ইতেকাফ বিষয়ক মাসআলা

প্রকাশিত: মে ১২, ২০২০; সময়: ১২:৩১ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
ইতেকাফ বিষয়ক মাসআলা

হোছাইন আহমাদ আযমী : ইতেকাফ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। তাই তা শুদ্ধ হওয়ার জন্য আনুষঙ্গিক মাসআলা জানা খুব জরুরী। তাই আজকে এ বিষয়ে কিছু মাসআলা আলোচনা করব।

ইতেকাফে থাকা কালীন মসজিদে খাবার পৌঁছে দেওয়ার মতো কেউ না থাকলে খাবার আনার জন্য আপনি বাসায় যেতে পারবেন। এ কারণে ইতেকাফ ভাঙবে না। তবে খাবার আনার জন্য মসজিদ থেকে বের হয়ে অন্য কোনো কাজে বিলম্ব করা যাবে না। অন্য কাজে অল্প সময় ব্যয় করলেও ইতেকাফ ভেঙ্গে যাবে। অবশ্য ঘটনাক্রমে খাবার প্রস্তুত না হলে সেজন্য অপেক্ষা করতে পারবেন। (আলবাহরুর রায়েক ২/৩০৩; আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৮০; তাবয়ীনুল হাকায়েক ২/২২৪)

কোনো কোনো এলাকায় দেখা যায়, রমযানের শেষ দশ দিনে এলাকাবাসী কেউ ইতেকাফ না করলে অন্য এলাকা থেকে কোনো দরিদ্র ব্যক্তিকে খানা ও পারিশ্রমিক দিয়ে ইতেকাফ করানো হয়।

এখানে ইসলামী শরীয়তের সিদ্ধান্ত হলো রমযান মাসের শেষ দশ দিন ইতেকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়াহ। যদি কোনো মসজিদে এক জনও ইতেকাফে বসে, তাহলে এলাকাবাসী সুন্নত ছেড়ে দেয়ার গুনাহ থেকে বেঁচে যাবে। আর যদি একজনও ইতেকাফ না করে তাহলে ঐ এলাকার সকলেই গুনাহগার হবে।

তাছাড়া ইতেকাফ একটি ইবাদত, যা বিনিময়যোগ্য নয়। তাই এতেকাফের জন্য পারিশ্রমিক নেওয়া জায়েয নয়। কাউকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ইতেকাফ করালে সে ইতেকাফ সহীহ হবে না। অতএব এ জাতীয় ইতেকাফ দ্বারা এলাকাবাসী দায়িত্বমুক্ত হতে পারবে না।
(হেদায়া, ফাতহুল কাদীর ২/৩০৪; রদ্দুল মুহতার ২/৪৪২; খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/২৬৭; ইলাউস সুনান ১৬/১৭২-৭৩; রদ্দুল মুহতার ৬/৫৫)

ইতেকাফরত ব্যক্তি পেশাব-পায়খানার জন্য মসজিদের বাইরে গেলে আসা যাওয়ার পথে পথ চলতে চলতে সালাম আদান-প্রদান করতে পারবে। তদ্রুপ এ সময় পথ চলতে চলতে কারো সাথে অল্পস্বল্প কথাও বলতে পারবে। এতে ইতিকাফের ক্ষতি হবে না। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতেকাফ অবস্থায় চলতে চলতে রোগীর কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন। কিন্তু এর জন্য রাস্তায় দাঁড়াতেন না। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৪৭২)

তবে কারো সাথে কথা বলা বা কুশলাদি জিজ্ঞাসার জন্য মসজিদের বাইরে অল্প সময়ও দাঁড়ানো জায়েয হবে না। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৯৭; মিরকাতুল মাফাতিহ ৪/৫২৯; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১২১)

অযু ইস্তেঞ্জার প্রয়োজনে মসজিদের বাইরে যাওয়া জায়েয। আর মসজিদের টয়লেট না থাকলে এজন্য বাসা-বাড়িতে যাওয়াও জায়েয। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতেকাফরত অবস্থায় ইস্তিঞ্জার প্রয়োজন ব্যতীত ঘরে প্রবেশ করতেন না। (সহীহ বুখারী ১/২৭২; সহীহ মুসলিম ১/১৪২; আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৭৯; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪৪৫; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২১২)

বুঝমান নাবালেগের ইতেকাফ সহীহ। তবে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্য থেকেই ইতেকাফে বসা উচিত । কেননা রমযানের শেষ দশকের ইতেকাফ অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ ইবাদত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা গুরুত্ব সহকারে আদায় করতেন। তাই এ ব্যাপারে উদাসীনতা মোটেই ভালো নয়। (বাদায়েউস সানায়ে ২/২৭৪; আলবাহরুর রায়েক ২/২৯৯; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২১১; রদ্দুল মুহতার ১/৫৭৭)

পুরুষের ইতেকাফ সহীহ হওয়ার জন্য শরঈ মসজিদ হওয়া জরুরি। পারিবারিক নামায-ঘরে ইতেকাফ সহীহ হবে না। তাই ইতিকাফে বসতে চাইলে মসজিদেই বসতে হবে। খানা আনা-নেওয়ার জন্য কেউ না থাকলে ইতেকাফ অবস্থায় খানা নেওয়ার জন্য বাড়ি যেতে পারবেন। তবে খানা নিয়ে দ্রুত মসজিদে ফিরে যেতে হবে। বাইরে বিলম্ব করা যাবে না। (সূরা বাকারা ১৮৭; সুনানে আবু দাউদ ৩৩৫; ফাতাওয়া খানিয়া ১/২২১; খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/২৬৭; তাবয়ীনুল হাকায়েক ১/৩৪৯; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২১১; রদ্দুল মুহতার ২/৪৪০)

কেউ যদি এমন মসজিদের দ্বিতীয় তলায় ইতেকাফ করে যেখানে নিচ তলায় যাওয়ার সিড়ি মসজিদের বাহিরে। এ অবস্থায় ইতেকাফকারী ব্যক্তি ঐ সিড়ি ব্যবহার করে নিচ তলায় এসে কাতারের সাথে মিলে দাঁড়াতে পারবে। এ ক্ষেত্রে মসজিদের বাইরের সিড়ি ব্যবহার করার কারণে তার ইতিকাফ নষ্ট হবে না। (মাবসূত সারাখসী ৩/১১৭; তাবয়ীনুল হাকায়েক ১/৩৫০; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ২/৪১১; ফাতহুল কাদীর ২/৩০৯; বাদায়েউস সানায়ে ২/২৮৩; রদ্দুল মুহতার ২/৪৪৫)

মহিলারা নিজের বাসায় নামায কক্ষে ইতেকাফ করবেন। অন্য কক্ষেও ইতিকাফ করতে পারবেন। তবে যে কক্ষে ইতেকাফ করতে চাচ্ছেন ঐ কক্ষকে আপাতত তার নামায-ঘর হিসেবে নির্দিষ্ট করে নিতে হবে এবং ইতেকাফের পূর্ণ সময় এ ঘরেই অবস্থান করতে হবে। (মাবসূত, সারাখসী ৩/১১৯; আলবিনায়াহ ৪/৩৮৬; আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৭৯; তাবয়ীনুল হাকায়েক ২/২২৬; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২১১; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪৪১)

অস্থায়ী নামাযের ঘর যেহেতু ‘শরঈ মসজিদ’ নয় তাই তাতে পুরুষের জন্য ইতেকাফ সহীহ হবে না। ইতেকাফ সহীহ হওয়ার জন্য ‘শরঈ মসজিদ’ হওয়া জরুরি। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে, (তরজমা) তোমরা মসজিদে ইতেকাফরত অবস্থায় (স্ত্রীদের) সাথে মিলিত হয়ো না। (সূরা বাকারা ২ : ১৮৭)

ইমাম কুরতুবী র. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, উক্ত আয়াতের আলোকে সকল ইমাম এ বিষয়ে একমত যে, পুরুষদের জন্য মসজিদ ছাড়া অন্যস্থানে ইতেকাফ সহীহ হবে না।

(সূরা বাকারা ২ : ১৮৭; তাফসীরে কুরতুবী ২/২২২; কিতাবুল ইসআফ ফী আহকামিল আওকাফ ৭২; আলবাহরুর রায়েক ২/৩০১; খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/২৬৭; বাদায়েউস সানায়ে ২/২৮০; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ৩/৪৪২; আদ্দুররুল মুখতার ২/৪৪০)

আযান দেওয়ার জন্য ইতেকাফকারী মুয়াযযিনের মসজিদের বাহিরে কোন রুমে বা বাহিরে যাওয়া জায়েয। এ কারণে ইতেকাফ নষ্ট হবে না।
(দেখুন : আলমুহীতুল বুরহানী ৩/৩৮০; রদ্দুল মুহতার ২/৪৪৫; আলবাহরুর রায়েক ২/৩০৩)

কোন ব্যক্তি গত রমযানের শেষ দশকে ইতেকাফে বসে। কয়েকদিন পর অসুস্থ হয়ে পড়ে। ফলে ইতেকাফ ছেড়ে বাড়িতে চলে আসতে হয়েছে। যার কারণে পরবর্তী দিনগুলোতে ইতেকাফ করা সম্ভব হয়নি। এ ক্ষেত্রে ঐ ব্যক্তিকে ইতেকাফ কাযা করতে হবে। অবশ্য রমযানের বাইরে ইতেকাফটি কাযা করতে চাইলে দিনের বেলা নফল রোযাও রাখতে হবে। (দেখুন : রদ্দুল মুহতার ২/৪৪৪-৪৪৫; আহকামে ইতিকাফ ৫০)

রমযান মাসের শেষ দশকের ইতেকাফ অবস্থায় সাধারণ গোসলের জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েয নয়। বের হলে ইতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। সুতরাং যে ব্যক্তি সাধারণ গোসলের জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়ার কারণে তার সুন্নত ইতেকাফ নষ্ট হয়ে গেছে। যেদিন গোসলের জন্য বের হয়েছে ঐ দিনের ইতেকাফ কাযা করে নেওয়া জরুরি। আর এই ইতেকাফটি নফল ইতেকাফ হিসাবে গন্য হবে। (মারাকিল ফালাহ ৩৮৩; ফাতাওয়া খানিয়া ১/২২৩; খুলাসাতুল ফাতাওয়া ১/২৬৮; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২১২)

জানাযার উদ্দেশ্যে মসজিদ থেকে বের হলেও ইতেকাফ থাকে না, ভেঙ্গে যায় । তাই আপনি ইতেকাফ অবস্থায় মসজিদের বাইরের জানাযার নামাযে শরিক হতে পারবেন না। বের হলে সুন্নত ইতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২৪৬৫; মাবসূত, সারাখসী ১/১১৮; বাদায়েউস সানায়ে ২/২৮৩; ফাতাওয়া খানিয়া ১/২২২)

কোন নারী ইতেকাফ শুরু করার পর মাসিক শুরু হলে তার ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে। যে দিন মাসিক শুরু হয়েছে শুধু সেই একদিনের ইতেকাফ কাযা করে নেওয়া জরুরি। এই এক দিন কাযা করার নিয়ম হল, একদিন সূর্যাস্তের আগে ইতেকাফ শুরু করতে হবে। পরবর্তী দিন রোযা থাকতে হবে। সূর্যাস্তের পর ইতেকাফ শেষ হবে। এভাবে একদিন রোযাসহ ইতেকাফ করলেই কাযা আদায় হয়ে যাবে। পুরো দশ দিনের ইতেকাফ কাযা করতে হবে না। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২০৭; জামিউর রুমুয ১/৩৮৫; রদ্দুল মুহতার ২/৪৪৫; আলজাওহারা পৃ. ১৮৬; ফাতাওয়া রহীমিয়া ৭/২৮৬)

কেউ যদি সুন্নত ইতেকাফে থাকা অবস্থায় রোযা রাখতে না পারে তাহলে তা সুন্নত ইতেকাফ হবে না। তা নফল ইতেকাফ হবে। কারণ সুন্নত ইতেকাফের জন্য রোযা রাখা শর্ত। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত আছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, রোযা ছাড়া ইতিকাফ হয় না। (সুনানে বায়হাকী ৪/৩১৭; মুসতাদরাকে হাকেম ২/৮১)

অন্য বর্ণনায় আছে, সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন, ইতেকাফকারীর জন্য রোযা রাখা আবশ্যক। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৬/৩০০; ফাতাওয়া খানিয়া ১/২২১; আহকামুল কুরআন, জাসসাস ১/২৪৫; রদ্দুল মুহতার ২/৪৪২)

রমযানের শেষ দশকের ইতেকাফ অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ সুন্নত আমল। রাসূলুলাহ সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে শেষ দশকে ইতেকাফ করতেন। বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা তা প্রমাণিত। এক রমযানে কোনো কারণে তিনি ইতেকাফ করতে পারেননি। তাই পরবর্তী বছর তিনি বিশদিন ইতেকাফ করেছেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২৪৬৮)

কেউ যদি ইতেকাফ কারো সাথে কথা বলতে বলতে বেখেয়ালে মসজিদের বাইরে চলে যায়। এ ক্ষেত্রে মসজিদ থেকে বের হওয়ার কারণে তার সুন্নত ইতেকাফ ভেঙে গেছে এবং তা নফল হয়ে গেছে। এখন তাকে শুধু এক দিনের ইতেকাফ কাযা করতে হবে। অর্থাৎ কোনো এক দিন সূর্যাস্তের পূর্ব থেকে পর দিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত মসজিদে ইতেকাফের নিয়তে অবস্থান করবেন এবং দিনের বেলায় রোযা রাখবেন। (বাদায়েউস সানায়ে ২/২৮২; ফাতহুল কাদীর ২/৩০৮; রদ্দুল মুহতার ২/৪৪৪)

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে