চীন-ভারত সংঘাতে কার ক্ষতি কার লাভ?

প্রকাশিত: জুন ২৪, ২০২০; সময়: ১:১৫ পূর্বাহ্ণ |
চীন-ভারত সংঘাতে কার ক্ষতি কার লাভ?

পলাশ মাহমুদ : গেল ১৫ জুন রাতে লাদাখে চীন ও ভারতীয় সেনাদের সংঘর্ষে আঞ্চলিক রাজনীতি কিছুটা হলেও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সংঘাতের পূর্বাপর ঘটনা বিশ্লেষণে দেখায় যায়, এটি নিছক দুই দেশের বিবাদ নয়। সংঘাতে ভারতের ২৩ সেনার মৃত্যু হয়েছে। চীনেরও বেশ কিছু সেনা মারা গেছে বলে দাবি করেছে ভারত। তবে এই ঘটনা এখন দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এর ছোঁয়া লেগেছে আঞ্চলিক একাধিক দেশের ওপর। লাদাখের উত্তেজনা চীন ও ভারতের অভ্যন্তরে ব্যাপক উত্তেজনা ছড়ালেও পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল, পাকিস্তান ও বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়েছে।

সেদিনের এই সংঘর্ষের সূত্রপাত নিয়ে এখনো ধুম্রজাল রয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রথমে দাবি করা হয়েছিল, চীনা সেনারা চুক্তি ভঙ্গ করে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। পরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, কোনো দেশের সেনারা ভারতীয় সীমান্তে প্রবেশ করেনি বা ভারতের কোনো যায়গা দখল বা স্থাপনাও তৈরি করেনি। অন্যদিকে চীনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ভারতীয় সেনারা চুক্তি ভঙ্গ করেছে।

তবে নরেন্দ্র মোদীর বিবৃতির পর বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে ভারত। দেশটির সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে বিশিষ্টজনরাও প্রশ্ন তুলছেন, ভারতের অভ্যন্তরে কোনো বিদেশী সেনা প্রবেশ না করলে সংঘর্ষ হল কী করে? তাহলে কি ভারতীয় সেনারাই চীনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে? তাঁদের মধ্যে আছেন, লেখক ব্রহ্মা চেলানি, ‘হিন্দু’র ন্যাশনাল ও ডিপ্লোমেটিক এডিটর সুহাসিনী হায়দার, ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’–এর উপসম্পাদক সুশান্ত সিং। এই প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত।

সীমান্তের যে এলাকার মালিকানা নিয়ে এই সংঘাত সেখানে কোনো মানববসতি নেই। হিমালয় পর্বতমালার এই অংশের জন্য দুই দেশের বিবাদ বহু পুরনো। তবে দুই দেশই বরাবর সংঘাত এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছে। ১৫ জুন বিবাদের মাত্র এক সপ্তাহ আগেও দুই দেশের সেনা পর্যায়ে বৈঠক হয় এবং তারা একটি চুক্তিতে পৌঁছে। সীমান্তের দুই কিলোমিটারের মধ্যে এক অন্যের বিরুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করবে না বলে চুক্তিবদ্ধ হয়। কিন্তু চুক্তির পরপরই কেন এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা তা নিয়ে বিশ্লেষণ চলছে বিভিন্ন মহলে।

দ্য গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের পরে চীনের অর্থনীতি ভালো নেই। অন্যদিকে কানাডায় হুয়াওয়ের কর্মকর্তা গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। আবার করোনা নিয়ে তদন্তের দাবি করায় অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধে জড়িয়ে বেইজিং। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক তাদের একবারে তলানিতে। এমন পরিস্থিতিতে চীনের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একমাত্র ভারতই বিশ্বে চীনবিরোধী শক্তিগুলোর হাতিয়ার হতে পারে। এজন্য ভারতকে শাসানো এবং ‘ঝি’কে মেরে ‘বউ’কে শেখানো বা ভয় দেখানোর’ কৌশল নিয়েছে চীন।

ভারত চীনবিরোধী বৈশ্বিক শক্তির হাতিয়ার হলে তাকে যেন মোকাবেলা করা সহজ সেই কৌশল নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছে বেইজিং। ভারতের এক পাশে পাকিস্তান; পূর্ব থেকেই দেশটি ভারতের শত্রু শক্তি হিসেবে চিহ্নিত। অপর পাশে আছে নেপাল। সম্প্রতি দেশটি ভারতের দাবিকৃত ভূখণ্ড নিজেদের মানচিত্রভুক্ত করেছে সংসদেও সেটির অনুমোদন করিয়েছে। কার্যত নেপালের সাথে ভারতের সম্পর্কও একেবারে তলানিতে পৌঁছেছে।

ভারতের ১৫ হাজার কি.মি. স্থল সীমানার মধ্যে চীন, পাকিস্তান ও নেপালের সঙ্গে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কি.মি.। অর্থাৎ শত্রুর সঙ্গে বসবাস প্রায় ৬৫ শতাংশ সীমানাজুড়ে। মূলত নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার পরই লাদাখে সংঘাত হয়েছে। ওই সংঘাতের পর গন্ধক বাঁধ এলাকায় সংস্কার করতে ভারতকে বাঁধা দিয়েছে নেপাল। তাদের দাবি এই এলাকা নেপালের ভূখণ্ডে পড়ে। নেপালের এই ভূমিকার পিছনে চীন ও নেপাল একসুতোয় গাঁথা তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। চীন সুকৌশলে এভাবে ভারতকে ঘিরে ফেলছে।

তবে এই অঞ্চলে ভারতের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধু বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ভূমিতে কোনো ভারতবিরোধী কর্মকাণ্ড হবে না এটা নিশ্চিত নয়াদিল্লী। তবুও লাদাখের পরে এর কিছুটা আচ পড়েছে বাংলাদেশে। লাদাখে সংঘাতের পর চীন দেশটিতে বাংলাদেশি পণ্য প্রবেশে শুল্ক সুবিধা দিয়েছে। পাঁচ সহস্রাধিক পণ্যে এ সুবিধা দেয়া এখন বাংলাদেশের প্রায় ৯৭ শতাংশ পণ্যে সুবিধা পাচ্ছে ঢাকা। কিন্তু বিষয়টিকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেছে ভারতীয় মিডিয়া।

দেশটির প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজার পত্রিকা ও জি নিউজসহ বেশ কিছু মিডিয়ায় বাংলাদেশকে ‘খয়রাতি’ তাচ্ছিল্য করা হয়। ফলে বাংলাদেশের ভিতরেও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন এমন শব্দ চয়নকে ছোট মানসিকতার পরিচয় বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি জানিয়েছে, বাংলাদেশ সবার সঙ্গে সমান বন্ধুত্ব বজায় রাখবে। কারো পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নেবে না।

প্রশ্ন হচ্ছে, এই সংঘাতে লাভ কার? জার্মান মার্শাল ফান্ডের সিনিয়র ফেলো অ্যান্ড্রু স্মল গার্ডিয়ানকে বলেছেন, বলে তাঁর মনে হয়েছে, চীনের পক্ষ থেকে এটা অনেকটাই পরিকল্পিত প্রয়াস। সীমান্ত এলাকায় যে চিত্র পাওয়া গেছে, তাতে পরিষ্কার চীনা সৈন্যের উপস্থিতি দেখা যায়। তারা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বা এলএসির কাছে টহল জোরদার করার পাশাপাশি উপস্থিতি বাড়িয়েছে ও অবকাঠামো গড়েছে। চীনা সেনারা একাধিক স্থানে তাদের অবস্থান শক্ত করেছে। এ ধরনের সংঘাতের ঘটনা উচ্চপর্যায়ের অনুমোদন ছাড়া ঘটানো সম্ভব নয় বলেও মত দিয়েছেন অ্যান্ড্রু স্মল।

চীনের উচ্চ পর্যায়ের অনুমোদনেই এই সংঘাত হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কারণ উপরোক্ত বৈশ্বিক শত্রুতা ছাড়াও চীন কিছু আভ্যন্তরীণ সমস্যায় রয়েছে। উইঘুর মুসলিম নির্যাতন নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে রয়েছে চীন। এর মধ্যে গত মাসে বিক্ষোভ সত্ত্বেও বিতর্কিত হংকং নিরাপত্তা আইনের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে চীনের সংসদ। পক্ষে পড়েছে দু হাজার ৮৭৮ ভোট আর বিপক্ষে মাত্র একটি। চীনের এ উদ্যোগের কঠোর বিরোধিতা করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, এমন আইন প্রণয়ন করা হলে আধা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হংকংয়ের স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়বে। এমন পরিস্থিতি লাদাখে সংঘাতের পর আভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো আড়াল করতে পেরেছে শি জিং পিং।

তবে এ ঘটনায় আপাতত দৃষ্টিতে বিপাকে রয়েছেন ভারতের ক্ষমতাসীন সরকার। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর যে জাতিয়তাবাদী ভাবমূর্তি ছিল তা দুর্বল হচ্ছে। ২৩ সেনা নিহত হলেও পাল্টা কোনো আঘাত করতে না পারায় ভারতবাসীর মধ্যে যেমন এক ধরণের হতাশা কাজ করছে তেমনি আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ব্যাপক চাপে রয়েছেন মোদী। সরকারের চাপে থাকার বিষয়টি অনুমান করা যায় রাম মন্দির নির্মাণ কাজ স্থগিত করা সিদ্ধান্ত থেকে। গত শুক্রবার রাম মন্দির ট্রাস্ট এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ভারত-চীন সীমান্তে দ্বন্দ্বের পরিস্থিতিতে অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের পরিকল্পনা স্থগিত করা হয়েছে। আসলে এমন পরিস্থিতে রাজ মন্দির নির্মাণ শুরু হলে দেশে সংঘাত ছড়াতে পারে। চীন যদি সেই সংঘাতে ইন্ধন দেয় তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন হওয়ার ভয় থেকেই হয়তো এমন সিদ্ধান্ত।

লাদাখে ভারতীয় সেনাদের মার খাওয়া, পাল্টা কোনো পদক্ষেপ নিতে না পারা, রাম মন্দির নির্মাণ স্থগিত, সংঘাতের পরই ভারতের অপর ভূখণ্ডে নেপালের হস্তক্ষেপের মতো বিষয়গুলো দেখলে এটা অনুমান করা যায়, আপাতত এই সংঘাতের ফলে চীনের লাভের পাল্লা ভারী। বিপাকে রয়েছে ভারত। কিন্তু এই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে ভারত কি ধরণের কৌশল নেয় তার ওপর নির্ভর করবে চূড়ান্ত ফলাফল।

লেখক- জেষ্ঠ্য প্রতিবেদক, সময় নিউজ।

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে