বিবেকের দায়ভার কার?
সরকার দুলাল মাহবুব : কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কথা মনে দারুণ নাড়া দিচ্ছে আজ। তিনি দুঃখভরে লিখেছিলেন, ‘সাত কোটি বাঙালিরে হে মুগ্ধ জননী রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি’।
হুমায়ূন আহমেদ একটি প্রসঙ্গে লিখেছেন, কিছু কিছু মানুষ সত্যি খুব অসহায়। তাদের ভালোলাগা মন্দলাগা, ব্যথা বেদনাগুলো বলার মত কেউ থাকে না। তাদের কিছু অব্যক্ত কথা মনের গভীরেই রয়ে যায়, আর কিছু কিছু স্মৃতি- এক সময় পরিনত হয় দীর্ঘশ্বাসে।
মনে খুব পীড়া। কিছু কথা বলে এ পীড়া দূর করার চেষ্টা করি। করোনা ভাইরাস কালের সংকট নিয়ে কথা। আমাদের নিয়ে আমাদের কিছু কথা। করোনা সংকটে এমনিতেই দেশে বেকারত্ব আশঙ্কাজনক ভাবে বেড়ে গেছে। অনেকটাই সীমিত হয়ে পড়ছে কাজের ক্ষেত্র। দারিদ্রতা বেড়ে যাওয়ার ভয়ঙ্কর এক ভবিষ্যতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আজ দেশ ও জাতি।
এ সময়টাতে ঠিক মনুষ্যত্ব ও বিবেক নিয়ে ভাবতে হচ্ছে সরকারকে, দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের। কিন্তু করোনা ভাইরাস মোকাবেলার এই চরম দুর্দিনেও বিবেক নাড়া দিচ্ছে না কতিপয় ব্যক্তির। দুয়ারে মৃত্যু দাঁড়িয়ে জেনেও দুর্নীতির মায়াজাল থেকে তারা বের হতে পারছেন না। কিন্তু তাদের মতো কতিপয় মানুষের কর্মকান্ডে পুরো জাতি আজ প্রশ্নবিদ্ধ। এসব মানুষের কাছে আমজনতা বড় অসহায়।
ভাবতে কষ্ট লাগে, করোনা ভাইরাসের ভুয়া রিপোর্ট বিক্রি হচ্ছে। করোনা সুরক্ষা সামগ্রী কেনা-কাটা নিয়ে স্বাস্থ্য দপ্তরের দুর্নীতি খতিয়ে দেখতে তদন্তে নেমেছ দুদক। বলতে পারেন, আরও কতটা নিচে নামবো আমরা।
করোনা ভাইরাসের এই মহাদুর্যোগের মধ্যে যে যার মত ফাইদা লুটার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর আমরা তো আমজনতার দলেই। জনতার একটি শ্রেণি যারা শ্রমিক হিসাবে প্রবাস জীবন-যাপন করছে। যাদের রক্ত পানি করা ঘামের দামে দেশের রেমিট্যান্স বাড়ে। সত্যিকার অর্থে সরকারের আপ্রাণ চেষ্টা থাকা সত্বেও শুধুমাত্র নৈতিকতার অভাবে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ আজ বড়ই দুর্ভোগে রয়েছে।
তাদের ঘাড়ে চাপছে বেশি বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির বিল। সাথে আছে গাড়ি ভাড়া। কোন কিছুরই দাম বাড়লে জবাবদিহিতা থাকে না। তারপরও কি ছাড় আছে? হাসপাতালেও জায়গা নেই। ব্যাঙের ছাতার মত বেসরকারি ক্লিনিকগুলোর বেশিরভাগ বন্ধ। বর্তমানে এরসাথে আবার যোগ হয়েছে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে করোনা ভাইরাস নেগেটিভ ও পজেটিভ সার্টিফিকেটের কেনা-বেচা। আমরা কী আজীবন শুধু এভাবে প্রায়চিত্তই করে যাবো?
অসীম বিহারী জ্ঞান আমাদের না-ই-বা থাকুক, অন্তত ভাল-মন্দ সত্য-মিথ্যা শুভ-অশুভ ন্যায়-অন্যায় বোধটুকু তো আছে।
আমাদের সংগ্রামের পথ আনেক দীর্ঘ, বিজয়ের ইতিহাসও কম বিস্ময়ের নয়। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচার আন্দোলন সবক্ষেত্রেই রয়েছে আমাদের বিজয়গাঁথা। কিন্তু মনুষ্যত্ব ও বিবেকের আধারে জাতি হিসাবে আমরা এতো পিছিয়ে কেন? আবারও তা প্রমান হলো করোনা ভাইরাস সংক্রমণ- নিষ্ক্রমণের ভুয়া সার্টিফিকেট বিক্রির মধ্য দিয়ে। এ জন্য দায়ি কে, কারা?
তাহলে স্বাধীনতার এত বছর পরও বিবেক রক্ষায় জাতিকে আবারো নৈতিক শিক্ষার ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দিতে হবে? এ জন্য কি নেতৃত্বের অসুস্থ বিবেককে সবার আগে সুস্থ করে তুলতে হবে? বিবেকের খুব করুণ দশা আমাদের। বেঁচে থাকা, সুস্থ থাকা তার চেয়ে অর্থ উপার্জনের অশুভ লড়াই কি বেশি দরকার? নানা প্রশ্ন আজ ঘুরপাক খাচ্ছে মনে।
কয়েকদিন থেকে করোনা ভাইরাসে কতজন মারা যাওয়ার চেয়ে অনেক বেশী গুরুত্ব পাচ্ছে অনৈতিক ফায়দা লুটতে মহামারী করোনা ভাইরাসের নেগেটিভ রিপোর্টের পাশাপাশি পজিটিভ রিপোর্ট বিক্রির বিষয়। সরকারি-বেসরকারি অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনা আক্রান্ত না হয়েও ভাইরাসের পজিটিভ সনদ নিচ্ছে। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতারক চক্র জাল করোনা সনদ বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
সম্প্রতি পুলিশ ও র্যাবের হাতে এসব প্রতারক চক্রের বেশ কয়েকজন ধরা পড়েছে। তাদের কর্মকান্ডে রীতিমত হতবাক স্বয়ং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। করোনা ভাইরাস নেগেটিভ হয়তো চাকরি হারানোর ভয়ে বা সামাজিক কারণে কিনেছেন। কিন্তু অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী করোনা আক্রান্ত না হয়েও ভাইরাসের পজিটিভ সনদ নিচ্ছে। মহামারির এই দুঃসময়ে সরকারি প্রণোদনা হাতিয়ে নিতে সমানে কাজ করে যাচ্ছে একটি সিন্ডিকেট। তাই এক বন্ধু সোস্যাল মিডিয়ায় লিখলেন ‘আদম নিক্ষিপ্ত হয়েছিল সিংহল দ্বীপে, আর ইবলিশ ঢাকায়।’
সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার স্বাক্ষর ও সীল নকল করে করোনা পরীক্ষার ভুয়া সার্টিফিকেট বিক্রির অভিযোগে সাঈদ মিয়া নামে এক প্রতারককে সহযোগীসহ আটক করা হয়েছে। পরে তাদের পুলিশে সোপার্দ করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ। তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ভুয়া সার্টিফিকেট উদ্ধার করা হয়। চাকরির নিরাপত্তা নিয়ে পোশাক কারখানার কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের আতঙ্ককে পুঁজি করে বেশ কিছুদিন ধরেই জালিয়াতির এই ব্যবসা করে আসছে চক্রটি। সম্প্রতি দেনিটেক্স নামের একটি তৈরি পোশাক কারখানার কর্তৃপক্ষের কাছে এ ধরনের বেশ কিছু সার্টিফিকেট নিয়ে সন্দেহ হলে তদন্তে নামে তারা। করোনা নেগেটিভ-পজেটিভ সার্টিফিকেট জাতিয়াতি চক্রের কয়েকজনকে আটক করতে সমর্থ হয়েছে র্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
কোভিড-১৯ শনাক্তের পরীক্ষা নিয়ে কেলেঙ্কারিতে আলোচিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জোবেদা খাতুন সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার (জেকেজি হেলথ কেয়ার) সাবেক গ্রাফিক্স ডিজাইনার গ্রেপ্তার হওয়া হুমায়ুন কবীর হিরুর হাতে তৈরি হতো ভুয়া সনদ। রাজধানীর কল্যাণপুরের একটি বাড়ির কেয়ারটেকার কামাল হোসেনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে হুমায়ুন কবীর হিমু ও তার স্ত্রী তানজীন পাটোয়ারীকে গ্রেপ্তারের পর জেকেজি হেলথকেয়ারের প্রধান নির্বাহী আরিফুল হক চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
কামালের অভিযোগ, তার বাড়ির মালিক ও স্ত্রীর জ্বর, সর্দি হওয়ায় কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য অনলাইনের মাধ্যমে জেকেজির পক্ষে হুমায়ুনের সাথে যোগাযোগ করা হয়। তারা দুজন ছাড়াও তাদের ছেলে, গাড়িচালক, গৃহপরিচারিকার নমুনা তিন দফায় বিজয় স্মরণী মোড়ে কলমিলতা মার্কেটের কাছ থেকে হুমায়ুনের লোক এসে নিয়ে যায়। এজন্য ৪৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়।
২২ জুন রাতে হুমায়ুন ও তার স্ত্রীকে গ্রেপ্তারের পর তাদের কম্পিউটার থেকে ৪৩টি সনদ পাওয়া যায়, যার মধ্যে চার জন প্রবাসীও রয়েছেন। হুমায়ুন ও তার স্ত্রীকে গ্রেপ্তারের পর জেকেজি মালিক আরিফুল চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয়। ‘জেকেজির নামে যে ভুয়া সনদ হতো তা স্বীকার করে নিজের দায় এড়াতে হুমায়ুনের উপর দোষ চাপিয়ে আরিফুল দাবি করে বলেছেন, এজন্য হুমায়ুন ও তার স্ত্রীকে চাকরিচ্যুত করা হয়।’
জেকেজির পক্ষ হয়ে অন্যতম কর্ণধার আরিফুলের স্ত্রী ডা. সাবরিনা আরিফ সাংবাদিকদের সাথে কথাও বলেছিলেন। ভুয়া সনদের অভিযোগে তার স্বামী গ্রেপ্তারের পর তিনি প্রশাসনের কাছে দাবি করেন, মতের মিল না হওয়ায় অনেক আগেই জেকেজি ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। এ ঘটনার পর ২৪ জুন জেকেজি হেলথ কেয়ারের নমুনা সংগ্রহের যে অনুমোদন ছিল তা বাতিল করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং প্রিভেনটিভ মেডিসিন-এর চিকিৎসক ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘এজন্য সরকারের নীতিও দায়ী। আর সাধারণ রোগের চিকিৎসায়ও করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেটের যে রেওয়াজ চালু হয়েছে তাও এই জাল জালিয়াতির জন্য দায়ী। ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘করোনা সার্টিফিকেট যদি প্রয়োজনই হয় তাহলে তা সরকার কেন্দ্রীয়ভাবে দেয়ার নিয়ম চালু করতে পারে। আর আজকে কেউ করোনা নেগেটিভ তার মানে এই নয় যে তার করোনার পজেটিভ হওয়ার আর কোনো আশঙ্কা নাই।’
বিচার-বিবেক ও মূল্যবোধের দিক থেকে জাতি কতটা পিছিয়ে রয়েছে তার একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। দৌড় প্রতিযোগিতা। আবেল মুতাই ও ইভান ফার্নান্ডেজ দুজনই বিজাতীয়। তবে বিচার ও বিবেকের দিক দিয়ে তারা অনেক ওপরে। আবেল মুতাই কেনিয়ার হয়ে দৌড়চ্ছিলেন। খুব ভাল দৌড়চ্ছেন, পৌঁছে গেছেন শেষ ল্যাপে। পেছনে ধেয়ে আসছেন এক স্প্যানিশ অ্যাথলেট। শেষ সীমানার অল্প আগে পৌঁছে বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেন ওই কেনিয়ান অ্যাথলেট। ফিনিশ লাইন বুঝতে না পেরে ভাবলেন তিনি জিতে গেছেন আর দৌড়ের গতি কমিয়ে দিলেন।
স্প্যানিশ অ্যাথলেট ইভান ফার্নান্ডেজ আসছিলেন তার ঠিক পিছনেই… আন্দাজ ধরে ফেললেন আবেল মুতাইয়ের কনফিউশনের ব্যাপারটা। সে আবেলের কাছাকাছি এসে তাকে একরকম ধাক্কা মেরে ফিনিশ লাইন পার করে জিতিয়ে দিলেন।
দৌড় শেষ হবার পর সাংবাদিকরা ঘিরে ধরে ইভানকে। প্রশ্ন একটাই, তুমি এরকম কেন করলে? ইভান বলে, আমার স্বপ্ন ছিল কোনো একদিন আমরা সবাই পাবো একটা সামাজিক পৃথিবী যেখানে আমরা সবাই সবাইকে সাহায্য করব। সাংবাদিক সন্তুষ্ট হয়না এ জবাবে। প্রশ্ন করে, কিন্তু তুমি ওকে জিতিয়ে দিলে কেন? ইভান ঠান্ডা মাথায় জবাব দেয়, আমি ওকে জিতিয়ে দিইনি, ও যেভাবে দৌড়াচ্ছিল, ও এমনিতেই জিতে যেতো। জয়টা ওর প্রাপ্য।
সাংবাদিক ভদ্রলোক আরো জানতে চায় এবং বলে, ইভান তুমি নিজে জিতে যেতে পারতে? কেন করলে না। ইভান অবাক হয়ে তাকায় আর বলে কি যোগ্যতায় জিততাম আমি, জিতে গেলে ওই মেডেলের কি ইজ্জত থাকত আমার কাছে। আমার মা কি ভাবতো। উনি মেনে নিতো?
কিন্তু আমরা হলে কী করতাম? বিজয়ের জন্য কারো না জানার সুযোগটাকে কাজে লাগানোর জন্য ও ব্যাটার ঘাড় ধরে টেনে হয়তো সামনে চলে যেতাম।
এ বিষয়ে আর একটি উদাহরণ দিতে চাই। ভারতের একসময়ের প্রধান নির্বাচন কমিশনার টি এন শেষণ এক ছুটির দিনে উত্তর প্রদেশের কোন এক এলাকায় পিকনিকে যোগ দেওয়ার জন্য সস্ত্রীক রওনা হয়েছেন। পথিমধ্যে একটি আমবাগান অতিক্রম করার সময় চোখে পড়ল অজস্র বাবুইপাখির বাসা ঝুলছে। এ ধরণের দৃশ্য তিনি আগে কখনো দেখেন নি। তার স্ত্রী আগ্রহ প্রকাশ করলেন, দুটি বাসা তিনি বাড়িতে নিয়ে যাবেন।
এসকর্টের লোকেরা ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক রাখাল তরুণকে দুটি পাখির বাসা পেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন। কিন্তু সে রাজি হল না। কয়েক দফায় সেই রাখালকে টাকার লোভ দেখিয়েও লাভ হলো না। শেষে রাখাল বলল, সাহেব জি এই বাসা গুলোতে একটি করে পাখির বাচ্চা রয়েছে। মা পাখিটা যখন বিকেলে খাবার নিয়ে এসে তার বাচ্চাটিকে পাবে না তখন তার কান্না আমি সহ্য করতে পারব না। আপনি যত কিছুই আমাকে দিতে চান কোন কিছুর বিনিময়েই আমি এ কাজ করতে পারব না। টি এন শেষণ তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, মুহূর্তে মনে হল আমার সমস্ত বিদ্যাবুদ্ধি আই এস এস পদমর্যাদা সবকিছুই এই রাখাল তরুণটির কাছে একদানা শস্যেরও সমতুল্য নয়। শেষণ বলেছেন, এই অভিজ্ঞতা তিনি সারা জীবন বয়ে বেড়িয়েছেন। যে বিদ্যা জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করে না, বিবেক জাগ্রত করে না তা অসার-অন্তঃসারশূন্য বোঝামাত্র।
আমাদের দেশের পুত্র ও পিতার নির্মম বাস্তবতা দিয়েই উদাহরণ শেষ করতে চাই। পিতা সাবেক সফল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আর পুত্র শাহেদ মুহিত। এক নিষ্ঠুর বাস্তবতার জন্ম দিয়েছেন পুত্র শাহেদ মুহিত। এই জাহেল সন্তান তার পিতার নির্মিত বাড়িতে পিতাকে নিগৃহীত ঘোষণা করেছেন। ‘বুড়ো-বুড়ি’ বলে বাবা-মাকে অসম্মান করেছেন। এক সময় মন্ত্রী সাহেবের ‘রাবিশ’ শব্দের হুংকারে অর্থ মন্ত্রণালয় থরথর করে কাঁপতো। উনার তিন ছেলেমেয়ে। বড়ছেলে শাহেদ মুহিত।
অর্থমন্ত্রী শখ করে বিশাল বড় একটা বাড়ি বানিয়েছেন শেষকালে সেখানে জীবন কাটাবেন বলে। সরকারি বাসভবন ছেড়ে দেয়ার পর নিজের আলিশান বাড়িতে উঠবার মনঃস্থিরও নাকি করেছেন। কিন্তু মন্ত্রীর বড়ছেলে শাহেদ মুহিত তার মা বাবাকে সেই বাড়িতে উঠতে দিতে রাজি নন।
হায়রে সন্তান! নিজের জন্মদাতা পিতাকে এভাবে নিগৃহীত করার ঘোষণা কেউ দেয়? কোনো সন্তান পারে এভাবে? বড়লোক বাপের বড়লোক ছেলে। জীবনে নীতি আদর্শ হিসেবে কি শিখলেন? একসময় বাপের ক্ষমতা ব্যবহার করে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন শাহেদ মুহিত ও তার স্ত্রী। ঘটনাটি বছর খানেক আগের।
অবশেষে নির্মম বাস্তবতা হলো, প্রশাসন যন্ত্র ব্যবহার করে পাষন্ড পুত্রের কবল থেকে বাড়ির দখল পেতে হলো জন্মদাতা পিতা জনাব মুহিতের। এজন্যেই বলা হয়, অর্থবিত্ত ও উচ্চশিক্ষার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মানবিক মূল্যবোধ। তিরমিজি শরীফে বর্ণিত এক হাদিসে নবী (স.) বলেন, শুদ্ধাচার শিক্ষাদান সন্তানের জন্যে পিতার শ্রেষ্ঠ উপহার। আর বায়হাকিতে বর্ণিত অপর এক হাদিসে তিনি বলেন, সুশিক্ষা দান হচ্ছে সন্তানের প্রতি পিতার সর্বোত্তম উপহার। সুশিক্ষা, সংস্কার আর সুস্থচিন্তা বয়ে চলে নদীর মতো। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। কী শিক্ষা আমরা দিচ্ছি আমাদের প্রজন্মকে। কী ভাবে জিততে শেখাচ্ছিÑ সোজা পথে, পরিশ্রম করে? নাকি যেভাবেই পারা যায়!
মানুষ শ্রেষ্ঠ, কারণ তাকে বিবেক দেওয়া হয়েছে, যা দিয়ে সে ন্যায়-অন্যায়ের বাছবিচার করবে এবং অন্যায়-অত্যাচার ও জুলুম-নির্যাতন থেকে নিজেকে বিরত রাখবে। এই বিবেকের কারণে মানুষ পশুর থেকে পৃথক সত্তা। মানুষ যখন নিজের পশুপ্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে বিবেক দ্বারা পরিচালিত হয়ে সৎভাবে দৈনন্দিন জীবনযাপন করে, তখনই সে মানবিক হয়।
দেশ-জাতি ও রাষ্ট্রের যেমন উচিত মানবাধিকার রক্ষাকল্পে বিভিন্ন আইনকানুন ও গঠনমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা, তেমনি করে দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কর্তব্য নিজেদের বিবেকবোধকে জাগ্রত করা। যাতে সকল দুরাচার, অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়।
আমরা অনেক আগেই অন্ধকার যুগ পেরিয়ে এসেছি। আমরা এখন সভ্য সমাজের মানুষ। আমরা আলোকিত সমাজের বাসিন্দা। তবুও কেন আমরা নিজেদের অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছি? এর মূলে রয়েছে অন্ধ বিবেক। আমরা অন্ধ বিবেকের বদ্ধ ঘরে থাকতে চাই না। আমাদের সমাজ, আমাদের দেশ সুন্দরভাবে সাজাতে চাই। সত্যের আলোয় ভরে উঠুক আমাদের সমাজ। সত্য, সুন্দর ও স্বচ্ছতায় জেগে উঠুক সবার বিবেক।
লেখক-সাংবাদিক, কবি ও কলামিষ্ট