শিক্ষায় ছন্দপতন
রাজু আহমেদ : একদিকে শিক্ষা অন্যদিকে মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি। মৌলিক চাহিদার অন্যতম শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে হবে, তবে এই মুহুর্তে দেশের পরিস্থিতি এখনো সেই অবস্থায় আসেনি। করোনা পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘদিন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকার ফলে দেশের সকল স্তরের শিক্ষার্থীরা যে বড় ধরণের ক্ষরিত মুখে পড়তে চলেছে তা সহজেই অনুমেয়। রাজশাহীর স্থানীয় শিক্ষক মহল ও অভিভাবকদের সাথে কথা হলে তারা এমনটাই জানান।
এমন পরিস্থিতিতে ধারণা করা হচ্ছে উচ্চ শিক্ষায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা নতুন করে সেশন জটে পড়তে চলেছে। এখন পর্যন্ত উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু করা সম্ভব হয়নি, শুরু হয়নি কলেজে ভর্তি প্রক্রিয়া। অনলাইনে শিক্ষা কর্যক্রম চালুর কথা বলা হলেও এ ক্ষেত্রে বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। তিন মাস পেরিয়ে গেলেও পরিস্থিতি উত্তরণে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে এখন পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়নি।
শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার স্বার্থে সরকারের তরফ থেকে দেশের সকল শিক্ষা কর্যক্রম বন্ধের বা ছুটির ঘোষণা আসে ১৭ মার্চ। এর পর কয়েক দফা এই ছুটি বর্ধিত করা হয়। শেষঅবধি বলা হয়েছে আগামী ৬ আগস্ট পর্যন্ত দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। তবে দেশে প্রতিদিন যে হারে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে এই তারিখ নিয়েও সংশয়ে রয়েছে খোদ শিক্ষকরাই।
এদিকে বিভিন্ন মহল থেকে অনলাইনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার কথা বলা হলেও তা নিয়ে রয়েছে বিরোধ। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও বিভাগ এরই মধ্যে অনলাইনে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্য্যক্রম চালু করেছে। তাতে শিক্ষার্থীরা আশানুরূপ সাড়া দিচ্ছে না।
এক্ষেত্রে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই দুই ধরণের প্রতিবন্ধকতার কথা তুলে ধরেছেন। প্রথমত, দেশের প্রযুক্তি ও বিদ্যুত খাতের অবকাঠামো এখন পর্যন্ত সেই পর্যায়ে পৌছায়নি, একই সাথে প্রযুক্তির সহজলভ্যতা সকল শিক্ষার্থীর কাছে সমান নয় এবং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তি জ্ঞানে অদক্ষতাও এখানে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা।
দ্বিতীয়ত, অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর নামে হঠাৎ নেয়া এই সিদ্ধান্ত শিক্ষা কার্যক্রমকে পুরোপুরি এগিয়ে নিতে পারবে না। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে অনলাইনে ক্লাস লেকচার দেয়া সম্ভব হলেও পরীক্ষা ও হাতে-কলমে (প্রাকটিক্যাল ক্লাস) ক্লাসের মতো বিষয়গুলোর ক্ষেতে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম কাজে আসবে না। একই সাথে ক্লাস চলাকালনি মিথসক্রিয়া (টু ওয়ে কমিউনিকেশন) বা শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মাঝে যে যোগাযোগ তা অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে তাৎখনিক ভাবে সম্ভব হবে না।
শিক্ষানগরী হিসিবে সুপরিচিত রাজশাহী শহর। উচ্চ শিক্ষা পর্যায়ে এক লাখের বেশি শিক্ষার্থী বিভাগীয় শহর রাজশাহীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত। এছাড়া এই জেলায় রয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যয়ের (স্তরের) কয়েক লাখ শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের নিয়েই শিক্ষাঙ্গন আবর্তিত। আর সেই শিক্ষাঙ্গন আজ শিক্ষার্থী শুন্য!
শিক্ষার্থীরা দীর্ঘ তিন মাস ধরে এক কথায় গৃহবন্দি। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা এই তিনটি স্তরের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে মনে হয়েছে, তারা মানসিক ভাবে অশান্তিতে ভুগছেন। অলস সময় পার করছেন। নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বাইরে বের হবারমতো পরিবেশটুকুও তাদের সামনে খোলা নেই। এমন অবস্থায় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যকি পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার আশঙ্কা বাড়ছে। করোনা কারণে দরিদ্র পরিবারগুলোতে দারিদ্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ওই সব পরিবারের শিক্ষার্থীদের আয়ের কাজে লাগন হচ্ছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর ড. প্রণব কুমার পাণ্ডে। পাশাপাশি তিনি রাবি’র শিক্ষাবিষয়ক প্রতিষ্ঠানের গুণগত মান নিশ্চিতকরণ সেল (আইকিউএসি) এর অতিরিক্ত পরিচালক। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে গেলে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখান জন্য নিজে উদ্যোগী হন। তাঁর বিভাগের মাস্টার্সের ৬০ জন শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ক্লাস নিতে চান তিনি। তবে একজন শিক্ষার্থীও তাতে রাজি হয়নি।
কারণ হিসেবে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, কারো ল্যাপটন নেইতো কারো স্মার্ট মোবাইল সেট নেই। আবার কারো ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা নেই তো কারো এলাকায় নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট ও বিদ্যুতের সমস্যা আছে।
এদিকে রাজশাহী প্রযু্িক্ত ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট) কর্তৃপক্ষ মে মাসের শেষের দিকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, নিজেদের সাড়ে ৪ হাজার শিক্ষার্থীদের পাঠদান কর্মসূচি অনলাইনে চালু রাখবে। জুনের শুরুর দিকে তারা কথা মতো এই কার্যক্রম শুরুও করেন। শিক্ষকরা বাড়িতে বসে অনলাইনে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ক্লাস শুরু করেন। তবে একটি করে ক্লাস নেয়ার পর শিক্ষার্থীদের তরফ থেকে জানানো হয়েছে তারা সকলে অনলাইন ক্লাসে সংযুক্ত হতে পারছে না। সমস্যা হিসেবে রাবি’র শিক্ষক যা উল্লেখ করেছেন একই প্রতিবন্ধকতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরাই বলছেন, শুধু ক্লাস নিলেই হবে না। এর সাথে জড়িত পরীক্ষা। অনলাইনে তা কতটুকু সম্ভভ হবে! তাছাড়া হাতেকলমে শিক্ষা বা ল্যাব ভিত্তিক শিক্ষার ক্ষেত্রে অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম কার্যকর হবে না।
অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালুর বিষয়ে রাবি’র লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর ডক্টর প্রণব কুমার পাণ্ডে পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, আমরা কি প্রস্তুত? আমার শিক্ষার্থীদের ৫০ শতাংশের হাতে ল্যাপটপ বা স্মর্ট ফোন সেট নাই। তাছাড়া মাস্টার্সে ৮টা কোর্স অনলাইনে শেষ করতে ডাটা বা ইন্টারনেটে ব্যয় হবে প্রায় তিন হাজার টাকা। একই সাথে প্রান্তিক পর্যায়ে নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট ও বিদ্যুতের সমস্যাতো রয়েছেই। আর আমাদের অনেক শিক্ষক এখন পর্যন্ত নিজেদের ইমেইলটাই ঠিকমতো চেক করতে জানেন না।
তিনি বলেন, সম্প্রতি আমি দেশের বাইরে একটি আন্তর্জাতিক অনলাইন সেমিনারে নিজ বাড়িতে থেকে সংযুক্ত হয়েছিলাম। করোনা পরিস্থিতির কারণে ভারচুয়াল সেমিনারের আয়োজন করা হয়। তবে এ দেশের ইন্টারনেট সংযোগ এতটাই দুর্বল যে শেষ পর্যন্ত আমাকে ভিডিও বন্ধ করে দিয়ে কনফারেন্সে কথা বলতে হয়েছে। কয়েকবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। এই হলো বাস্তবতা। একদিকে বলা হচ্ছে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালুর কথা অন্য দিকে মোবইল ইন্টারনেটের ওপর ভ্যাট বৃদ্ধি করা হচ্ছে!
এমন অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক মনে করেন, পরিস্থিতি উত্তরণে সরকারের তরফ থেকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আসতে হবে। শিক্ষা বোর্ড, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও শিক্ষামন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে সমন্বিত ভাবে এ উদ্যোগ নিতে হবে।
এদিকে কবে নাগাদ শিক্ষা ব্যবস্থা স্বাভাবিক হবে এমন প্রশ্নের উত্তরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য প্রফেসর ড. আনন্দ কুমার সাহা বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত আমি কোন শিক্ষার্থীকেই ইনভাইট (আমন্ত্রণ) করবো না। তবে অবস্থা বুঝে পর্যায়ক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। এখনই নির্দিষ্ট করে কোন তারিখ বলা যাবে না। এমন পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের পূর্বের কোন অভিজ্ঞতাও নাই।
লেখক- সাংবাদিক, দৈনিক সানশাইন