শতকোটি টাকার বইকেনায় অস্বচ্ছতা এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি আবেদন
সালেক খোকন : দেশের বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু কর্নারের জন্য কেনা হচ্ছে দেড়শ’ কোটি টাকার বই। মুজিববর্ষ উপলক্ষে বইগুলো কিনছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। এটি খুবই সম্ভাবনার কথা, আশার কথা ও আনন্দের কথা।
কিন্তু সরকারের এমন ভাল উদ্যোগ কেন নিঃশব্দে কার্যকর হচ্ছে? সেটি বোধগম্য নয়। সরকারের এই মহৎ কাজটির কথা আমরা জানতে পারি দেড়শ কোটি টাকার বইকেনার অস্বচ্ছ ও বির্তকিত প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পর।
বইকেনায় স্বচ্ছতা নিয়ে আলোচনার আগে কেন বিদ্যালয়গুলোতে বঙ্গবন্ধু কর্নার প্রয়োজন তা খানিকটা তুলে ধরছি।
১৯৭৫-এর ১৫ অগাস্টের কালরাতে বঙ্গবন্ধুকে পরিবারের বহু সংখ্যক সদস্যসহ হত্যা করা পর দেশ চলতে শুরু করে উল্টোপথে। পঁচাত্তর পরবর্তীতে থেকে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত প্রজন্মগুলোর কাছে মুক্তিযুদ্ধের ভুল ইতিহাস তুলে ধরা হয়। সে ইতিহাসে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তখন প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুর নাম ও জয়বাংলা উচ্চারণও করা যেত না। ফলে কয়েক প্রজন্ম ভুল ইতিহাস জেনে বড় হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বীরত্ব ও গর্বের ইতিহাসটিকেও বির্তকিত করা হয়েছে নানাভাবে। শুধু তাই নয়, বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে সারাদেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের দলিল ও একাত্তরের গণহত্যার অনেক প্রামাণ্যও ধ্বংস করা হয় সুকৌশলে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে আনা ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণার কাজ করা তখন ছিল রীতিমত ভয়ের বিষয়। কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয় নিয়ে কাজ করার এক অভয় ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। ফলে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে লেখক, প্রকাশক ও পাঠকদের আগ্রহ বেড়েছে শতগুণ।
কেমন দেশ চেয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব? সেটি অনুমান করা যায় তার নানা বক্তব্য বিশ্লেষণে। এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন এভাবে- ‘আমি চাই আমার বাংলার মানুষ বাঁচুক। আমার বাংলার মানুষ পেটভরে ভাত খাক। আমার বাংলার মানুষ শান্তি পাক। আমার বাংলার মানুষেরা মিথ্যাবাদী না হোক। আমার বাংলার মানুষ সুখী হোক। আমার বাংলার মানুষ সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করুক।’
তার পুরো জীবনের স্বপ্ন ছিল দু:খী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো, সোনার বাংলা গড়ে তোলা। আর সোনার বাংলা গড়তে প্রয়োজন সোনার মানুষের। তাই বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস প্রজন্মকে জানানো জরুরী। শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, এই মহান নেতাকে তুলে ধরতে হবে সর্বজনীনভাবে।
তাই বঙ্গবন্ধুর জীবনী, নেতৃত্ব, উদ্যোগ ও দর্শনের কথা ছড়িয়ে দিতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমে বিদ্যালয়গুলোতে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত বই নিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু কর্নার’ করার কাজটি নিঃসন্দেহে সরকারের প্রশংসনীয় একটি উদ্যোগ।
১৭ মার্চ ২০২০ থেকে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত সময়কালকে দেশব্যাপী ‘মুজিববর্ষ’ হিসেবে পালন করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে অনানুুষ্ঠানিকভাবেই যা পালিত হচ্ছে সারাদেশে। প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত লেখক, প্রকাশক ও অন্যান্যরাও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই।
এবারের ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০’-কে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে উৎসর্গ করা হয়েছে। ‘মুজিববর্ষ’ কে ঘিরে প্রকাশকরা বিপুল অর্থ ব্যয় করে লেখক, গবেষক, কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার ও ঔপন্যাসিকদের লেখা বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বহু বই ইতিমধ্যে প্রকাশ করেছেন। লেখালেখি ও গবেষণায় যা নতুন ক্ষেত্র ও সম্ভবনা তৈরি করবে বলে ধারণা ছিল।
কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে বইগুলোই সারাদেশে বিপণন করতে না পারায় ও সবকিছু বন্ধ থাকায় সেই সম্ভবনাটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। এরই মধ্যে ব্যয় নির্বাহ করতে না পারায় ঢাকার বই বিপণী দীপনপুর, পেন্সিল, কবিতা ক্যাফেসহ বেশ কয়েকটি প্রকাশনী সংস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে সীমিত পরিসরে সবকিছু খুলে দেওয়া হলেও বই বিক্রির পরিমাণ তেমন বাড়েনি। এ অবস্থা চলতে থাকলে বন্ধ হয়ে যাবে আরও শতাধিক প্রকাশনা সংস্থাও। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে লেখক, প্রকাশক, প্রচ্ছদ শিল্পী এবং মুদ্রণ ও বাঁধাই কাজে যুক্ত হাজার হাজার শ্রমিক। এতে ঝুঁকিতে পড়বে শিল্প-সাহিত্যের মানুষেরাও।
কোভিড-১৯ এর মহামারীতে প্রকাশনা শিল্পকে বাঁচাতেও সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব?
প্রকাশকদের সংগঠন বা সমিতির নেতাদের ভাষ্য- শুধু প্রণোদনা নয়, সরকার বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বইকেনার উদ্যোগ নিয়ে সারাদেশে তা ছড়িয়ে দেওয়ার নিশ্চয়তা ও ব্যবস্থা করলেই এই শিল্প ঘুরে দাঁড়াবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেই একজন সুলেখক। তাই তাদের আশা প্রকাশনা শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে তিনি নিশ্চয়ই উদ্যোগী হবেন।
কিন্তু সেই আশার আলোকে ম্লান করে দিয়ে এলো দেড়শ কোটি টাকার বইকেনার খবরটি। যার প্রক্রিয়াটি চলে পুরোপুরি প্রকাশক ও লেখকদের অন্তরালে রেখেই।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বলছে, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর দেড়শ কোটি টাকার বইকেনায় কোন প্রকার দরপত্র বা বিজ্ঞপ্তি দেয়নি। গ্রন্থাগার অধিদপ্তর, জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে প্রক্রিয়ায় বই নির্বাচন ও ক্রয় করেন- সেটি এখানে অনুসরণ করা হয়নি। কয়েকটি প্রকাশনীর (যাদের নাম আলোচিত হলেও তথ্যসূত্র না থাকায় উল্লেখ করা হলো না) বই ক্রয় তালিকায় থাকার খবর থাকলেও বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশনী সমিতির অধিকাংশ প্রকাশকদের নিকট থেকে কোনো বই বা তালিকা চাওয়া হয়নি। এটি নিশ্চিত করেছেন জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশনী সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদ।
বঙ্গবন্ধু কর্নারের জন্য নির্বাচিত বই প্রতিটি কেনা হবে ৬৫ হাজার কপি। এমন খবরে লেখক-প্রকাশরা যেমন হতাশ হয়েছেন তেমনি সরকারি দপ্তরের উদ্যোগ ও স্বচ্ছতা নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠেছে। প্রকাশকরা বলছেন, এতে গুটিকয়েক লেখক-প্রকাশক লাভবান হলেও বৃহৎ সংখ্যক লেখক-প্রকাশক যারা বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বই প্রকাশ করেছেন তারা বঞ্চিত হবেন। সরকারের উচিত বই ক্রয়ের পূর্বে সকল প্রকাশকের নিকট থেকে বঙ্গবন্ধু বিষয়ক বই আহ্বান করা এবং মানবিচার করেই তা কেনা। এতে বিষয় বৈচিত্র্য যেমন থাকবে তেমনি সরকার বই কিনলে অধিক সংখ্যক লেখক-প্রকাশক বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা ও বইপ্রকাশে আরও উৎসাহিত হবে।
তাই বঙ্গবন্ধু কর্নারের জন্য একটি বই এতো অধিকসংখ্যক না কিনে অন্যান্য প্রকাশকদের বইও মান বিবেচনায় ক্রয় করা উচিত বলে মনে করেন অনেকেই।
এছাড়া প্রশ্ন উঠেছে- প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিশুদের কাছে বঙ্গবন্ধু ও তার আদর্শকে তুলে ধরতে কোন ধরনের বই রাখা প্রয়োজন- সেটি কীভাবে নির্ধারিত হয়েছে, এ বিষয়ে কেন জানেন না লেখক-প্রকাশকরা। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত বই বাছাইয়ে কোন কমিটি কাজ করেছে, সেখানে শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক, প্রকাশক প্রতিনিধি ছিল কিনা- তাও অদ্যাবধি পরিষ্কার করেনি অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়!
বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য না থাকায় সরকারের এমন মহৎ উদ্যোগটি নিয়ে নানা নেতিবাচক সমালোচনারও সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু কর্নারের জন্য বইকেনা প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনার উদ্যোগ নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর আবেদন করেছেন বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি। এরইমধ্যে দেড়শ কোটি টাকার বইকেনায় স্বচ্ছতার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন হাসান আজিজুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, মুনতাসীর মামুন, রামেন্দু মজুমদার, সেলিনা হোসেন, আবুল মোমেন, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ইমদাদুল হক মিলনসহ দেশবরেণ্য পনেরজন বিশিষ্ট লেখক।
কেউ কেউ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের লেখা বই বঙ্গবন্ধু কর্নারের জন্য কেনা হচ্ছে জানিয়ে বইকেনার অস্বচ্ছতার আলোচনায় তা সামনে ঠেলে দিচ্ছেন। দেড়শ কোটি টাকার বইকেনার বৈধতা পেতে যা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সে কারণেই আমরা মনে করি এক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ বিশেষ প্রয়োজন।
জাতির জনকের আদর্শকে প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে ভালো ও মানসম্পন্ন বই থাকুক বঙ্গবন্ধু কর্নারে। বইগুলো নির্বাচিত করা হোক স্বচ্ছতার মাধ্যমে। সেখানে যুক্ত থাকুক শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক, প্রকাশক ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ন্যায়ের পক্ষে ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করে গেছেন। তাই আমরাও চাই বঙ্গবন্ধু কর্নারের জন্য বইকেনায় কোনও বির্তক না থাকুক। বঙ্গবন্ধু কন্যা কোনো অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার পক্ষে থাকেন না। তাই তার হস্তক্ষেপেই শতকোটি টাকার বইকেনায় স্বচ্ছতা আসবে, লেখক-প্রকাশকদের পাশে তিনি দাঁড়াবেন- এমনটাই আমাদের বিশ্বাস।
সূত্র : বিডিনিউজ