বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস: দক্ষ জনসম্পদ গড়তে হবে
শাহাদাত আনসারী : ১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। দ্রুতহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে সমস্যা শুধু বাড়ছে আর বাড়ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বর্তমান বিশ্ব আজ নানামুখি সমস্যার সম্মুখীন। বিশ্বব্যাপি জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিপরীতে নানান কর্মসূচি পালন করা হলেও এ বৃদ্ধি থেমে থাকেনি। তাই অনেকে বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে পারমানবিক বিস্ফোরণের চেয়েও ভয়াবহ মনে করেন। জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ বললে ভুল হবে না। বর্তমানে বাংলাদেশও জনসংখ্যা বৃদ্ধির গ্রাস থেকে মুক্ত না। পৃথিবীর জনবহুল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। অন্যান্য দেশের তুলনায় এখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। ছোট্ট এ দেশটির জনসংখ্যা ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি। ক্ষুদ্র আয়তন ও সীমিত সম্পদের এ দেশে বর্তমানে জনসংখ্যা একটি প্রধান সমস্যা। আর বাংলাদেশের অধিক জনসংখ্যা এখন উন্নয়নের জন্য অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) উপাত্ত অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি ৫৭ লাখ। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে জনসংখ্যা বাস করে ১১১৬ জন। বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শতকরা ১.৩৩। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (নিপোর্ট) এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে মোট প্রজনন হার ৪, মধ্যবিত্তের মধ্যে ৩ এবং উচ্চবিত্তের মধ্যে ২ দশমিক ৫। এ গবেষণার ফল অনুযায়ী দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা অতিদ্রুত বাড়ছে। কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ধনীদের চেয়ে গরিবদের মধ্যে বেশি। অপরিকল্পিতভাবে যদি মানুষ বাড়তে থাকে, তাহলে কয়েক বছর পর এদেশ বাসযোগ্য থাকবে না।
বাংলাদেশ কৃষি নির্ভর একটি উন্নয়নশীল দেশ। এখানে শিল্পে কোন অগ্রগতি নেই বললেই চলে। দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও আবাদি জমির বৃদ্ধি ঘটে না। উল্টো অধিক জনসংখ্যার আবাসস্থল তৈরিতে প্রয়োজন হচ্ছে নতুন ভূমি। তাই জনসংখ্যা বৃদ্ধি কৃষির উপর চাপ ফেলছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কু-প্রভাব ইতোমধ্যে আমাদের অর্থনীতির উপর চাপ ফেলেছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে জীবিকা নির্বাহ ও খাদ্য সংগ্রহ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাবে জনসাধারণ অপুষ্টিতে ভুগছে এবং দিন দিন কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে দরিদ্র মানুষ ভূমিহীন হয়ে পড়ছে। অবশেষে তাদের বসবাসের মতো জমিও থাকছে না। অতিরিক্ত মানুষের খাদ্য ও বাসস্থান যোগান দিতে বনভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে। দেশে যে পরিমাণ মানুষ জন্মগ্রহণ করছে তাদের আবাসস্থল ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলে সমাজে বেকারত্ব বেড়ে যাচ্ছে। কর্মসংস্থানের অভাবে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে। খাদ্যের যোগান দিতে মানুষ আজ অপরাধ ও নীতিবিবর্জিত কাজে জড়িয়ে পড়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে সমাজে খুন, ছিনতাই, ডাকাতি, হত্যা সন্ত্রাস ইত্যাদি বৃদ্ধি পেয়েছে। আইন শৃংখলার চরম অবনতি জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফল।
বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনেক কারণ আছে। এগুলোকে প্রধানত দুইভাগে ভাগ করা যায়। যথা সামাজিক কারণ ও অর্থনৈতিক কারণ। আমাাদের দেশের অনেক মানুষই অশিক্ষিত। অশিক্ষার সাথে সাথে আমাদের মধ্যে কুসংস্কারের প্রভাব প্রকট। অধিকাংশ মানুষ জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন সম্পর্কে কোন রকম চিন্তা করে না। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ব্যাপারে তারা উদাসিন। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কুফল সম্পর্কে গ্রামের অধিকাংশ মানুষের ধারণা অস্বচ্ছ। অশিক্ষা ও অসচেতনতার ফলে অভিভাবকরা তাদের মেয়েদের প্রাপ্ত বয়স হবার পূর্বেই বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। অনেকেই আবার একাধিক বিবাহ করছে। বাল্য ও বহুবিবাহের ফলে আমাদের সমাজে জনসংখ্যার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। পুত্র সন্তানকে এখনও মেয়েদের চেয়ে বড় করে দেখা হয়। তাই কয়েকটি মেয়ে সন্তান জন্মের পর অনেকেই পুত্র সন্তান লাভের জন্য অধিক সন্তান জন্ম দিয়ে থকেন। এভাবে আমাদের সমাজে অপ্রত্যাশিত আকারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার কারণে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য দারিদ্র্যতাকে দায়ী করা যায়। অতি দ্রুত পরিবারে একজন মানুষ রোজগার করবে এমন আশা করে অনেকেই অল্প বয়সে সন্তান জন্ম দিচ্ছে। শ্রমজীবী ও দরিদ্র মানুষেরা তাদের পুত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদাসীন। পরিবারের ছেলে সন্তানকে আয়ের উৎস হিসেবে ভেবে অনেকে সংসারে ছেলে সন্তান জন্মের জন্য চেয়ে থাকছে। ফলে জনসংখ্যা অধিক থেকে অধিকতর হচ্ছে। শারীরিক পরিশ্রম করার পরে শ্রমজীবী ও দরিদ্র লোকেরা গৃহে ফেরার পর যথেষ্ট বিনোদনের সুযোগ না পাওয়ায় যৌনতাকে জীবনের উপভোগ্য ভেবে থাকে। সাধারণত দরিদ্র লোকের প্রজনন ক্ষমতা বেশি এবং তাদের বিনোদনের সুযোগ কম হওয়ায় পরিবারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বর্তমানে অধিক জনসংখ্যার ফলে দেশ নুয়ে পড়েছে। দেশের অগ্রগতি উন্নতির বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অধিক জনসংখ্যা। মানুষ ঠিকমতো খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অধিক জনসংখ্যার কারণে। দেশের কল্যাণে তথা মানুষের কল্যাণে এখন কিছু পকিল্পনা নেয়া দরকার। জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের জন্য নিম্নে কিছু উপায় আলোকপাত করা হলো:
জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের জন্য দেশের জনসাধারণকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। নারী শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে তাদেরকে বাল্যবিবাহের কুফল সম্বন্ধে সচেতন করতে হবে। বয়স্কদের মাঝে শিক্ষার প্রসার ঘটাতে পারলে কুসংস্কার ও গোড়ামী থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। শিক্ষার মাধ্যমে সচেতনতা বৃািদ্ধ পেলে অনেকাংশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ পাবে।
ছেলে হোক, মেয়ে হোক, দুটি সন্তানই যথেষ্ট জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের এই সরকারি শ্লোগান কার্যকর করতে হবে। এখন একজন মা গড়ে তার বয়সকালে তিনজন করে সন্তান জন্ম দিচ্ছেন। পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম গত কয়েক বছর ধরে বেশ দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। ফলে ৩৫ বছরে দেশের মানুষ দ্বিগুণ হয়েছে। এটা সবারই জানা যে, জনসংখ্যা দেশের একমাত্র সমস্যা। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সঠিক কর্মপরিকল্পনা না নিলে অন্য যে কোন উন্নয়ন পরিকল্পনা সফল করা কঠিন হবে। বাংলাদেশে পরিবার পরিকল্পনা ব্যবস্থাকে আরো জোরদার করতে হবে। জন্মনিয়ন্ত্রক সামগ্রী যেন সহজে পাওয়া যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। পরিবার পরিকল্পনার কর্মীদেরকে গ্রামীণ মানুষের কাছাকাছি পৌঁছে জন্মনিয়ন্ত্রক সামগ্রীর সহজলভ্য করতে হবে।
দেশের মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলে তারা উন্নত জীবন যাপন করতে পারবে। যারা উন্নত জীবন যাপন করে তাদের সচেতনতা সাধারণত বৃদ্ধি পায়। অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা দূর করতে পারলে জনসংখ্যার বৃদ্ধি হ্রাস পাবে। কর্মসংস্থান ব্যবস্থার মাধ্যমে ছোট পরিবার গড়ে উঠলে জনসংখ্যার চাপ অনেকটা কমে যাবে। চীনে প্রায় দেড়শ কোটি মানুষ বাস করে। কিন্তু এই মানুষ কোন সমস্যার সৃষ্টি করছে না। বরং জনশক্তি কাজে লাগিয়ে তাদের জিডিপি বৃদ্ধি করছে। চীন এখন বিশ্বের অন্যতম সুপার পাওয়ার। চীনের মতো আমাদের জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে হবে। এখন সার্বিক অবস্থা মোকাবিলায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি জনসংখ্যা পরিকল্পনা জরুরী। এক্ষেত্রে সরকার বিশেষজ্ঞদের নিয়ে জাতীয় কমিটি গঠন করতে পারেন। না হলে, আগামী দিনগুলোতে আরও কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।
আগত প্রজন্মের জন্য আমাদেরকে বসবাস উপযোগী পৃথিবী গড়ে তুলতে হবে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কাজে লাগাতে না পারলে আমাদের সকল প্রচেষ্টা ধ্বংস হয়ে যাবে। জনসংখ্যা সমস্যার সার্থক ও সফল সমাধানের মধ্যেই দেশের সামগ্রিক কল্যাণ ও উন্নয়ন নির্ভর করছে। বর্তমানে সরকারী ও বেসরকারীভাবে অনেক পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে এবং তার বাস্তবায়নও শুরু হয়েছে। প্রযুক্তি ও শিক্ষার মাধ্যমে বাড়তি জনসংখ্যাকে কর্মমূখী করে জনশক্তিতে রুপান্তরিত করে বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে একটি সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে। তাই যথোপযুক্ত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করে অধিক জনসংখ্যাকে কাজে লাগিয়ে এবং নতুন করে জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধের ব্যবস্থা নিলে জনসংখ্যা নামক বিস্ফোরণ থেকে আমরা মুক্তি পাবো। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তৈরি হবে সুন্দর বসবাস উপযোগী একটি পরিবেশ।
[ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক]