সুশান্ত, আপনি হারলেও, আমরা হারব না!
সৌমিত জয়দ্বীপ : আমি প্রায়ই ভাবি, কখনও কখনও বলিও, সাহিত্যে, গল্পে বা চলচ্চিত্রে আমরা যে মূল্যবাধকে সামনে আনি, তা যদি আমরা নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করতে পারতাম, তাহলে হয়তো পৃথিবীটাই বদলে যেত!
যেমন, ছবির নাম ‘পিংক’, একদম নারীবাদী চলচ্চিত্র। কিন্তু, যারা ওই ছবিতে অভিনয় করেছেন, বাস্তব জীবনে তারা নারীবাদী কোনো মুভমেন্টে অংশগ্রহণ করেছেন কি না, এটারও মূল্যায়ন হওয়া দরকার। নিজে ঠিক নেই আপনি, কিন্তু, সমাজ বদলানোর বার্তা নিয়ে হাজির, কখনও কখনও এমন কাজকে হিপোক্রেসি বা প্রতারণা মনে হয়। মনে হয়, প্রয়োজনটা শুধু পেশাদারি বৈভববিত্ত ও যশেরই। কিন্তু, তারকা হিসেবে এতটুকু সামাজিক দায় আপনি বোধ করবেন না?
২.
সুশান্ত সিং রাজপুত আমার কাছে জীবনঘনিষ্ঠ এক অভিনেতা হিসেবে বেঁচে থাকবেন। সেটা সেলুলয়েডের পর্দায়। কিন্তু, তিনি তো আমার সব আশা ধ্বংস করে দিয়ে গেলেন!
প্রচণ্ড হতাশাবাদী কাউকে যদি আপনার একটু উদ্যমী করতে ইচ্ছে করে, তাহলে চোখ বন্ধ করে আমি বলতাম ‘থ্রি ইডিয়টস’ দেখতে, বার বার দেখতে বলব। এরপর, বাজারে বাজারের নিয়মেই ২০১৯ সালে এলো ‘ছিছোরে’, বাংলায় যাকে বলে ‘ফাজিল’।
সুশান্ত সিং, আমির খান নন। ‘পিকে’ করতে গিয়ে আমিরের কাছে নিশ্চয়ই অভিনয়ের অনেক কিছুই শিখেছিলেন। কিন্তু, তার জন্য কঠিন ছিল ‘ছিছোরে’র অভিনয়। এ ঘরানায় আমিরের ‘থ্রি ইডিয়টসে’র যে প্রভাব, তা তাকে অতিক্রম করতে হতো। সেটা তিনি পেরেছিলেন। তার স্বতন্ত্র অভিনয়ের জোরে ‘ছিছোরে’ মন জিতে নিল। ‘থ্রি ইডিয়টস’ নয় শুধু, জীবনকে অন্যরকম গল্প বলার রঙ-রস নিয়ে হাজির হলো আরেকটা ম্যুভি, নাম তার ‘ছিছোরে’! মন খারাপ থাকলে দেখবেন এ দু’টি, অবশ্যই জীবন বদলাবে।
কিন্তু, যে মানুষ আমাকে বলবেন আজ থেকে আর ‘ছিছোরে’ দেখব না, তাকে ওখানে টেনে নিয়ে যাওয়ার বাস্তব কোনো ইচ্ছে আমার মরে গেল। হেরেই গেলাম! যে ম্যুভিটা একটা ‘এন্টি-সুইসাইডাল ওয়েভ’ দেওয়ার জন্য এতো আলোড়ন তুলল, শেখাল ‘কিপ ফাইট’, যে সুশান্ত একদম ম্যাজিশিয়ানের মতো অভিনয় করে এই ওয়েভের আইকন হয়ে উঠলেন, সেই তিনি আত্মহত্যা করবেন মাত্র ৩৪ বছর বয়সে, এর চেয়ে ভয়ঙ্কর রসিকতা আর কী হতে পারে!
যে ম্যুভির নায়ক খোদ নিজে আত্মহত্যা করেন, সে ম্যুভি হতাশাগ্রস্ত কাউকে দেখতে বলা মানে, প্রতারণা করা। সে যদি জিজ্ঞেস করে, সুশান্ত তো নিজেই নিজেকে হত্যা করেছে জীবনযুদ্ধ হেরে গিয়ে, এর কোনো উত্তর থাকবে আপনার কাছে? একে আপনি পরাজয় বলবেন না, বলুন তো?
তার মানে কি, সেলুলয়েড জীবনকে কোনো শিক্ষাই দিতে পারে না! তার মানে কি, আমাদের অধিত সকল বিদ্যা মূল্যহীন! এই ন্যারেটিভকে মোকাবেলা করা তো মুশকিল হয়ে গেল আজ থেকে!
৩.
এই মানুষটাই তো ‘এমএস ধোনি: দ্য আনটোল্ড স্টোরি’ বায়োপিকটায় অভিনয় করেছেন। ওটাও তো সংগ্রাম করে বড় হওয়া এক মহাতারকার গল্পগাথা। সেই সংগ্রামের শিক্ষাটা তিনি সরাসরি নিয়েও এরকম একটা এন্টি-স্ট্রাগল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন!
আজকে যে ধোনির গৃহ আলো করে আছেন সাক্ষী রাওয়াত, হয়তো তার জায়গায় থাকতে পারতেন প্রিয়া ঝাঁ। বেচারি প্রিয়া, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলেন যখন, ধোনির জীবনটা উথালপাতাল করেছে নিশ্চয়ই! সুশান্ত এসবও জেনেছেন অভিনয় করতে গিয়ে।
ক্রিকেট সিনেমা না। ক্রিকেট মাঠের যাবতীয় সিদ্ধান্ত একদম নগদে নিতে হয়। জীবনের মতোই। চাপের মধ্যেও মাথা ঠাণ্ডা রেখে এসব সিদ্ধান্ত নিতে পারেন বলেই তো ধোনি হয়ে উঠেছেন ‘ক্যাপ্টেন কুল’। সুশান্ত এগুলো আপনার-আমার চেয়ে বেশি জানতেন। কেননা, তাকে এ চরিত্রটা করতে হয়েছে।
অথচ, এতো কিছু জেনেও কেমন না-জানার ভান করে বসলেন!
৪.
সুশান্তকে আমি ভীষণ ভালোবাসি তার অভিনয় ও অদ্ভুত সুন্দর মন ভালো করে দেওয়া হাসির জন্য। সেই ভালোবাসার মানুষটা আজ থেকে দুয়োও কুড়োবেন আমার, কেননা তিনি আমার সমস্ত মানবিক বিশ্বাসকে তছনছ করে দিয়ে গেলেন! আত্মহত্যাকে আমি তীব্রভাবে ঘৃণা করি, অথচ তিনি এত কিছু করেও, সেটার কাছেই জীবনকে সমর্পণ করলেন!
করোনাকালে জীবন হয়ে গেছে মুড়ি মুড়কি! যেন চিবোলেই জীবন শেষ। আর সেখানে কি না এভাবে অনায়াসে নিজেকে খুন করা! এতো বড় ফাজলামিটা আপনি করতে পারলেন সুশান্ত সিং রাজপুত? আমরা নিশ্চয়ই সত্যের খাতিরে এটা স্বীকার করে নিব যে, করোনাকালে মানুষের সঙ্গে মানুষের দেখা না হওয়ার, আড্ডা না দেওয়ার কারণে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে বটে। সে কারণে হতাশাও হয়তো গ্রাস করছে। ফলে, কারও বিরুদ্ধে সামাজিক ঘৃণা ছড়ানোর যে রোগ আমাদের মগজে, তার প্রভাব আরও ভয়ঙ্কর হচ্ছে হয়তো। কিন্তু, এগুলো সব বিবেচনা করেও কি আত্মহত্যাকে প্রশ্রয় দেওয়া যায়?
তারকাদের জীবন সাধারণ মানুষের মতো না। হ্যাঁ, তারা হয়তো সবার সঙ্গে মিশতে পারেন না। কিন্তু, নিজের সমস্যা ভাগাভাগি করে নেওয়ার মতো দশজন ব্যক্তি তারা দশ মিনিটেই বের করে নিতে পারেন। সেই চেষ্টাটা তিনি করেননি বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে এখন। জানা যাচ্ছে, গত ছয় মাস থেকে তিনি অবসাদগ্রস্ততার চিকিৎসা করছিলেন। ঔষুধ খাচ্ছিলেন। তার মানে, তিনি চিকিৎসকের সংস্পর্শেই ছিলেন। এত জনপ্রিয় তারকা, এত সুযোগসুবিধার মধ্যে ছিলেন, তবুও এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। তাহলে আমজনতার অবস্থা কী – এ প্রশ্ন তুলে স্যোশাল মিডিয়ায় যারা ইনিয়েবিনিয়ে আত্মহত্যাকে সমর্থন করছেন, তারা একটা বড় সত্যকে এড়িয়ে যাচ্ছেন৷ সেটা হলো, তারা জীবনযাপনের সমস্ত দায় মোকাবেলায় মৃত্যুকে সমাধান মনে করছেন৷ মৃত্যু কখনও জীবনের সমাধান না। জীবনযাপনের সংকট মোকাবেলা করাই জীবনের সৌন্দর্য। এটা যারা মানেন না বা বুঝেন না, তাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে, তারা যেন চিকিৎসকের পরামর্শ নেন। নিজের জীবনকে নিজের নিয়মে চালাতে চাওয়ার ব্যক্তিস্বাতন্ত্রতাবাদী অহম ও স্বাধীনতাবোধ খুব নিবিড়ভাবে একজন ‘ইনডিভিজুয়ালে’র জন্ম দেয়। তার সমস্ত চর্চা ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে বিস্তারিত হয়। জীবনযাপনে সমাজ ও রাজনীতির প্রভাবকে সে অস্বীকার করে, মোকাবিলা করতে চায় না। মানুষ ঠিক এ জায়গায়টায় পরাজিত হয়। ব্যক্তিবাদের যাবতীয় পরাজয় বা নেতিকে সে নিজের পরাজয় বা নেতি মনে করে। বিদ্যমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিশ্বকাঠামো মানবিক সমস্ত সুখবোধকে যন্ত্রে রূপান্তর করেছে। যন্ত্রের এ জাঁতাকল আমরা অতিক্রম করতে পারি না বলেই নিজেকে দুনিয়া থেকে ‘অপর’ করি কিংবা দুনিয়াকে ‘অপর’ ভাবি। ‘অপর’ ভাবার এ রাজনীতিটাও বোঝা দরকার। আত্মহত্যা শুধু মুহূর্তের সিদ্ধান্তে আসে না। যাবতীয় হতাশাবোধ থেকেও আসে না। এর পেছনের দুষ্টচক্রকে চিহ্নিত না করে শুধু মনস্তাত্ত্বিক সংকটকে মোকাবিলা করে এ ব্যাধিকে বয়কট করা মুশকিল হবে। আমি মনস্তত্ত্ববিদ নই৷ ফলে, এ সংক্রান্ত আলোচনায় সীমা টানা আমার একান্ত কর্তব্য।
৫.
সুশান্ত আজ থেকে ইয়ার্কিতেই ফুরনো এক জীবন আমার কাছে৷ কিন্তু, দোহাই, আপনি সুশান্ত হতে যাবেন না। হতাশাবাদী এ লেখার অপর পৃষ্ঠে আমি আপনার জন্য আশা রেখে যেতে চাই। ঠিক আছে, আপনি আর কোনোদিন ‘ছিছোরে’ না দেখেন, সে দোহাই আপনাকে দিচ্ছিও না। কিন্তু, জীবনকে এভাবে হতাশায় ডুবে মারবেন না দয়া করে। লড়াইটা জারি রাখুন, কিপ ফাইট! পুরো জীবনটাই একটা সহজ স্বাভাবিক গ্যাম্বেল। জিতলেও You Exist, হারলেও You Exist, জীবনকে এভাবে দেখুন। জুয়াটা খেলতে শিখুন সাহসের সঙ্গে।
কিংবদন্তি বক্সার মোহাম্মদ আলী বলেছিলেন, “Life is a gamble.” আমি যোগ করে নিয়েছি, “Accept it” কিংবা কনফুসিয়াসের সেই কথাটা, “Life is really simple, but we insist on making it complicated.” অথবা জার্মান দার্শনিক ফ্রেডেরিক নিৎশে যেমনটা বলেন, “He who has a way to live can bear almost any how.”… এসবের সমন্বয়ে আমি তাই জীবনকে জুয়া মনে করি, সাদাসিধা মনে করি, স্বেচ্ছায় জটিল করি না এবং জুয়া খেলার ‘হোয়াই’য়ের উত্তরটা আমি জানি।
জীবন সুন্দর! জীবনকে বাইনারি অপজিশন দিয়ে ভাবতে গেলেই তা কঠিন হয়ে ওঠে। হয়তো সুশান্ত এমন ব্যক্তিগত বাইনারি তৈরি করেই প্রাণহরণ করলেন নিজের!
অথচ, সবচেয়ে জরুরি খবর এখন, আমি-আপনি-আমরা, যে যাই হই না কেন, যাই ঘটুক না কেন, আমরা টিকে আছি! সুশান্ত আর নেই, আমরা আছি, তিনি লড়াইটা হেরে গেছেন, ফলে, এখন পর্যন্ত আমরাই জয়ী। এটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে তাৎপর্যময় সংবাদ। তাকে ভুলে যান! আপনার প্রতি এতটা রুঢ় হওয়ার জন্য দুঃখিত সুশান্ত!
প্রিয় সুশান্ত, সেলুলয়েডের পাণ্ডুলিপিকে জীবনের পাণ্ডুলিপিতে রূপান্তরিত করতে না পারার অপরাধে আপনাকে আমরা মৃত ঘোষণা করলাম!
সূত্র : বিডিনিউজ