একদিকে সম্পদের পাহাড়, অন্যদিকে ক্ষুধায় হাহাকার

প্রকাশিত: জুলাই ৪, ২০২০; সময়: ২:০৪ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
একদিকে সম্পদের পাহাড়, অন্যদিকে ক্ষুধায় হাহাকার

ফাহমিদা হক : একদিকে প্রকৃতির ভয়ানক তান্ডব, অন্যদিক মানুষের হিংস্রতা, কপটতা। যেন কোথাও দাঁড়াবার ঠাঁই নাই।সব মিলিয়ে গোটা বিশ্বআজ এমন এক অন্ধকার গন্তব্যে যার শেষ কোথায় কেউ জানেনা।এতো অসহায় সময় বোধহয় এই শতাব্দী আগে কখনো দেখেনি। যতো দিন যাচ্ছে মানুষ তার সর্বশক্তি মেধা আর শ্রম দিয়ে লড়াইকরেও এক ক্ষুদ্র অণুজীবের কাছে ক্রমাগত হার মেনে আজ ক্লান্তপ্রায়। ঘরসংসার, সমাজ, অর্থনীতি থেকে শুরু করে সবকিছু তছনছ করে দূর্বার গতিতে ছুটে চলা করোনার থাবায় মৃত্যুর মিছিলে যুক্তহয়েছে কতো প্রান। কোন কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছেনা এই করোনা মহামারী। দীর্ঘ দিন ধরে চলতে থাকা করোনার কারনে বন্দী জীবনে নেমে আসছে হাজারো সমস্যা। আর যে কোন দূর্যোগ কিংবা অস্হিরসময়ের প্রথম ধাক্কাটাই এসে পড়ে নারী বা শিশুদের উপর। করোনার এই দূর্যোগের সময়ও তাই হচ্ছে, গোটা বিশ্বজুড়ে সবচেয়েসংহিসতার শিকার হচ্ছে নারী আর শিশুরা। কঠিন এক সময় পার করছে যখন বাইরে সবার করোনা ভয়, ঘরের ভিতরে তখনপুরুষের ভয়ে নারী।

বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যম ইতিমধ্যেই গার্হস্হ্য সহিংসতা বৃদ্ধি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করছে।আমাদের দেশে এই বিষয় নিয়ে তেমনকোন গবেষনার খবর পাওয়া যায়নি। নানান কারণে বাইরে থাকা পুরুষ মানুষটা যখনই ঘরে বন্দী হয়ে গেলো, কেউ অর্থনৈতিকটানাপোড়নের কারণে, কেউ নেশার সামগ্রী যথাযথ না পেয়ে , কেউ বা বাইরের জগতে রাতদিন কাটানোর ফুসরত না পেয়ে নিজেরঅজান্তে বা জেনেবুঝেও সব যন্ত্রণার বহি:প্রকাশ ঘটাচ্ছে ঘরে থাকা অসহায় নারী বা শিশুর উপর। এই সহিংতার ঘটনা কেবলবাংলাদেশের নয়। করোনা কালে দেখা যাচ্ছে গোটা বিশ্বের অবস্হা একই। মানবাধিকার, নারী অধিকারের কথা বলে বেড়ানোমোড়ল দেশের মোড়লীপনার মুখোশ এক করোনার টানেই খসে পড়েছে। নারী পুরুষের ভেদাভেদ আছে বলে যারা মুখে ফেনাতুলে তীর্যক চোখে দেখে তৃতীয় বিশ্বের রক্ষনশীল গোষ্ঠীকে তারাও কিন্তু

এই কয়েক মাসে সব জ্ঞান গর্ব সমঅধিকারের কথা ভুলে গিয়ে নারীর গায়ে হাত তুলছে। করোনার মৃত্যু ভয়ের চেয়ে ভয়ানকশংন্কায় এখন গোটা বিশ্বের অনেক নারী।
গত ৬ এপ্রিল ২০২০ লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ সূত্রে জানা যায় যে, গত ফেব্রুয়ারিতে চীনের উহানে ঘরে আভ্যন্তরীনথাকার সময়ে সেখানকার পারিবারিক সহিংসতা অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে ৩ গুণ বেড়ে গিয়েছিলো। ৬ এপ্রিল বিবিসিঅনলাইন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এক লকডাউনের কারণে ব্রিটেনসহ সারা বিশ্বে বেড়েছে নারীর প্রতি পারিবারিকনির্যাতনের ঘটনা। ‘দ্যা ন্যাশনাল ডমেষ্টিক অ্যাবিউজ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, লকডাউনের এই সময়ে লকডাউন পূর্ববর্তী সময়ের তুলনায় বর্তমানে তাদের কাছে সাহায্য চাওয়ার পরিমান বেড়েছে ২৫ শতাংশ।
৬ এপ্রিল ২০২০ ইউএনওইম্যানের নির্বাহী পরিচালক এক বিবৃতিতে করোনার কারণে, লকডাউন চলাকালে নারীর প্রতি সহিংসতাবৃদ্ধির পরিস্হিতিকে মহামারি হিসেবে অবহিত করেছেন। ৬ এপ্রিল জাতিসংঘের মহাসচিব এক বিবৃতিতে কোভিড ১৯মোকাবিলার জন্য গৃহীত জাতীয় পরিকল্পনায় নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ ও প্রতিকারের বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত করার জন্যেরাষ্ট্রগুলোর প্রতি আহবান জানিয়েছেন এবং বলেছেন এর বিরুদ্ধে ব্যবস্হা না নিলে, করোনা পরবর্তী সময়ে এর প্রভাবেঅর্থনীতির ক্ষেত্রে ক্ষতির নতুন মাত্রা যোগ হবে।

বাংলাদেশে গত বছর ৬ মাসে নারী ও শিশুর উপর যে পরিমান নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গেছে, এ বছর এই ৬ মাসে তারতিনগুণ বেশী অভিযোগ জমা হয়েছে। এদেশে জাতীয় জরুরী সেবা ৯৯৯ এর প্রধান, পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শকতবারক উল্লাহর মতে, সকল সময়ের চেয়ে বেশী কল রিসিভ করতে হচ্ছে এই সময়ে, যার বেশীর ভাগই পারিবারিক সহিংসতাজনিত। যার মধ্যে শুধু স্বামী স্ত্রীর সহিংসতা নয়, ভাইবোন আছে এই তালিকায়। নেশার টাকার জন্যে বোনকে ঘরে আটকে মারপিটের ঘটনাও আছে। আছে প্রতিবেশীর অভিযোগও।
বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে নারীর পাশাপাশি শিশুরাও নানাভাবে বিভিন্ন সহিংসতার শিকার হয় যেকোন দূর্যোগের সময়।ওয়ার্ল্ড ভিশনের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ থেকে ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত সারা দেশে ২৮টি বাল্য বিবাহের ঘটনা ঘটে। এদিকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে বাংলাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন যাবত বন্ধ ঘোষনা করা হলে এই ফাঁদে পড়লোনাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার এক বিদ্যালয়েরই ১৩টি শিশুকন্যা। অপ্রাপ্ত বয়সে এসব শিশুর বিয়ে দিয়ে তাদের বাবা মাদায়মুক্তির পথ খুঁজেছে, কিন্তু এদের কারো বয়সই ১৬ও হয় নাই। এসব বাবা মায়ের চিন্তা পারিবারিক সন্মান রক্ষা করার জন্যেবখাটেদের হাত থেকে রক্ষা করা, কম বয়সে বিয়ে দিলে যৌতুকের টাকা কম লাগবে, এমন সময়ে বিয়ে দিয়ে অন্তত একটা মুখেরচিন্তা থেকে তো মুক্তি পাবে, আসলে মুক্তি কি এসব গোঁজামিলে কখনো মিলে?
৯৯৯ সেবা দানে পুলিশের অভিজ্ঞতাও বিচিত্র। কতো সুপরিচিত ভদ্রলোকের ঘরেও এই করোনা কালে নীরব নির্যাতন চলছে।অসহায় নারীটির মুখ খোলার উপায় নেই। কেবলই সয়ে যাওয়া। দু’একজনে অতি গোপনে যাও পুলিশে অভিযোগ করছে তাওপুলিশকে তদন্ত করতে গিয়ে পড়তে হচ্ছে মহা ফ্যাসাদে।
করোনা লকডাউনে চাকরীজীবী স্বামী স্ত্রী যখন দুজনেই ঘরে বন্দী, কাজের লোক না থাকায় কাজের চাপ তখন স্বাভাবিক ভাবেইবেশী। তখন সংসারের সকল কাজ একা করার দায়িত্ব কোনভাবেই নারীর হতে পারেনা। এইসময়ে সামান্যতম বোধ কাজকরলেও নারী সন্মানিত বোধ করে, নারীর উপর শারীরিক কাজের চাপ কম পরে, নারীর প্রতি সহিংসতা কমে আসে।
করোনা ভাইরাসের বিস্তারে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক খাতগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে। ঘরবন্দী হয়ে কর্মহীন হয়ে পরেছেবহু মানুষ। এই পরিস্হিতিতে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে। অর্থনৈতিক চাপ বাড়ার সাথে সাথে নারীর উপর বাপের বাড়ীথেকে টাকা আনার জন্যে চাপ বেড়েছে। ইউরোপ আমেরিকার মতো দেশেও এই করোনার লকডাউনে পারিবারিক বহু সহিংসতারখবর পাওয়া যাচ্ছে। ঐসব দেশে স্বামী স্ত্রীরা উভয়েই বেশী স্বাধীনচেতা, ঘরের বাইরে বেশী সময় কাটে যাদের, এখন এই বন্দীদশায় ওরা আরো বেশী অস্হির আচরণ করছে। স্বামী স্ত্রী’র ঝগড়া ছাড়াছাড়ি এমনকি হতাশায় নেশাগ্রস্হ পিতা দ্বারা সন্তানেরউপর সহিংস আচরণের খবরও প্রকাশিত হয়েছে।

জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের(ইউএনএফপিএ) এক বৈশ্বিক প্রতিবেদন ‘ইমপ্যাক্ট অব দ্যা কোভিড ১৯ পেনডেমিক অনফ্যামিলি প্ল্যানিং অ্যান্ড এনডিং জেন্ডার বেজড ভায়োলেন্স ফিমেল জেনিটাল মিউটিলেশন অ্যান্ড চাইল্ড ম্যারেজ’ -এ বলা হয়, কোভিড ১৯ এর কারণে নিন্ম – মধ্যম আয়ের ১১৪ টি দেশের প্রায় ৪ কোটি ৭০ লাখ নারী আধুনিক পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতিব্যবহার করতে পারবেন না বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ এবং অনিরাপদ গর্ভপাতের হার বাড়বে।ধারণা করা হচ্ছে, ভাইরাস বিস্তার ঠেকাতে বিভিন্ন দেশের বিদ্যমান লকডাউন ছয় মাস অব্যাহত থাকলে বিশ্বে অতিরিক্ত ৭০ লাখঅনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ এবং অতিরিক্ত ৩ কোটি ১০ লাখ সহিংসতার ঘটনা ঘটবে।
ইউএনএফপিএ বলছে, বর্তমান পরিস্হিতিতে বিভিন্ন দেশে পরিবার পরিকল্পনার চাহিদা পূরণে বাধা, স্বাস্হ্য কর্মীদের সংকট বাস্বাস্হ্য কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে যথাযথ সেবা দানে বিঘ্ন ঘটতে পারে।অন্যদিকে করোনা ভাইরাস সংক্রমিত হবার ভয়ে সেবানিতে যাওয়া নারীর সংখ্যাও কমে যাচ্ছে।
ইউএনএফপি -এর হেলথ সিস্টেম স্পেশালিস্ট দেওয়ান মো: ইমদাদুল হক মনে করেন, বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে মোটজনসংখ্যার ২৫ শতাংশ প্রজননক্ষম নারী, যারা গর্ভধারণ করে তাদের মধ্যে ১৫ শতাংশ নারীই এ সময় নানা গর্ভকালীনজটিলতায় পড়বে, কিন্তু এই করোনা পরিস্হিতিতে তাদের স্বাস্হ্য কেন্দ্রে গিয়ে সঠিক সেবা পাবার হার কমে যাবে। আর করোনাপজেটিভ হলে তো আরো সমস্যায় পড়বে।
বাংলাদেশের নারীশ্রমিক কেন্দ্র (বিএনএসকে) কর্তৃক মোহাম্মদপুরের নিম্ন আয়ের মোট ১৫৬ জন নারীর উপর পরিচালিতজরিপের ফলাফল থেকে জানা যায় যে, ৯৬ শতাংশ নারী শ্রমিক তাদের কর্মসংস্হান হারিয়েছেন এই করোনার কারণে, এদেরবেশীর ভাগই গৃহপরিচ্ছন্নতাকর্মী বা গার্মেন্টস শ্রমিক।অর্থনীতির অবস্হা যতই ভঙ্গুর হচ্ছে এসব অনানুষ্ঠানিক খাতে নিযুক্তদৈনিক উপার্জনের উপর নির্ভরশীল মানুষের জীবন ততই দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে।সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খেটে খাওয়া নারীদেরজীবনের অশান্তি। করোনায় কর্মহীন নারীর গৃহে জ্বলছে আগুন, যেন মরার উপর খড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে করোনা।
বাস্তবতা হচ্ছে, গার্হস্হ্য সহিংসতা যেহেতু পারিবারিক পরিমন্ডলে সংঘটিত হয় এবং এর ভুক্তভোগী দুজনেই একই বাসস্হানে বাসকরেন, লকডাউন চলাকালে বিকল্প হিসেবে নিরাপদ একটি আবাসস্হল পাওয়া এসময় সম্ভবনা। তা ছাড়াও অপরাধসংঘটনকারীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে আইনি সহায়তা চাওয়াটাও এই সময়ে কঠিন একটা বাস্তবতা। যা ভুক্তভোগী নারীকে আরোহতাশায় বিষন্নতায় নিমজ্জিত করে দিচ্ছে।

আমরা জানি, স্বাস্হ্য সেবাদানকারী ব্যক্তিগন, পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সদস্যগণ ছাড়াও বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানএসময় আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছেন করোনা মোকাবিলায়।কিন্তু করোনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সব ধরণের প্রভাব, বিশেষ করেসহিংসতার কারণে নারী ও কন্যা শিশুর অরক্ষনীয়তার বিষয়টিকে সক্রিয় বিবেচনায় নিয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী।ত্রাণ বিতরণের সময় যাতে আর কোন নারী বা শিশুর প্রতি সহিংসতা না ঘটে সেদিকে নজর দিতে হবে।
অনলাইনভিত্তিক সেবা ও নাগরিক সংগঠনগুলোর জন্য বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা, নারীর প্রতি সহিংসতা সংঘটনকারীর বিচারপরিচালনার স্বার্থে সীমিত আকারে হলেও দ্রুত বিচার কার্য সংগঠিত করে সাজা নিশ্চিত করা দরকার। প্রয়োজন সহিংসতারশিকার নারীর জন্য নিরাপদ আশ্রয়কে অত্যাবশ্যকীয় সেবা হিসেবে ঘোষণা করা। সহিংসতা সংঘটনকারীর অগোচরে কিভাবেসহায়তা চাওয়া যায়, সেই রকম বিকল্প নিরাপদ ব্যবস্হা চালু রাখার মতো বিষয়গুলোর উপর ইতিমধ্যে জাতিসংঘের তরফথেকেও সুনির্দিষ্ট কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। তাছাড়া আইন সহায়তাপ্রদানকারীর পক্ষ থেকে হেল্প লাইন ব্যবস্হা, মনো-সামাজিকসহায়তা এবং অনলাইন ভিত্তিক কাউন্সেলিং সেবাকে শক্তিশালী করার প্রয়োজন এখন। আশা করি, আমাদের সরকারও এইসুপারিশগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে সক্রিয় ভুমিকা পালন করবেন, আমাদের নারীদের সুরক্ষায় হাত বাড়িয়ে দেবে; পারিবারিকসহিংসতা প্রতিরোধে আরও কঠিন এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।

লেখক: নিউ মিডিয়া কোঅর্ডিনেটর, সিজিএস; পরিচালক, সিসিএন

সূত্র : এবিসি নিউজ২৪

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে