মা

প্রকাশিত: ১১-০৫-২০২০, সময়: ২০:১৫ |

রিকশায় দুই যাত্রী। একজন বৃদ্ধা। বয়স আশি বছরের আশেপাশে। পরনে নতুন সাদা শাড়ি। শাড়িটার ভেতরে শারীর নামে যে খোলসটা আছে তা প্রায় কঙ্কালসার। চোখ দুটো কোঠরের মধ্যে ঢুকে গেছে। খরায় পোড়া খালের মতো। তার উপরে মোটা কাঁচের চশমা। পাওয়ার যে বেশ ভালোই তা দেখেই বোঝা যায়। হাতের আঙুলগুলো মরা শেকড়ের মতো। কালো রগগুলোর উপরে সেঁটে বসে আছে চামড়া। দাঁতহীন মুখে ঠোঁট দুটোর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়ায় দায়। চুলগুলো পাটের মতো লালচে সাদা। পাশে আরেকজন ছেলে বসে আছে। বয়স চল্লিশের ঘরে।

সন্ধ্যা নেমেছে বেশ আগেই। রাস্তার দুপাশে জ্বলতে থাকা লাইটের আলোয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তাদের। আবার কখনো হারিয়ে যাচ্ছে গাছের ছায়ায়। আলোছায়া কাটিয়ে রিকশাটা ছুটে চলছে সামনে। দুই জনের কারো মুখেই কথা নেই। রাস্তাটাও বেশ নির্জন। কিসের যেন ধর্মঘট চলছে। তাই গাড়ির আনাগোনা নেই বললেই চলে। দুই চারটে রিকশা ছাড়া বিশেষ কোন যানবাহন নেই।
বৃদ্ধার কথায় নিরবতা ভাঙে। আধা ভাঙা গলায় পাশের ছেলেটাকে বলে, বাবা আমি তোর হাতটা ধরতে পারি?

ছেলেটার মুখে পরিষ্কার বিরক্ত। কোন সাড়া নেই। ছেলেটি আগের মতোই বসে থাকলো। বৃদ্ধা মরা শেকড়ের মতো দুই হাত দিয়ে ছেলেটির ডান হাত জড়িয়ে ধরলো। সাড়া নেই, তবে বাধাও দিলো না ছেলেটি।
বৃদ্ধটি কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, আর কোনদিন তোর হাতটা ধরতে পারবো কি না জানি না।
তুমি না মা। কি যে বলো! ছেলেটি হাত টানার চেষ্টা করলো। কিন্তু বৃদ্ধা শক্ত করে হাতটা ধরে আছে। ছেলের হাতের পিঠে চুমু খায়। নিজের প্রতি যত্ন নিস বাবা।

ছেলেটি ছোট্ট করে বলে, ঠিক আছে। ওসব নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না।
বৃদ্ধার আবার ছেলের হাতের পিঠে চুমু খায়। বাইরে খেয়ে খেয়ে অল্প বয়সেই তো শরীরে অসুখ বেধে ফেলেছিস।
ছেলেটি কোন কথা বলে না।
সময় মতো অষুধগুলো খেয়ে নিস বাবা।
ছেলেটির মুখে বিরক্ত। কি যে বলো না মা। ওসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি ভালো আছি।
ভাববো না বললেই কি ভাবনা আসবে না? বউ মা’র দিকে খেয়াল রাখবি।
আচ্ছা রাখবো।

নীলামণি আর মাহীমণির যত্ন নিবি।
ঠিক আছে নিবো।
আচ্ছা বাবা, ওরা আমার জন্য বেশ কাঁদবে না?
জানি না।
বেশি কান্নাকাটি করলে আমার কাছে নিয়ে আসবি। আমারও ভীষণ কষ্ট হবে ওদের ছেড়ে থাকতে। বৃদ্ধার কণ্ঠ যেন জড়িয়ে এলো।
ছেলেটি কোন কথা বলে না।

বৃদ্ধাটি ছেলের হাতটি আগের মতোই জড়িয়ে ধরে আছে। আলোছায়ার খেলায় বৃদ্ধা নিজেকে সামলে নেয়। বাবা আমি জানি, আমি তোদের কাছে বোঝা হয়ে গেছি। তুই আর বউ মা চাকুরি করিস। সময় পাস না। ছেলেমেয়েদের দেখবি না, আমাকে দেখবি। বউ মা’র বেশ ঝামেলা হয় আমাকে নিয়ে।
ছেলেটি এবার বলে উঠে, সেই জন্যই তো মা তোমাকে এখানে রাখতে যাচ্ছি। ওখানে তুমি ভালো থাকবে বেশ। তোমার যত্নও হবে। বেশ ভালো থাকবে তুমি।

ছেলের কথা শুনে বৃদ্ধার পুরানো হাঁপড়ের মতো বুকটার ভেতর থেকে দীর্ঘ গরম নিশ্বাস বেরিয়ে আসে। মুখ দিয়ে কোন কথা বের হয় না। সন্তান ছেড়ে জগতে কোন মা যে ভালো থাকে সেই উত্তর যেন বৃদ্ধা হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছে বুকের ভেতর। এভাবে কিছুক্ষণ যায়। উত্তর পায় না খুঁজে। কেমন যেনো হতাশা আর ভয় আরো বেশি চেপে বসে বৃদ্ধার বুকে।
সাদা আঁচল দিয়ে চশমার ফাঁক দিয়ে চোখের জল মুঝে ছেলের মুখের দিকে তাকায় বৃদ্ধা। এ মুহুর্তে বৃদ্ধার মনে হচ্ছে, এ যেনো শেষ দেখা। নিজের ছেলেকে হয় তো আর দেখতে পাবে না সে। আর্শিবাদপূর্ণ চোখে তাকিয়েই থাকে ছেলের দিকে। বাবা আমাকে দেখতে আসবি না? তোকে না দেখলে আমার খুব কষ্ট হবে রে বাবা।
ভেবে না মা। আমি মাঝে মাঝেই তোমাকে দেখতে আসবো।

ছেলেটির হাতের ইশারায় রিকশাচালক একটি বিশাল গেটের সামনে রিকশাটা থামায়। গেটের পাশে ছোট্ট একটা বোর্ডে লেখা আছে ‘বৃদ্ধাশ্রম’।
ছেলেটি নামে। তারপরে অন্যপাশে গিয়ে হাত ধরে বৃদ্ধাকে নামায়। সঙ্গে পুরানো আমলের টিনের ট্র্যাঙ্ক। হঠাৎ কি মনে করে বৃদ্ধা যেনো থামকে দাঁড়ায়। ছেলের দিকে তাকিয়ে, বাবা একটা জিনিস যে বাড়িতে ফেলে এসেছি।
কি মা?
তোর বাবার সঙ্গে আমার ছবিটা যে ফেলে এসেছি। তোর বাবার সঙ্গে ওই একটা ছবিই আছে আমার। ছবিটা আমাকে এনে দিস বাবা।
ঠিক আছে। তুমি চিন্তা করো না। আমি কয়েকদিনের মধ্যেই এনে দিবো।
ধর্মঘটের কারণে রিকশা সংকট। ছেলেটি রিকশাচালকের দিকে তাকিয়ে, তুই আধ ঘণ্টা মতো দাঁড়াও। আমি মাকে ভেতরে রেখে আসছি।

রিকশাচালক অনেকটা অবাক হয়ে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আছে।
ছেলেটি আবার বলে উঠে। চিন্তার কিছু নেই ভাড়া ধরিয়ে দিবো।
রিকশাচালক গামছা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বলে, জ্বী ভাইজান।
গেট পেরিয়ে বাড়িটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দুটো শরীর। বাড়িটার বাইরে অন্ধকার। ভেজানো জানলাগুলোর ফুটো দিয়ে আলো ছটা ঠিকরে পড়ছে আঁধারের বুকে। কোন কোলাহল নেই।

কালের স্রোতে বর্তমান যেখানে দাঁড়িয়ে। সেখান থেকে মাথা তুলে মানুষ শ্রেণির প্রাণিরা ভীষণ চিৎকার করে সভ্যতা নিয়ে। সভ্য হিসেবে দাবি করে যতোই নিজেকে উপরে তুলে ধরার চেষ্টা করুক। আসলে তারা সভ্যতা থেকে ততই দুরে সরে গেছে। আদিকাল থেকে এ পৈশাচিক আচরণ মানুষ করে আসছে। যুগে যুগে শুধু ধরনটা পাল্টেছে। আগে যে নির্যাতন হয়েছে শরীরে এখন শিক্ষা প্রসারের যুগে তা হয় মনে। শরীরের আঘাত মুছে যায়। কিন্তু মনের ক্ষত? সে কি আর মুছে দেয়া যায়? এটা পৈশাচিকতার আধুনিক রূপ। নৈতিকতা যেন মহাকর্ষ পেরিয়ে নক্ষত্রদেশে নিয়েছে ঠাঁই। এ আরো বড় ভয়ঙ্কর। আরো বেশি যন্ত্রণা।
বুকভরা আধুনিকতার ক্ষত নিয়ে এলোমেলো পায়ে ধনুকের মতো বাঁকা শরীরটা নিয়ে বাড়িটার দিকে এগিয়ে যায় বৃদ্ধা। সঙ্গে ছেলেটি। একসময় বাড়িটার দরজার কাছে নিয়ে দাঁড়ালো তারা। রিকশাওয়ালা তাকিয়ে আছে সেদিকে। এ মুহুর্তে কি যেন একটা ভাবনা খেলা করছিল রিকশাচালকের মনে।

ছেলেটি খানিকপরেই ফিরে আসে। দ্রুত পায়ে এসে রিকশায় চেপে বসে যাওয়ার জন্য ইশারা করে। আলোছায়ার পথ মাড়িয়ে বাড়ির দরজায় রিকশা থামে। পথে কোন কথা হয় না তাদের মধ্যে।
বাড়ির সামনে ছেলেটি নেমে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে। তারপর সিগারেট জ্বালিয়ে রিকশাচালকের দিকে তাকিয়ে বলে, ভাড়া কতো নিবে?
রিকশাচালক হাসে। ছেলেটি বেশ অবাক হয়। হাসছো কেন?
রিকশাচালক হাসি থামায়। আপনারে একটা কথা বলি ভাইজান।
ছেলেটি তাকায় চালকের দিকে। কি কথা?
চালকের মুখে কিসেব যেন কষ্ট ফুটে উঠেছে। এই যে রিকশাটা দ্যাখতেছেন। অনেক কষ্টে আমি রিকশাটারে কিনছি। আজ রাইতে আমি রিকশাটা বিক্রি করমু। দামদর ঠিক হইয়া আছে। দশ হাজার টাকা। যে গ্যারেজে আমি রিকশাটা রাহি, ওই গ্যারেজওয়ালা কিনবো।

ছেলেটি প্রশ্ন করে, রিকশা বিক্রি করবে কেনো?
গ্রামের বাড়িত থৈন সংবাদ আইছে। মায়ের অসুখ। ট্যাকা লাগবি। তাই বিক্রি করমু। আমার কাছে হক্কলের আগে মা। আর আপনি সেই মায়েরে বৃদ্ধাশ্রমে রাখি আইলেন!
ছেলেটি অবাক হয়ে কিছুক্ষণ রিকশাচালকের দিকে তাকায়। তারপরে মানিব্যাগ করে একশ টাকার একটা নোট বের করে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ভাড়া নাও।
রিকশাচালক মাথা নাড়ায়। না, আপনের মতো মাইনষের কাছে ভাড়া লমু না। মায়ে রে যে বৃদ্ধাশ্রমে রাইখ্যা আসে তার চাইয়া বড় ফকিন্নি কি কেউ আছে?
আর কোন কথা হয় না। রিকশাচালক রিকশা ঘুরিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। ধিরে ধিরে অস্পষ্ট হয়ে উঠে রিকশাটা। ছেলেটা হাতে টাকাটা নিয়ে রিকশাটার দিকে তাকিয়ে থাকলো।

ইলিয়াস আরাফাত
সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

উপরে