জলাভূমি: জীবন ও জীবিকা রক্ষার অনবদ্য লীলাভূমি

প্রকাশিত: জুলাই ৩, ২০২০; সময়: ২:১২ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
জলাভূমি: জীবন ও জীবিকা রক্ষার অনবদ্য লীলাভূমি

ডক্টর রঞ্জন রায় : মানুষের বেঁচে থাকার জন্য জলাভূমি একান্ত প্রয়োজন। জলাভূমি যেমন লেক, হাওর, ম্যানগ্রোভ, এবং বিল প্রধানত তিন ধরনের অত্যাবশ্যকীয় বাস্তুসংস্থান সার্ভিস প্রদান করে। প্রথমত, প্রভিসননিং সার্ভিসের মধ্যে পড়ে খাদ্য, পানীয়, কাঠ, হাইড্রোপাওয়ার, এবং ঔষধের যোগান। দ্বিতীয়ত, সাংস্কৃতিক সার্ভিসের মধ্যে আছে চিত্তবিনোদন, ট্যুরিজম ও ইকো ট্যুরিজম। এবং তৃতীয়ত, রেগুলেটিং সার্ভিসের মাধ্যমে জলাভূমি পানি শোধন; খরা, বন্যা ও অন্যান্য দুর্যোগ থেকে রক্ষা; জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ; কার্বন সিকুয়েষ্ট্রেসনে বিরাট ভূমিকা রাখে।

জলাভূমির অর্থনৈতিক অবদান অপরিসীম, যেমন, জলাভূমি মৎস্য ও সামুদ্রিক সম্পদের বিশাল ভাণ্ডার। সারা বিশ্বেই জলাভূমিভিত্তিক বিনোদনমূলক কার্যক্রমের সঙ্গে বিরাট অর্থনীতি জড়িত। জলাভূমি অন্যান্য অনেক উপকার (যেমন, সুপেয় পানি প্রদান, শিল্পকারখানা সচল রাখা, এবং দূষণ রোধ) বয়ে আনার মাধ্যমে জাতীয় এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।

জলবায়ু পরিবর্তনের পেক্ষাপটে যখন পানির চাহিদা, এবং বন্যা ও খরার ঝুঁকি বাড়ছে, তখন টেকসই উন্নয়নে (এসডিজি) জলাভূমির ভূমিকা আগের তুলনায় অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। এসডিজি ৬ (পরিস্কার পানি এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থা) এবং ১৪ (পানির নিচে জীবন) এর অর্জন জলাভূমির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। অধিকাংশ এসডিজির সঙ্গে জলাভূমির প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সম্পর্ক আছে। সুনির্দিষ্টভাবে, এসডিজির ৭৫টি ইনডিকেটরের অর্জনে জলাভূমির প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ অবদান আছে।

এছাড়াও, জলাভূমির কতগুলো অনন্য গুরুত্ব আছে। যেমন, খাদ্য নিরাপত্তায় এবং জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমিতকরণে (mitigation) জলাভূমির বাস্তুসংস্থান সার্ভিস স্থলজ বাস্তুসংস্থান সার্ভিসের তুলনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সব দেশেই জলের গুণাগুণ নিম্নমুখী। জলাভূমির সঠিক ব্যবস্থাপনায় এর অন্যতম সমাধান।

জলাভূমি গ্লোবাল ওয়াটার সাইকেল (হাইড্রোলোজিক্যাল প্রসেস) অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করে, যা পানির সহজলভ্যতা, প্রাপ্যতা, অধিক বৃষ্টিপাত (বা বন্যা), খরা এবং প্রাসঙ্গিক অন্যান্য ভেরিয়েবলসকে নিয়ন্ত্রণ করে।

জলাভূমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কার্বন স্টোর, যদিও মিথেন নিঃসরণ করে। তাছাড়া, জলাভূমি হচ্ছে অন্যতম বড় একটি বায়োলজিক্যালি প্রোডাক্টিভ বাস্তুসংস্থান। যার মানে হল এই বাস্তুসংস্থানের উৎপাদন ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে অধিক, যা মানুষকে বেশি বেশি কাঁচামাল সামগ্রী সরবরাহ করে।

রামসার কনভেনশনের (Ramsar Convention) মতে, বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ জলাভূমির অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশে জলাভূমিগুলোর বাস্তুসংস্থান খুবই প্রজাতিসমৃদ্ধ, যা এদেশের বহু গ্রাম্য মানুষের জীবন, জীবিকা ও পুষ্টির অন্যতম উৎস। জলাভূমি অধিষ্ঠিত এদেশে জলাভূমির ‘টেকসই’ ব্যবহার ছাড়া এসডিজি অর্জন কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

সারা পৃথিবীতে ১৯৭০ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত ৩৫ শতাংশ জলাভূমি কমে গেছে। বাংলাদেশেও দীর্ঘদিন ধরে জলাভূমি সম্পদ ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। এদেশে নিকট অতীতেও জলাভূমিকে বলা হতো জঞ্জালভূমি। সরকার, অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ ও প্রতিষ্ঠান পুনরুদ্ধারের অজুহাত তুলে জলাভূমিকে কৃষি উৎপাদনে বা অন্যান্য উদ্দেশ্যে (যেমন, নগরায়ন এবং শিল্পায়ন) ব্যবহার করছে। জলাভূমি দখল এদেশের একটি পুরনো সমস্যা। এই দখলদারিত্ব বড় বড় শহর অঞ্চলে তুলনামূলক বেশি।

জলাভূমি কমে যাওয়ার অন্যান্য হুমকিগুলো হলো ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ, আপার রিপারিয়ান এরিয়ার অনিয়ন্ত্রিত নদীর প্রবাহ, অপর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, বাজেটের সীমাবদ্ধতা ও পানি দূষণ। এই হুমকিগুলো রামসার কনভেনশন পুরোপুরি বাস্তবায়নে অন্যতম বড় বাধা।

জলাভূমির পরিবর্তনে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ অনেক ফ্যাক্টর দায়ী। এরা ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় ফলই দেয়। প্রত্যক্ষ ফ্যাক্টরগুলো হতে পারে প্রাকৃতিক বা মনুষ্যসৃষ্ট, যা স্থানীয় হতে আঞ্চলিক স্তর পর্যন্ত বায়োফিজিক্যাল প্রসেসের পরিবর্তন করে। উদাহারণ হিসেবে বলা যায়, জলবায়ু পরিবর্তন, স্থাপনা নির্মাণ বা স্থাপনার পরিবর্তন, লবণাক্ততা, এবং পানি, স্পেসিস ও বালু উত্তোলন।

পরোক্ষ ফ্যাক্টরসূমহের প্রভাব বৃহৎ এবং বিস্তৃত। এরা প্রাতিষ্ঠানিক, আর্থ-সামাজিক, ডেমোগ্রাফিক, এবং সাংস্কৃতিক উপাদানের সঙ্গে সম্পর্কিত। পরোক্ষ ফ্যাক্টরসূমহ প্রত্যক্ষ ফ্যাক্টরদেরও প্রভাবিত করে। বর্তমানে এবং ভবিষ্যতে জলাভূমির অবক্ষয় এবং ক্ষতি সাধন করে বা করবে এমন ফ্যাক্টরদের মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।

প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ অনেক ফ্যাক্টরের জন্যই জলাভূমির উদ্ভিদ ও প্রাণী বহূমখী সংকটে। গবেষণা নির্দেশ করে এদেশে চারভাগের এক ভাগ প্রজাতি আজ ধ্বংসের মুখে। অযাচিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, মাত্রাতিরিক্ত দূষণ, আক্রমণকারী প্রজাতির আধিক্য, বাধাগ্রস্ত ফ্লো রিজিম (regime), এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাকি জলাভূমির উদ্ভিদের গুণাগুণ বা অবস্থা মোটেই সন্তোষজনক নয়। এই অবস্থায় জলাভূমি সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ, ও পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য বিশেষ কতগুলো পদক্ষেপ নেওয়া আবশ্যক।

প্রথমত, অনতিবিলম্বে জলাভূমির জাতীয় ইনভেন্টরি প্রতিষ্ঠা করা দরকার। এজন্য শিক্ষা, গবেষণা, ও বাজেট বরাদ্দ অত্যাবশ্যক। কারণ এই ইনভেন্টরি তৈরি করতে অনেক ডেটা ও তথ্য প্রয়োজন। ইনভেন্টরি তৈরিতে রামসার কনভেনশন’স ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন পার্টনারস এবং রামসার সায়েন্টিফিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল রিভিউ প্যানেলের প্রযুক্তিগত এবং আর্থিক সাহায্য প্রয়োজন। এর জন্য মৎস্য বিভাগ, হাওড় ও ওয়েটল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগ, এবং ওয়াটার রিসোর্স প্লানিং অর্গানাইজেশনকে নেতৃত্ব দিতে হবে। এই ইনভেন্টরিতে সব স্টেকহোল্ডারদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, অগ্রাধিকারভিত্তিতে আন্তর্জাতিক ও জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ অন্তত দুই ডজন জলাভূমির বিস্তারিত মূল্যায়ন (ফিজিক্যাল, ইকোলজিক্যাল এবং হাইড্রোলজিক্যাল) করা উচিত। এর ফলে দুটি রামসার সাইটের (সুন্দরবন ও টাংগুয়ার হাওড়) পাশাপাশি অন্যান্য জলাভূমিকে এই সাইটের বা নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত করার কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এ কাজে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের (যেমন, ভূমি, কৃষি এবং মৎস) মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়কে নেতৃত্ব দেওয়া উচিত।

তৃতীয়ত, জলাভূমির জাতীয় পলিসি বা স্ট্রাটেজি প্রণয়ন দরকার। যা জলাভূমি সমস্যার স্বীকৃতি ও টার্গেটেড কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করবে। একটি “স্বতন্ত্র” জলাভূমি জাতীয় পলিসি, আইনপ্রনেতা এবং জনগণের মনোযোগ বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। তবে পলিসি বা স্ট্রাটেজি প্রণয়নের পাশাপাশি এদের কার্যকরী বাস্তবায়ন দরকার। বাংলাদেশে পলিসি-প্রাকটিসের ফারাক সব সেক্টরেই লক্ষণীয়। এটা কমানোর পদক্ষেপ অত্যাবশ্যক।

সরকার বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য আইন ও বিধি, যেমন, বাংলাদেশ বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি অ্যাক্ট ২০১৭, প্রোটেক্টেড এরিয়া ম্যানেজমেন্ট রুলস ২০১৭, ইকোলোজিক্যালি কৃটিক্যাল এরিয়া ম্যানেজমেন্ট রুলস ২০১৬, ফিস অ্যাক্ট ১৯৫০ (সংশোধিত ২০১৪), এবং ওয়ার্ল্ড (প্রিসারভেশন এবং সিকিউরিটি) অ্যাক্ট ২০১২ প্রণয়ন করেছে। তবে এসবের “সঠিক” বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছা ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা নিয়ে অনেক অভিযোগ আছে।

চতুর্থত, জলাভূমির সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও পুনরুদ্ধার বিষয়গুলো সব পোস্ট-২০১৫ ডেভেলাভমেন্ট এজেন্ডার পরিকল্পনায় ও বাস্তবায়নে অঙ্গীভূত করা দরকার। বিশেষভাবে, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন ও প্রশমিতকরণ, ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ও এসডিজি অর্জন কৌশল, এবং কৃষি ও মৎস পরিকল্পনাসূমহ উল্লেখযোগ্য। কিছু পলিসি জলাভূমি বিষয়টি উল্লেখ করলেও এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্য বা কার্যকরী পন্থা লিপিবদ্ধ নেই। এজন্য হাওর ও ওয়েটল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ কাম্য।

পঞ্চমত, রামসার কনভেনশন নির্দেশিত জলাভূমির প্রাজ্ঞ ব্যবহার (Wise Use of Wetlands) এর গাইডলাইনের প্রয়োগ। “জলাভূমির প্রাজ্ঞ ব্যবহার” বলতে এসডিজি অর্জনের স্বার্থে ইকোসিস্টেম অ্যাপ্রোচ (যেমন, সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার) প্রয়োগের মাধ্যমে ইকোলজিক্যাল ক্যারেক্টারসূমহের রক্ষণাবেক্ষণকে বুঝায়। ইকোলজিক্যাল ক্যারেক্টার বলতে সমন্বিতভাবে ইকোসিস্টেম কম্পোনেন্ট, প্রসেস, ও ইকোসিস্টেম সার্ভিসকে বুঝায় যা জলাভূমির চরিত্র বর্ণনা করে। এই গাইডলাইন প্রয়োগে জলাভূমিকে প্রভাবিত বা পরিবর্তিত করে এমন ফ্যাক্টর সম্পর্কে বিস্তারিত জানা দরকার। এতে জলাভূমির ক্ষতি ও ক্ষয়ের মূল কারণকে এড্রেস করা যায়।

এবং ষষ্ঠত, জলাভূমি রক্ষার্থে আইনগত ও পলিসি আরেঞ্জমেন্ট শক্তিশালী করা প্রয়োজন। এই আরেঞ্জমেন্টগুলো হতে পারে জলাভূমিকেন্দ্রিক বা সাধারণভাবে জীববৈচিত্র্য ও দূষণ রোধ করে এমন ব্যবস্থাভিত্তিক। এইসব ব্যবস্থা কার্যকরী করতে হলে আইনসূমহকে ক্রস-সেক্ট্রারালি প্রয়োগ করতে হবে।

মূলত, উন্নত গভর্নেস পলিসি, বিধি, এবং রেগুলেশন বাস্তবায়নের ভিত্তি নির্মাণ করে। এছাড়া, এনভায়রনমেন্ট ইমপেক্ট এবং স্ট্রাটেজিক এনভায়রনমেন্ট এসেসমেন্ট (EIA এবং SEA) পলিসি বাস্তবায়নকে শক্তিশালী করে। আজও এদেশে EIA প্রয়োগের শক্ত প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি তৈরি হয়নি। আর SEA ব্যবহার অনেক দূরের কথা।

এছাড়াও জলাভূমির উন্নয়নে জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়ানো এবং জলমহালের লিজিং সিস্টেম ঢেলে সাজানো অত্যাবশ্যক। মোদ্দা-কথা হচ্ছে, বিভিন্ন স্তরে (স্থানীয় হতে জাতীয়) ‘জলাভূমির শাসন’ শক্তিশালীকরণ ব্যতীত জলাভূমির সঠিক সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, কৃষি সম্প্রসারণ ও ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

সূত্র : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

 

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে