শহীদ জননী
অপূর্ব শর্মা : আলোর পথের অভিযাত্রী শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যু দিবস ছিল গতকাল। দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন তিনি আমাদেরকে ছেড়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।
১৯২৯ সালের ৩ মে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামে জাহানারা ইমাম জন্মগ্রহন করেন। তার পিতা সৈয়দ আবদুল আলী ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। তৎকালীন সময়ে রক্ষণশীল বাঙালি মুসলমান পরিবার বলতে যা বোঝায়, তাদের পরিবারও তেমনটি ছিল। তবে, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বাবা মেয়েকে শিক্ষিত করার ব্যাপারে খুবই আগ্রহী ছিলেন। বাড়িতে বাবার কাছেই তার শিক্ষা জীবনের শুরু। জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধিতে জাহানারা ইমামকে তার বাবা সবধরনের উৎসাহ, অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। সৈয়দ আবদুল আলীর কাছে আসা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা জাহানারা ইমামের মনোজগৎকে আলোকিত করে তোলে। কিশোরী জাহানারার পাঠতৃষ্ণা দেখে আবদুল আলীর বন্ধু যাকে জাহানারা ইমাম মটকা চাচা বলে ডাকতেন, সেই মটকা চাচা তাকে বেছে বেছে এমন সব বই উপহার দিতেন যা তার মেধা ও মননকে শাণিত করেছে।
আবদুল আলীর চাকুরির কারণে তাদের জায়গা বদল করতে হয়েছে অনেকবার। কিন্তু জাহানারা লেখা-পড়া চালিয়ে যেতে থাকেন নিষ্ঠার সাথে। ১৯৪২ সালে তিনি রংপুর থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন। দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন রংপুর কারমাইকেল কলেজে। এই কলেজ থেকে আইএ পাস করে ১৯৪৫ সালে ভর্তি হন কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে। সেখান থেকেই ১৯৪৭ বিএ পাস করেন।
১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএড করে ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন ডিগ্রি অর্জন করেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ পাস করেন।
তার কর্মজীবন শুরু হয় শিক্ষকতার মাধ্যমে। সহকারি শিক্ষিকা হিসেবে ১৯৪৮-১৯৪৯ পর্যন্ত তিনি ময়মনসিংহ-এর বিদ্যাময়ী গার্লস হাই স্কুলে কমর্রত ছিলেন। ১৯৫২ সালে ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৬০ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে শিক্ষকতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটে খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন তিনি।
রংপুরের মুন্সিপাড়ার মোহাম্মদ আলী উকিলের ছেলে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার শরীফুল আলম ইমাম আহমদের সঙ্গে ১৯৪৮ সালের ৯ অগাস্ট তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর ঢাকায় চলে আসেন তিনি। ১৯৫১ সালের ২৯ মার্চ জাহানারা ইমামের প্রথম সন্তান শাফী ইমাম রুমী জন্মলাভ করেন। তার দ্বিতীয় ছেলে সাইফ ইমাম জামীর জন্ম ১৯৫৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তার প্রথম সন্তান রুমী দেশকে শত্রুমুক্ত করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দুঃসাহসী গেরিলার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন তিনি। কয়েকটি সফল অভিযান পরিচালনার পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন রুমী। পাকবাহিনী তার উপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে তাকে হত্যা করে। জাহানারা ইমামের স্বামী শরীফুল ইমামকে ধরে নিয়ে গিয়ে তার উপর পাকিস্তানি হানাদাররা নির্মম নির্যাতন চালায়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে মুক্তি দেয়। কিন্তু বিজয় অর্জনের মাত্র তিনদিন পূর্বে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। স্বাধীনতার পর শহীদ রুমীকে বীরবিক্রম (মরণোত্তর) উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বিজয় লাভের পর রুমীর বন্ধুরা জাহানারা ইমামকে সকল মুক্তিযোদ্ধার মা হিসেবে বরণ করে নেন। সেই থেকেই তিনি ‘শহীদ জননী’ হিসেবে ভূষিত হন ৷
পুত্র শোক ও স্বামী হারানোর বেদনা নিয়ে স্বাধীন দেশে নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন তিনি। লেখক হিসেবেও লাভ করেন ব্যাপক পরিচিতি। প্রথমে তার অনুবাদ গ্রন্থ ‘তেপান্তরের ছোট্ট শহর’ প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে নিয়মিতই লেখালেখি চালিয়ে যান। তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২২টি। তন্মধ্যে পাঠকপ্রিয়তার শীর্ষে ‘একাত্তরের দিনগুলি’। স্বাধীনতা পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, রোকেয়া পদকসহ অসংখ্য পদকে ভূষিত হয়েছেন তিনি।
১৯৮২ সালে জাহানারা ইমাম আক্রান্ত হন দুরারোগ্য ব্যাধি ওরাল ক্যান্সারে। জীবনের সাথে যখন তিনি যুদ্ধ করছিলেন নিরন্তর, তখন দেশে ক্রমশ স্বাধীনতাবিরোধীদের উত্থান তাকে বিচলিত করে করে তোলে। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির এই উত্থানকে রুখতে মাথা উঁচু করে দাঁড়ান তিনি। হার না মানার সংকল্প করেন।
গোলাম আযমকে ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামীর আমির ঘোষণা করলে জনবিক্ষোভের সূচনা হয়। বিক্ষোভের অংশ হিসাবে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি ১০১ সদস্য বিশিষ্ট ‘ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠন করা হয়। এই সংগঠনের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন তিনি। এই সংগঠন যেন স্বাধীনতার পক্ষের লোকজনদের প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির দাবির প্রতি একাত্বতা পোষণ করে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রতিটি মানুষ। একই সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ৭০টি সংগঠনের সমন্বয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠিত হয়। এই কমিটিরও আহ্বায়ক নির্বাচিত হন তিনি। সারা দেশের লাখ লাখ মানুষ এই সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত হয়।
তার নেতৃত্বেই এই কমিটি ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ গণআদালতের মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গোলাম আযমের ঐতিহাসিক বিচার সম্পাদন করে। ১২ জন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত গণআদালতের চেয়ারম্যান শহীদ জননী জাহানারা ইমাম গোলাম আযমের ১০টি অপরাধ মৃত্যুযোগ্য বলে ঘোষণা করেন। সমবেত লক্ষ লক্ষ মানুষের পক্ষ থেকে জাহানারা ইমাম গণআদালতের রায় কার্যকর করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান।
দাবি বাস্তবায়নের পরিবর্তে সরকারের রোষানলে পড়েন জাহানারা ইমামসহ ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি। তৎকালীন সরকার জাহানারা ইমামসহ তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে অজামিনযোগ্য মামলা দায়ের করে। পরবর্তীতে হাইকোর্ট ২৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির জামিন মঞ্জুর করেন। আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ১০০ জন সংসদ সদস্য গণআদালতের রায়ের পক্ষে অবস্থান নিলে আন্দোলনে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। সারা দেশে গণসমাবেশ, মানববন্ধন, গণস্বাক্ষর, সংসদ যাত্রা, অবস্থান ধর্মঘট, মহাসমাবেশের কারণে সরকার বাধ্য হয়ে ১৯৯২ সালের ৩০ জুন সংসদে ৪ দফা চুক্তি করে। পরবর্তীতে তা আর কার্যকর হয়নি।
১৯৯৩ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে গণআদালত বার্ষিকীতে গণতদন্ত কমিটি ঘোষিত হয় এবং আরো ৮ জন যুদ্ধাপরাধীর নাম ঘোষণা করা হয়। এর দুইদিন পর ২৮ মার্চ নির্মূল কমিটির সমাবেশে পুলিশের নির্মম লাঠিচার্জে আহত হন জাহানারা ইমাম। এ কারনে দেশব্যাপী আন্দোলন এতটাই ব্যাপকতা লাভ করে যে, তা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। গোলাম আযমসহ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবির আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানায় ইউরোপীয় পার্লামেন্ট।
আন্দোলন সংগ্রামে কখন যে জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে দাঁড়িয়েছেন তা টেরই পাননি জাহানারা ইমাম। হটাৎ করে তার শরীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। চিকিৎসার জন্য ১৯৯৪ সালের ২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের ডেট্রয়েট নগরীর সাইনাই হাসপাতালে ভর্তির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন তিনি। ২২ এপ্রিল সেখানকার চিকিৎসকরা জানান, তিনি চিকিৎসার আওতার সম্পূর্ণ বাইরে চলে গেছেন। এসময় বাকশক্তি হারান এই মহিয়সী। তবে, নিকটজনদের সাথে কথা বলতেন চিরকুটের মাধ্যমে। ২৬ জুন সাইনাই হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুর পূর্বে হাসপাতালের বেডে শুয়ে দেশবাসীর উদ্দেশে জাহানারা ইমাম লিখেন- “সহযোদ্ধা দেশবাসীগণ, আপনারা গত তিন বছর ধরে একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমসহ স্বাধীনতাবিরোধী সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছেন। এই লড়াইয়ে আপনারা দেশবাসী অভূতপূর্ব ঐক্যবদ্ধতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। আন্দোলনের শুরুতে আমি আপনাদের সঙ্গে ছিলাম। আমাদের অঙ্গীকার ছিল লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত কেউ রাজপথ ছেড়ে যাবো না। মরণব্যাধি ক্যান্সার আমাকে শেষ মরণ কামড় দিয়েছে। আমি আমার অঙ্গীকার রেখেছি। রাজপথ ছেড়ে যাইনি। মৃত্যুর পথে বাধা দেবার ক্ষমতা কারো নেই। তাই আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি এবং অঙ্গীকার পালনের কথা আপনাদের আরেকবার মনে করিয়ে দিতে চাই। আপনারা আপনাদের অঙ্গীকার ও ওয়াদা পূরণ করবেন। আন্দোলনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে থাকবেন। আমি না থাকলেও আপনারা, আমার সন্তান-সন্তুতিরা- আপনাদের উত্তরসূরিরা সোনার বাংলায় থাকবেন।
এই আন্দোলনকে এখনো অনেক দুস্তর পথ পাড়ি দিতে হবে। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র ও যুবশক্তি, নারী সমাজসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই লড়াইয়ে আছে। তবু আমি জানি, জনগণের মতো বিশ্বস্ত কেউ নয়। জনগণই সকল শক্তির উৎস। তাই একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধী বিরোধী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ‘৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল সমন্বয় আন্দোলনের দায়িত্বভার আমি আপনাদের বাংলাদেশের জনগণের হাতে অর্পণ করলাম। জয় আমাদের হবেই।”
শহীদ জননী যে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, তা আজ অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌছেছে। যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের বিচার চলছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। ইতোমধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীরা। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তিকে তাই আজ ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। জাতিকে কলংকমুক্ত করতে এবং জাহানারা ইমামের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই।
সূত্র : বিডিনিউজ