ঢাকা ছাড়ার হিড়িক
মঈন বকুল : যে মানুষটির দিকে চেয়ে থাকে তার পরিবার ও নিকটাত্মীয়েরা সেই মানুষটি আজ অসহায়। চাকরি নেই, আয় উপার্জন নেই, বাসায় বসে আর কতদিন। জমানো টাকা ভেঙে খাওয়া, মাস শেষে বাসা ভাড়া, গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল, ইন্টারনেট-ডিশ বিলসহ জীবন ধারণের নানা খরচে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে জীবন।
রাজধানীর বুক জুড়ে আজ এমন মানুষের সংখ্যা অগণিত। দুবেলা দু-মুঠো আহারের সন্ধানে আসা অনেক মানুষই এখন ঢাকা ছাড়ছে। কোনো উপায়ান্তর না দেখে এক বুক কষ্ট নিয়ে গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন অনেকেই। কেউ কেউ আবার বাসা-বাড়ির আসবাবপত্র রেখেই পালিয়ে যাচ্ছেন নিজের জন্মাস্থানে।
দেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হয় এ বছরের ৮ মার্চ। ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর টানা ৬৬ দিন লকডাউন। এর মধ্যে অনেকেরই কোনো কাজ নেই। টানা তিন মাস আয় উপার্জন বন্ধ। বাড়িভাড়া বাকি। দেড় হাজার বর্গকিলোমিটারের এ নগরীর বাসিন্দার সংখ্যা প্রায় দুই কোটি, যাদের প্রায় ৮০ শতাংশই ভাড়া বাসার বাসিন্দা।
এ ভাড়াটিয়ারা বছরের পর বছর উপাজর্নের সিংহভাগ ভাড়া দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু করোনাভাইরাস পরবর্তী পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে বাসা ভাড়ার চিত্রও। করোনার কারণে অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছেন, অনেক মানুষের শ্রেণি কাঠামোর পরিবর্তন হয়েছে। নতুন করে অনেক মানুষ হতদরিদ্র হয়েছেন, আগের ভাড়ার ভার বইতে পারছেন না তারা, ফলে তারা বাসা খালি করে দিয়ে ছাড়ছেন স্বপ্নের ঢাকা।
ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ২ হাজার ৩৭১ জনের সাক্ষাৎকার নিয়ে ব্র্যাক মে মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। এতে দেখা যায়, ৩৬ শতাংশ লোক চাকরি বা কাজের সুযোগ হারিয়েছেন। ৩ শতাংশ লোক চাকরি থাকলেও বেতন পাননি। আর দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের ৬২ ভাগই কাজের সুযোগ হারিয়েছেন। করোনার কারণে ১০টি জেলার মানুষের আয় কমে গেছে। ঢাকা জেলার মানুষের আয় কমেছে ৬০ ভাগ।
রাস্তায় বের হলে দেখা যাচ্ছে, মানুষ ট্রাক বা পিকআপে করে বাড়ির জিনিসপত্র নিয়ে গ্রামের বাড়ি চলে যাচ্ছেন। তাদের চোখে মুখে হতাশা আর অসহায়ত্বের ছাপ। কারণ গ্রামে গিয়েই বা কী করবে। কোনো কাজ নেই, ব্যবসা বাণিজ্য নেই। এক কথায় বেকার থাকতে হবে। তবে বেকার থাকলেও একদিক দিয়ে স্বস্তি বাড়ি ভাড়ার যে বিশাল বোঝা সেটা আর থাকবে না।
রাজধানীর বিভিন্ন অলিগোলিতে দেখা যাচ্ছে, শুধু টু লেট আর টু লেট। এমন কম বাড়িই আছে যেখানে টু লেট টাঙ্গানো নেই। প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই এখন টু-লেট। বাসা বাড়ির মালিকদেরও চোখে মুখে হতাশার ছাপ। কারণ ঢাকায় অনেক বাসা মালিকদেরই বাসার ভাড়ার টাকা দিয়ে চলতে হয়। আবার অনেকেই বাসা ভাড়ার টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করেন। তাদের চোখে মুখে হতাশার ছাপ বেশি।
বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বাসা ভাড়া পাঁচ-ছয় মাস ধরে খালি থাকলেও এক টাকাও কমানোর কোনো নাম নেই। ছয়মাস আগেও যে ভাড়া ঠিক এখনো সেই ভাড়াই ধরে আছে মালিকরা। এ নিয়ে অনেক ভাড়াটিয়ারাই চটেছেন মালিকদের ওপরে। অভিযোগ রয়েছে, করোনার এই পরিস্থিতিতেও ভাড়াটিয়াদের প্রতি সহানুভূতি না দেখিয়ে ভাড়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করছেন অনেক বাড়ির মালিকরা। যে কারণে অনেকেই বাসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ বিষয়ক সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) একটি সমীক্ষা থেকে জানা যায়, ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ। একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ এই সময়ে নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ।
অন্য এক জরিপে দেখা যায়, ২৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ, ৫৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া প্রায় ৫০ শতাংশ, ১২ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ টাকা ব্যয় করেন বাসা ভাড়ায়।
বছরের পর বছর বাড়ি ভাড়া যে বেপরোয়াভাবে বেড়েছে, তাতে আয়-ব্যয়ে প্রকট অসামঞ্জস্যতা নিয়ে থাকতে হয়েছে লোকজনকে। এখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ায় নিরূপায় হয়ে মানুষ ঢাকা ছাড়ছে, তাতে তৈরি হচ্ছে ভাড়াটিয়া সংকট। এই সংকট সামনের দিনগুলোতে আরও প্রকট হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
প্রাণঘাতি করোনাভাইরাসের আঘাতে বর্তমানে দেশে এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে, মানুষকে মৃত্যুচিন্তা গ্রাস করেছে। চারিদিকে কর্মহীন মানুষের হাহাকার। ক্ষুধার্ত মানুষের আহাজারি। ঢাকা ছাড়ার মিছিলে প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছেন অনেকেই।
এ পরিস্থিতিতে আমাদের সকলের এগিয়ে আসা উচিত। বাসা মালিকদের একটু সহনশীল হওয়া উচিত, একটু মানবিক হওয়া উচিত। আসুন সরকারের পাশাপাশি আমরা যারা সামর্থবান আছি তারা সবাই অসহায়দের পাশে দাঁড়ায়।
লেখক- সাংবাদিক, একুশে টেলিভিশন