো জানেন না যে আপনার স্মার্টফোনটির সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কতটা নিবিড়। করোনাভাইরাস ও লকডাউনের এই সময়ে নিশ্চয় আপনার স্মার্টফোন ব্যবহার আগের তুলনায় বেড়ে গেছে। এখন প্রশ্ন হলো, স্মার্টফোনের পেছনে এই অতিরিক্ত সময় দেওয়াটা আপনার জীবনকে কীভাবে প্রভাবিত করছে? এটা আদৌ কোনো সুফল বয়ে আনছে কি?

স্মার্টফোন ব্যবহারের নেতিবাচক দিকগুলো

ধরুন, আপনি একটি বই পড়তে বসেছেন। পাশেই আপনার মোবাইলফোনটি পড়ে আছে। হঠাৎ নোটিফিকেশনের টুংটাং শব্দ হলো। এবার আপনি কতক্ষণ নির্বিঘ্নভাবে বইটি পড়তে পারবেন? গবেষণায় দেখা গেছে, চ্যালেঞ্জিং কোনো কাজের সময় স্মার্টফোনের শব্দ, ভাইব্রেশন, নোটিফিকেশন রিং ব্যক্তির মনোযোগকে ব্যহত করে এবং কাজের গতিকে কমিয়ে দেয়। সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, এমন অবস্থায় যদি কোনো ব্যক্তির ফোন বেজে ওঠে যখন তিনি তা ধরতে পারছে না, তাহলে তখন সেই ব্যক্তির রক্তচাপ বেড়ে যায়, হৃদস্পন্দন দ্রুততর হয় এবং তার সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা কমে যায়।

আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, একজন অফিসকর্মী স্মার্টফোনের দ্বারা একবার ব্যাহত হলে পুনরায় কাজে মনোনিবেশ করতে তার কমপক্ষে ২৫ মিনিট সময় লাগে। বলা বাহুল্য, এভাবে স্মার্টফোন আপনার মনোযোগকে ব্যহত করার মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষতিসাধন করছে।

ইদানিং অফিস বন্ধ থাকায় অনেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ন্টা ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম কিংবা ইউটিউবে কাটিয়ে দিচ্ছেন। এটা অজান্তেই আপনার পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ভার্চুয়াল জগতে অতিরিক্ত সময় কাটানোর ফলে মানুষের সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলার বা যোগাযোগের প্রবণতা হ্রাস পায়। বিশেষত তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এর প্রভাব আরও মারাত্মক।

স্কুল বা কলেজের শিক্ষার্থীরা বন্ধুদের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা করার চেয়ে এখন মাল্টিপ্লেয়ার অনলাইন গেমস কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চ্যাটিং করতে বেশি উৎসাহবোধ করে। এছাড়া ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক ইত্যাদি সামাজিক অ্যাপসের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে অন্যের জীবনকে বেশি আকর্ষণীয় ভাবার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে। সবসময় অন্যে-কি-করছে সে সম্পর্কে ভাবা ও নিজের সঙ্গে এর তুলনা করার মাধ্যমে ব্যক্তির মানসিক স্থিরতা ও শান্তি নষ্ট হচ্ছে।

শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি করে। ফলে তারা লেখাপড়ায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। অনেকে হীনমন্যতা ও মানসিক উদ্বিগ্নতায় ভোগে। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘ভাইরাল’ হওয়ার প্রবণতা এর অন্যতম বড় উদাহরণ।

যাদের বাড়িতে শিশু রয়েছে, তারা নিশ্চয় কোনো না কোনো সময় শিশুর কান্না থামাতে স্মার্টফোনে ভিডিও কিংবা গেমস অন করে তাদের হাতে দিয়ে দেন। এভাবে প্রাথমিক পর্যায়ে কান্না হয়তো থামে কিন্তু ধীরে ধীরে শিশুটি এতে ভীষণভাবে আসক্ত হয়ে পড়ে। দেখা যায় যে, এরপর থেকে স্মার্টফোন হাতে না দিলে শিশুটি জেদ করতে থাকে।

গবেষণায় দেখা গেছে, খুব বেশি স্মার্টফোন ব্যবহারের ফলে শিশুদের মানসিক ও আচরণগত সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়াও, স্মার্টফোনের রেডিয়েশন শিশুর মস্তিষ্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই এ ব্যাপারে আপনি যত দ্রুত সচেতন হবেন ততই মঙ্গল।

অতিরিক্ত স্মার্টফোন ব্যবহারের রয়েছে নানা রকমের শারীরিক সমস্যার দিক। যুক্তরাজ্যের চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, স্মার্টফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে মায়োপিয়া বা ক্ষীণদৃষ্টির সমস্যা দেখা দিতে পারে। স্মার্টফোনে ব্যবহৃত হেডফোন তৈরি করতে পারে শ্রবণশক্তির সমস্যা। হেডফোনে সর্বোচ্চ ১০৫ ডেসিবেল মাত্রার ভলিউম থাকে যা ৪ মিনিট এর বেশি একটানা শুনলে শ্রবণশক্তির মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।

আমেরিকান গবেষকরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, মোবাইল ফোনে টয়লেট সিটের তুলনায় ১০ গুণ বেশি ব্যাকটেরিয়া থাকে। তাই সবসময় স্মার্টফোন হাতে রাখাটা মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়।

কী করা যেতে পারে

করোনাভাইরাসের এই মহামারির সময় পরিবারের সঙ্গে মানসম্পন্ন সময় কাটানোর একটা দারুণ সুযোগ তৈরি হয়েছে আপনার। স্মার্টফোনের পেছনে সময় ব্যয় না করে পরিবারের অন্য সদস্যদের সময় দিন। তাদের সঙ্গে কথা বলুন, গল্প করুন। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা তাদের সঙ্গে শেয়ার করুন, তাদের গল্প শুনুন।

এছাড়া সুযোগ থাকলে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে লুডু, কেরাম, দাবা, ইত্যাদি ইনডোর গেমসও খেলতে পারেন। এতে করে নিজেদের মধ্যে দূরত্ব থাকলে তা কমে আসবে।

এ সময় আপনি ভালো-ভালো বই পড়তে পারেন। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, কিংবা আত্ম-উন্নয়নের যে কোনো বই আপনার অবসর সময়টাকে আনন্দময় করে তুলতে পারে। বাড়িতে বসে ভালো কয়েকটি সিনেমাও দেখে নিতে পারেন এসময়। যেগুলো অনেকদিন ধরে দেখবো-দেখবো করেও সময় করে উঠতে পারছিলেন না।

লেখালিখির অভ্যাস থাকলে কোনো নতুন বই লেখা শুরু করে দিতে পারেন। নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বা মজার ঘটনাগুলোও লিখে ফেলতে পারেন। এ ছাড়া অনলাইনে প্রয়োজনীয় কোনো কোর্স কিংবা নতুন কোনো ভাষা শেখা শুরু করতে পারেন। চাইলে করোনাপরবর্তী সময়ের জন্যে নতুন পরিকল্পনাও ঠিক করে ফেলতে পারেন এখন।

শেষ কথা

যে ‘উজ্জ্বল-চৌকো-যন্ত্র’টি আপনার সার্বক্ষণিক সহচর, তাকে নিয়ে নতুন করে ভাববার সময় এসেছে। পকেটে হাত ঢুকিয়ে অনেকটা অবচেতনে স্মার্টফোনটি হাতে নিয়ে, নির্দিষ্ট কিছু অ্যাপসে চলে যাওয়ার স্বভাবটিকে নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব আপনারই। তা না হলে এটিই আপনার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, এমনকী, সামাজিক জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করবে।

আপনি নিশ্চয়ই একটি যন্ত্রের দাস হিসেবে বেঁচে থাকতে চাইবেন না।

সূত্র : দ্য ডেইলি স্টার

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে