‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না’
ডা. জাহেদ উর রহমান : ‘করোনা আসলে একটা এক্সরে যেটা কঙ্কালটার ছবি শুধু বের করে এনেছে, আমরা অবশ্যই জানতাম ভেতরে একটা ভয়ংকর কঙ্কাল আছে’ এই উত্তরটা দিয়েছিলেন বিখ্যাত ভারতীয় চিন্তক এবং অ্যাকটিভিস্ট অরুন্ধতী রায়। ভারতের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে ভারত সরকারের পদক্ষেপের মূল্যায়ন করতে বলা হয়েছিল অরুন্ধতী রায়কে। নানা সমালোচনা করে তিনি জানান ভারতে যা যা হয়েছে সেটা নিয়ে তিনি অবাক নন। ভারতের অর্থনৈতিক এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি যে স্রেফ ফাঁপা বুলি সেটা তিনি জানতেন, তখনই বলেন শুরুতে বলা কথাগুলো।
‘আই কান্ট ব্রিদ’ এই মুহূর্তে খুব উচ্চারিত একটা স্লোগান। হাঁটু দিয়ে চেপে শ্বাসরুদ্ধ করে জর্জ ফ্লয়েডকে মেরে ফেলার সময় জর্জ কথাটা বলছিলেন বারবার। তবে কালোদের এই শ্বাসরোধ করার চর্চা শ্বেতাঙ্গ পুলিশদের নতুন না। আমরা অনেকেই জানি না এই স্লোগানটি প্রথম জনপ্রিয় হয়েছিল ছয় বছর আগেও। এরিক গার্নার নামে একজন কালো মানুষকে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ হাত দিয়ে গলা টিপে মেরে ফেলেছিল তখন। ঘটনাচক্রে সেটারও একটা ভিডিও ছিল, এবং সেই ভিডিওতেও গার্নারকে বারবার বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘আই কান্ট ব্রিদ’।
এবার আমেরিকা ফেটে পড়েছে প্রচণ্ড বিক্ষোভে। ক্ষোভ তাদের এতই উত্তাল হয়েছে যে, এই ভয়ংকর করোনা আক্রান্ত সময়েও তাদের স্বাস্থ্যবিধি কিংবা সামাজিক দূরত্ব নিয়ে কোনও মাথা ব্যথা নেই, প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে তারা। আমরাও ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে’ ফেসবুকে প্রতিবাদ করেছি, সংহতি জানিয়েছি প্রতিবাদকারীদের সঙ্গে।
একটা রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সদস্য তার একজন নাগরিককে হাত দিয়ে কিংবা হাঁটু দিয়ে চেপে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলতে পারে যেখানে একজন মানুষ বারবার শ্বাস নিতে না পারার আকুতি করেও বেঁচে উঠতে পারে না। তেমনি একটা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাও মানুষের শ্বাসরোধ করার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করতে পারে এবং শ্বাস আটকে গেলে তা থেকে বের করে আনার পদক্ষেপ না নিয়ে তাকে মেরে ফেলতে পারে। এই পরিস্থিতি সম্ভবত আরও ভয়ংকর কারণ এই পরিস্থিতিতে পড়তে পারে শত শত, হাজার হাজার, এমনকি লাখ লাখ মানুষ।
বাংলাদেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা মোটামুটি বাড়ার পর থেকে যে দুটি হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা প্রাথমিকভাবে শুরু হয়েছিল (কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল এবং কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল) সেখানে কাজ শুরু হয়েছিল চরম অক্সিজেন সংকট নিয়ে। করোনার মূল জটিলতা যেখানে ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটার কারণে মানুষের শ্বাস নিতে সমস্যা হওয়া, সেখানে এমন হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা দিতে শুরু করা হলো যেখানে কোনও কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থাই ছিল না। এরপর ঢাকায় আরও কিছু হাসপাতালকে করোনার জন্য নির্ধারণ করা হয় এবং আমরা নিয়মিত সংবাদ দেখেছি, প্রত্যেকটা হাসপাতালে অক্সিজেন সংকট আছে।
গতকাল একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় করোনা চিকিৎসায় অক্সিজেনের অভাব নিয়ে রিপোর্ট করা হয়েছে। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে করোনা ইউনিটের অবস্থা সেখানে বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে—
অক্সিজেন সমস্যা এতটাই প্রকট যে তা দেখে চিকিৎসকরা রীতিমতো ভয় পাচ্ছেন। একজন চিকিৎসকের ভাষায় মরুভূমিতে আপনার এক বুক পিপাসা, আর সে সময় আপনাকে বলা হচ্ছে আপনি থুথু গিলে পিপাসা নিবারণ করেন। অন্য আরেক চিকিৎসক বলছেন, পুকুর থেকে মাছ তোলার পর মাছ যেরকম ছটফট করে, অক্সিজেনের জন্য রোগীরা ঠিক সেরকমই করছেন। তিনি বলেন, ২৫ জন রোগীর জন্য নির্ধারিত একটা জায়গা। এর মধ্যে ১৮/২০টা বেডে অক্সিজেনের পোর্ট রয়েছে। একটা পোর্ট একজনমাত্র রোগীর অক্সিজেন জোগান দিতে পারে। সেখানে একশ’ জনেরও বেশি রোগী। বেশিরভাগ রোগীরই অক্সিজেন দরকার। তাও মিনিটে ১৫ লিটার করে।’
করোনা চিকিৎসায় আইসিইউ-ভেন্টিলেটর নিয়ে একটা কুতর্ক আছে। অনেকেই আকারে ইঙ্গিতে বলার চেষ্টা করেন, আইসিইউতে নেওয়া রোগীদের যেহেতু প্রধান অংশই মারা যায়, তাই আইসিউ নিয়ে খুব বেশি কথা বলার দরকার নেই। কুতর্কটা মেনে নিলাম আজকের জন্য, আলোচনার খাতিরে আইসিইউ-ভেন্টিলেটর সরিয়ে রাখি তাহলে। কিন্তু নিজে একজন ডাক্তার হিসেবে জানি যে রোগী নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যাওয়ার কারণে চরম রেস্পিরেটরি ফেইলিওর এর মুখোমুখি হন তাকে অক্সিজেন দিলে তিনি একেবারে সুস্থ হয়ে যান। তার বাঁচা আর মরার মাঝখানে শুধু এই অক্সিজেনই কাজ করে। বাংলাদেশে এই মুহূর্তেও বহু রোগী মারা যাচ্ছে শুধুমাত্র পর্যাপ্ত পরিমাণ অক্সিজেন না পাওয়ার কারণে। একটা রাষ্ট্রের (যার সরকার দাবি করে তারা ‘উন্নয়নের রোলমডেল’) কাছে তার নাগরিকরা কি অক্সিজেনটুকুও চাইতে পারে না? পেতে পারে না?
দেশের হাসপাতালগুলোর এই অবস্থা দেখে অবাক হইনি বিন্দুমাত্রও। অরুন্ধতী রায়ের মতো আমিও জানতাম আমাদের তথাকথিত উন্নয়নের যে স্লোগান চারদিকে উঠছিল গগনবিদারী হয়ে, সেটা একেবারেই ফাঁপা আওয়াজ। স্বাস্থ্য খাতে প্রতিবছর জিডিপির অনুপাতে বরাদ্দ কমাতে কমাতে, চরম লুটপাট করতে করতে করতে একটা কঙ্কাল আছে শুধু, সেটা আমরা জানতাম। করোনা এক্সরে’র মতো সেটার ছবিই বের করে এনেছে শুধু।
আজ যখন এই লেখাটা লিখছি তখন এই দেশে অ্যাক্টিভ কেস রোগীর সংখ্যা প্রায় ৯০ হাজার ৯১৯ জন। নিশ্চিতভাবেই এর একটা ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ হাসপাতালে যাচ্ছেন; বেশিরভাগই চিকিৎসা নিচ্ছে বাসায়। তাতেই দেশের শীর্ষ দু’টো শহর ঢাকা আর চট্টগ্রামে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আর তখন আমরা শিথিল করে সবকিছু খুলে দিলাম। যদিও জোন ভিত্তিক লকডাউনের সিদ্ধান্তে এসেছে সরকার।
যখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ছিলাম তখন আমাদের বন্ধুদের মধ্যে কাউকেই প্রিভেনটিভ মেডিসিনের প্রতি আগ্রহী দেখতাম না; কিউরেটিভ মেডিসিনের যেই গ্ল্যামার আছে সেটা প্রিভেনটিভ মেডিসিনের নেই। তাই তৃতীয়-চতুর্থ বর্ষে যখন আমাদেরকে প্রিভেন্টিভ মেডিসিনের ওপরে ‘কমিউনিটি মেডিসিন’ বলে একটা কোর্স পড়তে হতো, সেটা কেউ খুব ভালোবেসে পড়তে চাইতো না। কিন্তু যে কথাটা সেই সময় আমাদের শিক্ষকরা বারবার বলার চেষ্টা করেছিলেন কানে বাজে এখন সেটাই—আমাদের মতো গরিব দেশে যেখানে কিউরেটিভ মেডিসিনের সুযোগ সুবিধা অনেক কম (কারণ এটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল), সেসব দেশের প্রিভেন্টিভ মেডিসিন অনেক বেশি গুরুত্ব পাওয়া উচিত। কারণ রোগ হতে না দিয়েই আমাদের দেশের মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়।
ঈদের পর সব খুলে দিয়ে আমরা এখন যাচ্ছি কিউরেটিভ মেডিসিনের দিকে। মানুষ আক্রান্ত হোক, হলে চিকিৎসা নিতে যাবে। এমন তৃতীয় শ্রেণির একটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যা এর মধ্যেই ভেঙে পড়েছে অতি অল্প সংখ্যক রোগী ম্যানেজ করতে গিয়েই, তার অবস্থা আর কিছুদিন পর কী হতে পারে, সেটা অনুমান করার জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানী হবার দরকার নেই।
সচেতন মানুষ এখন নিজে নিজে অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনছেন কয়েকগুণ বেশি দামে, অনেকেই অনলাইনে অক্সিজেন সরবরাহ পাবার ফোন নম্বর খুব গুরুত্ব দিয়ে সেভ করে রাখছেন। কিন্তু শেষরক্ষা কি হবে? হাজার হাজার কিংবা লাখ লাখ মানুষের অক্সিজেন প্রয়োজন হলে ব্যক্তিগত উদ্যোগেও কি কিছু করা যাবে?
করোনায় এখন পর্যন্ত ভীষণ অপর্যাপ্ত, ভুল পদক্ষেপ নিয়ে এবং সর্বশেষ শিথিলতা দিয়ে আক্ষরিক অর্থেই শ্বাস নিতে পারছে না মানুষ। এবার হাসপাতাল থেকে তো বটেই, আমরা আমাদের চারপাশের বাড়ি থেকেও কি শুনতে থাকবো করোনা রোগীদের মর্মান্তিক আর্তচিৎকার—‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না’।
লেখক: শিক্ষক ও অ্যাকটিভিস্ট
সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন