মাথাপিছু আয়ের প্রহেলিকা ও সম্পদের বৈষম্য
সাইফুল হোসেন : ধরি একটা দ্বীপে ১০০ লোক বসবাস করে। তাঁদের সর্বমোট বার্ষিক আয় ৫ লক্ষ টাকা। যদি আমরা তাঁদের আর্থিক অবস্থা জানার জন্য তাঁদের মাথাপিছু আয়ের হিসেব করি তাহলে ৫ লক্ষ টাকাকে জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করবো। দেখবো যে তাঁদের প্রত্যেকের এক বছরের আয় হচ্ছে ৫০০০ টাকা (৫০০০০০/১০০)। দেখে মনে হয় যে একটা দ্বীপে একজনের আয় যদি ৫০০০ টাকা হয় তাহলে মন্দ নয়। কিন্তু এবার যদি আপনি জানতে পারেন যে দ্বীপটিতে ছোট একটা প্রশাসন আছে যেখানে চারজন কর্তাব্যক্তি আছেন এবং তাঁদের অধিকারেই আছে বার্ষিক আয়ের ৪ লক্ষ টাকা। তাহলে চিত্র পাল্টে যাবে। ৪ জনের মাথাপিছু আয় হবে এক লক্ষ টাকা এবং বাকি ৯৬ জনের মাথাপিছু আয় হবে ১০৪১ টাকা মাত্র। তাহলে মাথাপিছু আয়ের হিসাব এই দ্বীপটিতে বসবাসরত জনগণের জীবনযাত্রার অবস্থা বোঝাচ্ছে না কোনভাবে। সম্পদ কত আছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ বটে তবে তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কার অধিকারে সম্পদ কতটুকু আছে এবং কে কতটুকু সম্পদ তার ইচ্ছানুযায়ী ব্যবহার বা ভোগ করতে পারছেন সেটা। আর এখানেই আসে সম্পদ বণ্টনের বিষয়টি। অর্থনীতিতে সম্পদ অর্জনের চেয়ে সম্পদের বণ্টন অধিক গুরুত্বের দাবি রাখে। মাথাপিছু আয় একটা দেশের অর্থনীতির আকার কতটুকু সেটা বুঝতে সাহায্য করে কিন্তু লোকজন কেমন আছেন, তাঁরা সবাই ভাল আছেন কিনা সেটা বুঝতে সহায়তা করে না যদি না আমরা জানতে পারি তাঁদের কার অধিকারে কতটুকু ভোগযোগ্য সম্পদ আছে।
বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১৯৭২ সালে ছিল প্রায় ১২৯ ডলার যা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ১৯০৯ অর্থাৎ স্বাধীনতার ৪৮ বছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় অন্তত ১৬ গুণ বেড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়াবে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলারের বেশি। ওই সময়ে হতদরিদ্রের হার কমে শূন্যের ঘরে নেমে আসবে। আর মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হবে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নে ‘বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে।
আমরা ইতোমধ্যেই জানি শুধু মাথাপিছু আয় নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের অন্যান্য সূচকেও বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে যদিও নভেল করোনা ভাইরাস সব হিসাব নিকাশ উল্টোপাল্টা করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।
আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি এই মহামারি শেষ হয়ে যাবে এবং সারাদেশে পূর্ণ উদ্যমে মানুষ কাজ শুরু করবে এবং এই বছরের মধ্যে অর্থনৈতিক কার্যক্রম তার আগের গতি ফিরে পাবে। আমরা জানি মার্চ থেকে কার্যক্রম বন্ধ প্রায় এবং এখন সীমিত আকারে শুরু হয়েছে যদিও কোথাও কোথাও লকডাউন চলছে অল্প পরিসরে।
প্রশ্ন হচ্ছে মাথাপিছু আয় বেশি থাকলেই কি মানুষ ভাল থাকেন নাকি সম্পদের সুষম বণ্টন মানুষকে স্বস্তি দিতে পারে?
কার্ল মার্ক্স শিখিয়েছেন কিভাবে পুঁজি পুঁজিকে আকর্ষণ করে এবং কিভাবে শ্রমজীবীরা পুঁজিপতিদের হাতে শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হন। আমাদের দেশে একটা মিশ্রিত অর্থনীতির চর্চা হয়।এটা পুঁজিবাদী অর্থনীতির সর্বোচ্চ ধাপ নয় ঠিকই কিন্তু পুঁজির সঞ্চালন, পুঁজির আহরণ ও একত্রীভবনের প্রক্রিয়া একটি শক্তিশালী পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের মতই। তাছাড়া সুশাসনের অভাব, অন্যায়, দুর্নীতি, জবাবহীনতা, স্বজনপ্রীতি, মিথ্যাচার, অপচয় ও রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগতখাতে অসৎ-অদক্ষতা, পুঁজির অন্যায় আহরণকে তরান্বিত করেছে, করছে। ফলে বাড়ছে বৈষম্য। অল্প কিছু লোকের হাতে সিংহভাগ সম্পদ। এই সম্পদ সুস্থ ও নিয়মতান্ত্রিক সামাজিক কাঠামোর মধ্যে থেকে ন্যয়-নিষ্ঠভাবে উপার্জন করলে সমস্যা প্রকট হতো না। দেখা যায় সমাজের একটা শ্রেণীর উত্থান হয়েছে যারা সরাসরি উৎপাদনের সংগে সম্পৃক্ত নয় কিন্তু উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে যারা সম্পৃক্ত তাঁদের কাছ থেকে অযৌক্তিক ও অন্যায্যভাবে সম্পদের আহরণ করছে এবং সেই প্রক্রিয়ায় তাঁরা সহায়তা পাচ্ছেন এমন একটা শ্রেণীর কাছ থেকে যারা কোন না কোন ভাবে ক্ষমতার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত।
বাংলাদেশেআয় বৈষম্য বাড়ছে দ্রুত। অর্থনীতিবিদদের মতে, গেল ১০ বছরে আয় বৈষম্য বেড়েছে ১০ থেকে ১৬ শতাংশ। কোনো দেশের আয়-বৈষম্য কতটা তা পরিমাপ করা হয় গিনি সহগ দিয়ে। গিনি সহগের মান শূন্য হলে বোঝায় যে, দেশের সকলের মধ্যে চরম সমতা বিরাজ করছে; আর এর মান বাড়তে বাড়তে শূন্য দশমিক পাঁচ (০.৫) বা বেশি হলে বোঝায় যে, দেশে আয়-বৈষম্য চরমতম অবস্থায় পৌঁছেছে।
পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৭৪ সালে দেশে গিনি সহগের মান ছিল ০.২৪। ২০১০ সালে তা বেড়ে হয়েছিল ০.৪৫৮। ২০১৬ সালে তা আরও বেড়ে হয়েছে ০.৪৮৩। ২০১৬ সালে দেশে সবচেয়ে ধনী ১০% পরিবারের হাতে ছিল আয়ের ৩৮.১৬%। এ সময় সবচেয়ে সম্পদশালী ৫% পরিবারে আয় বেড়ে হয়েছে ২৭.৯%, যেখানে সবচেয়ে গরিব ৫% পরিবারে আয় কমে হয়েছে ০.২৩% মাত্র। আয়-বৈষম্যের এ চিত্র শহরের চেয়ে গ্রামে আরও বেশি তীব্র। এ সময় গ্রামাঞ্চলে গিনি সহগ ০.৪৩ থেকে ০.৪৫-এ এবং শহরাঞ্চলে ০.৪৫ থেকে ০.৫-এ বর্ধিত হয়। গবেষকেরা মনে করেন, বাংলাদেশে যেহেতু গবেষণার সময় ধনী পরিবারগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না, সেহেতু বৈষম্যের সত্যিকার চিত্র আরও ভয়াবহ বলে অনুমান করা অসঙ্গত নয়।
তথ্যানুসারে গেল তিনচার বছরে ৭ শতাংশের ওপরে রয়েছে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার। অতি দারিদ্র্যের হার নেমে এসেছে ১০.৫০শতাংশে (কোভিড পূর্ববর্তী সময়ে)। তবে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হলেও এ সুবিধা ভোগ করছেন খুব কম সংখ্যক মানুষ। দেশে ধনী আরো ধনী হলেও, দরিদ্রের হাতে অর্থ থাকছে না। বিভিন্নভাবে দরিদ্র লোকের হাত থেকে টাকা সিঞ্চিত হয়ে চলে যাচ্ছে ধনীদের পকেটে, ফলে আয়-বৈষম্য বাড়ছেই।
এখানে বলা সমীচীন নয় যে মাথাপিছু আয় বাড়ার কারনে আয়-বৈষম্য বাড়ছে বরং বলা উচিত হবে যে আয়ের যেহেতু যথাযথ বণ্টন নিশ্চিত হচ্ছে না সেহেতু আয় বর্ধনের যে সুফলতা সর্বস্তরের জনগন পাচ্ছে না।তাই মাথাপিছু আয়বৃদ্ধির এই চিত্রকল্পে বেশি পুলকিত হবার যেমন বিশেষ কোন কারন নেই তেমনি দেশের মানুষের জীবনমাণ অনেক এগিয়ে গেছে এটা ভেবে আত্মপ্রসাদে ভোগার সুযোগ নেই। তাহলে আমাদের করনীয় কি? আমাদের যারা রাষ্ট্রযন্ত্র চালান তাঁদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাঁরা কেমন রাষ্ট্র চান, যদি চান রাষ্ট্রের কিছু লোক আর্থিকভাবে ভাল থাকবেন তাহলে যেভাবে চলছে তাতে তাঁরা ভালোই আছেন, সমাজের মুষ্টিমেয় কিছু লোক সম্পদের সিংহভাগের মালিকানায় আছেন যদিও সামগ্রিকভাবে সবাই কমবেশি ভাল না থাকলে আজ যারা ভাল আছেন কাল তাঁরাও ভাল থাকবেন সেই নিশ্চয়তা থাকবে না। আর যদি চান সামাজিক সুবিধা সম্বলতি একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ তাহলে অর্থ ও সমাজের অন্যান্য সুবিধাদি সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন রাষ্ট্র যদি শুধু কৃষকের পণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে পারে তাহলে সমাজের একটা বৃহৎ গোষ্ঠীর হাতে অনেক টাকার প্রবাহ হবে। গ্রামের ৫ টাকা দামের এক কেজি বেগুন শহরে ৪০ টাকায় বিক্রয় হয়। কৃষক যদি অর্ধেক অর্থাৎ ২০ টাকাও পেত তাহলে তাদের বঞ্চনার পরিমাণ কমে আসতো। কিন্তু সেটি হচ্ছে না অথচ শুধু সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহার করে সহজেই কাজটি করা সম্ভব।
আমাদের মনোযোগ দিতে হবে দেশের সার্বিক কল্যাণে, দেশের মানুষের সামগ্রিক অবস্থার উন্নতির দিকে। সমাজের এক অংশ অন্য অংশকে শোষণ করবে, বঞ্চিত করবে, সমাজের সম্পদ কার্যত লুট করবে এবং এই প্রক্রিয়া সর্বদা চলমান থাকবে তাহলে সমাজে সম্পদের পাহাড় গড়ে উঠলেও সেই সম্পদ মানুষের কল্যাণে কাজে আসবে না, অর্থনীতির আকার বড় হবে, সামস্টিক আয়কে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে দেখা যাবে মাথাপিছু আয় বাড়বে কিন্তু মানুষের জীবনযাপনের গুণগত পরিবর্তন হবে না, বৈষম্য বাড়তেই থাকবে। সামগ্রিক অর্থনীতি হয়ে পড়বে লুটেরা অর্থনীতি, অসম অর্থনীতি, কতপয় মানুষের অন্যায্য-কল্যাণে ব্যাপৃত অর্থনীতি। তাই অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের নজর দিতে হবে মানুষের অধিক কল্যাণে, মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধি তাঁদের জীবন মানের প্রকৃত নির্দেশক নয়।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক, ফাউন্ডার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশীপ ইন্টারন্যাশনাল
সূত্র : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড