মৃতের সঙ্গে জীবিত মানুষের দেয়া হয় ‘ভূত বিয়ে’

প্রকাশিত: ২৮-০৬-২০২০, সময়: ১৬:১৫ |

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : বিয়ে নারী পুরুষের একটি বৈধ সামাজিক বন্ধন। ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি ভেদে বিয়ের ধরণ, আচার-অনুষ্ঠানের ভিন্নতা থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে মৃত ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ের কথা শুনলে হয়তো অনেকেই অবাক হবেন।

মৃত ব্যক্তির ‘ভূত বিয়ের’ প্রথা প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত ছিল। এখনো কয়েকটি দেশে অবিবাহিত মৃত ব্যক্তিদের বিয়ে দেয়া হয়। অদ্ভুত এই বিয়ের রীতি নিয়েই এই লেখা।

ভূত বিয়ের ঐতিহ্য প্রায় ২৫০০ বছরের পুরাতন। চীনের প্রথম রাজ বংশের সময় থেকে এই অদ্ভুত বিয়ের রীতি শুরু হয়েছিল বলে জানা যায়। চীনের প্রথম রাজবংশ কিন। খ্রিষ্টপূর্ব ২২১ অব্দ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ২০৬ অব্দ পর্যন্ত কিন রাজবংশ শাসন করেছে। তবে ভূত বিয়ের রীতি বিস্তৃতি লাভ করে হান রাজবংশের সময় বলে মনে করা হয়।খ্রিষ্টপূর্ব ২০৬ অব্দ থেকে ২২০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তাদের শাসনকাল ছিল।

অনেকের হয়তো মনে হতে পারে ভূত বিয়ের রীতি প্রচলিত হওয়ার কারণ কী ছিল? অদ্ভুত সব রীতি-নীতি কিংবা ঐতিহ্য প্রচলিত হয়েছে সাধারণত কোনো বিশ্বাস থেকে। সেটা ধর্মীয় কিংবা সামাজিক বিশ্বাস হতে পারে। তবে এসব অচার অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য থাকে স্বীয় গোষ্ঠীর জীবিত কিংবা মৃত মানুষের মঙ্গল কামনা।

চীনের ভূত বিয়ের ঐতিহ্য প্রচলনের ক্ষেত্রেও তেমনই একটি উদ্দেশ্য ছিল। মৃত ব্যক্তির পরকালে সঙ্গীর ব্যবস্থার জন্য ভূত বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়। তারা মনে করত কোনো পুরুষ বা নারী যদি অবিবাহিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে তাহলে পরকালে তাদের স্বামী বা স্ত্রীর ব্যবস্থা করা উচিত।

এতে মৃত পুরুষ বা নারীর সঙ্গীর ব্যবস্থা হবে এবং তার পরিবারের জীবিত সদস্যদেরও মঙ্গল হবে। ভূত বিয়ের সর্বাধিক প্রচলিত রীতি ছিল একজন মৃত পুরুষকে মৃত নারীর সঙ্গে বিয়ে দেয়া। এক্ষেত্রে জীবিত অবস্থায় তাদের বিয়ে ঠিক ছিল কিনা সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। মৃত অবিবাহিত পুরুষ কিংবা নারীর পরকালে সঙ্গীর ব্যবস্থা করা ভূত বিয়ের মুখ্য উদ্দেশ্য থাকলেও শুধু এটিই একমাত্র কারণ ছিল না।

কিংবদন্তী অনুসরে, যদি কেউ অবিবাহিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে এবং যথাযথ ভূত বিয়ের ব্যবস্থা না করা হয় তবে তার আত্মা পরিবারের জীবিত সদস্যদের আশেপাশেই থাকে। যথাযথ ভূত বিয়ের আয়োজন না করা পর্যন্ত সে থেকেই যায়। মৃত ব্যক্তির আত্মা তাদের পরিবারের সদস্যদের থাকার সময় তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মধ্যে থাকে বলে তাদের বিশ্বাস।

সুতরাং ভূত বিয়ের ব্যবস্থা শুধু মৃতদের জন্যই করা হতো না। কখনো তা পরিবারের জীবিত সদস্যদের জন্য আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ভূত বিয়ে শুধু মৃত নারী এবং পুরুষের মধ্যেই যে হতো তাও কিন্তু না। কোনো পুরুষ যদি অবিবাহিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করত এবং তার বাগদত্তা থাকলে সেই নারীকে ভূত বিয়ে করতে হতো।

সে নারী কোনো প্রতীক কিংবা অন্য কোনো ব্যক্তি তার স্থানে রেখে এ বিয়ে সম্পন্ন হত। মৃত ব্যক্তির পরিবার মেয়েটির সুরক্ষার ব্যবস্থা করত। এটি প্রাচীন চীনা সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ রীতি ছিল। তবে একজন নারী অবিবাহিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে জীবিত পুরুষের সঙ্গে তার ভূত বিয়ের রেওয়াজ ছিল না।

চীনে প্রাচীনকাল থেকেই ভূত বিয়ের রীতি প্রচলিত ছিল। তবে পরবর্তীতে অন্য কয়েকটি দেশেও এই রীতি প্রচলিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্সেও একই রকম রীতি প্রচলিত হয়েছিল। বিশ্বযুদ্ধে অসংখ্য নারীর বাগদত্তা পুরুষ মৃত্যুবরণ করেছিল। এসব নারীরা তখনো তাদের বিয়ে করতে ইচ্ছুক ছিল। ফলে এভাবেই মৃত ব্যক্তির সঙ্গে কাল্পনিক বিয়ে হয় তাদের।

প্রায় ৪০ বছর ফ্রান্সে এই রীতি প্রচলিত থাকার পর স্থগিত হয়ে যায়। তবে স্থগিত হয়ে যাওয়ার কয়েক বছর পরে, এক নারীর বাগদত্তা দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করে। এই নারী কর্তৃপক্ষের কাছে মৃত বাগদত্তাকে বিয়ের অনুমতি চায়। সে অনুমতি পেয়েছিল এবং রীতিটি ‘মরণোত্তর বিবাহ’ নামে পরিচিত লাভ করে।

এরপর থেকে এই রীতি ফরাসি বিবাহ আইনের অধীনে সংরক্ষিত হয়েছে। এখনো বিভিন্ন কারণে ফ্রান্সে মৃত ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ের অনুমতি দেয়ার নিয়ম আছে। বিশ্বের বেশ কয়েকটি উপজাতি সংস্কৃতিতে ভূত বিয়ের প্রথা প্রচলিত আছে।

সুদানের নুয়ের উপজাতি এর মধ্যে অন্যতম। তাদের রীতিটি বেশ অদ্ভুত। নুয়ের উপজাতির বাগদত্তা পুরুষটি মৃত্যুবরণ করলে সাধারণত তার ভাই প্রতীকী পাত্র হিসেবে বিয়েতে অংশগ্রহণ করে। জীবিত ভাই মৃত ভাইয়ের পক্ষে ভূত বিয়ের আচার অনুষ্ঠান পালন করে। এই স্ত্রী তার মৃত ভাইয়ের স্ত্রী হিসেবেই স্বীকৃত হয়। তবে সে প্রতীকী পাত্র হলেও ‘ভাইয়ের স্ত্রীর’ সঙ্গে বাস্তবে সংসার করে। যদি তাদের সন্তান জন্মগ্রহণ করে তাহলে সেই সন্তান মৃত ব্যক্তির বংশধর হিসেবে বিবেচিত হয়।

প্রাচীন চীনে উদ্ভূত মৃত ব্যক্তির ভূত বিয়ের রীতি ১৯৪০এর দশকের শেষের দিকে চীনে নিষিদ্ধ করা হয়। তবে চীনের কয়েকটি প্রদেশের গ্রামাঞ্চলে এই রীতি এখনো পালিত হয়। ভূত বিয়ের রীতি পালনের জন্য কবর থেকে মৃত দেহ চুরি হওয়ার নিদর্শন আছে। বিশেষ করে নারীদের মৃতদেহ চুরি হয়।

২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে চীনের শানজি প্রদেশের হ্যাংটন কাউন্টিতে কয়েক ডজন নারীর মৃতদেহ চুরি হয়। অবিবাহিত মৃত পুরুষের বিয়ে দেয়ার জন্য তার পরিবার এসব চুরি হওয়া নারী মৃতদেহ চড়া দামে কেনে। একবার একটি পরিবার এক লাখ ৮০ হাজার উয়ান দিয়ে মৃতদেহ কিনেছিল বলে জানা যায়। নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও অনেকে মৃতদের বিয়ে দেয়ার কাজ পেশা হিসেবেও গ্রহণ করেছে।

উপরে