সাহেদের ছবিগুলো কথা বলে, রাষ্ট্রের দায়টাও বলে!
রাশিদুল রাশেদ : যে কথা শত-সহস্র শব্দে ব্যক্ত করা কঠিন, একটি ছবি অনেকক্ষেত্রে তা অনায়াসে বলে দেয়! অতীতেও দিয়েছে। বর্তমানেও দিচ্ছে। ভবিষ্যতে দিবে।
তাই মন্ত্রী, এমপি, বড়-বড় কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, হোমড়া-চোমড়াদের সঙ্গে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদের (সাহেদ করিম) ফ্রেমবন্দি হওয়া হাজারো ছবি স্রেফ ছবি নয়। প্রতারণার এক একটি বিষাদগাঁথা। রাষ্ট্রের দায়ের ফিরিস্তিও।
ইদানিং বাংলাদেশের বিভিন্ন কার্যক্রমের ভেতর প্রতারণা বিষয়টি খুবই লক্ষ্যণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যদিও এ রাষ্ট্রের জন্মের শুরু থেকে বিভিন্নভাবে মানুষ প্রতারণা করে আসছে। সেগুলো আলোচনা করলে বিশদ ইতিহাস রচনা করতে হবে। কিন্তু এ লেখার উদ্দেশ্য মোটেও ইতিহাস রচনা করা নয়। বরং ইদানিংকালে, বিশেষ করে এই মহামারী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের দুঃসময়েও রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সংগঠিত হওয়া বিভিন্ন প্রতারণা, নৈতিকতার সংকট, রাষ্ট্রের উপেক্ষা-এসব নিয়ে একটু আলোচনা করা। কেননা, বাঙালি ছাড়া অন্য কোন জাতি এই কঠিন সময়ে এমন প্রতারণা করেছে কিনা সন্দেহ।
বাংলাদেশের রিজার্ভ খাতে গত মাসেও সবচেয়ে বেশি আয় হয়েছে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স থেকে। কিন্তু এই প্রবাসী বাংলাদেশিদের ইতোমধ্যে ইতালি সরকার ফেরত পাঠাচ্ছে এবং ঢাকা থেকে যাওয়া যাত্রীদের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ায় এক সপ্তাহের জন্য বাংলাদেশ থেকে সব ধরনের ফ্লাইট বাতিল করেছে । গত মঙ্গলবার দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রাণলয় এ ঘোষণা দেয়। বুধবার ইতালির শীর্ষ জাতীয় পত্রিকা দৈনিক ইল মেসসাজ্জেরো-র প্রধান খবর ছিল বাংলাদেশ থেকে ভুয়া করোনাভাইরাস সার্টিফিকেট নিয়ে ইতালি ফেরতদের নিয়ে। এর মধ্যে ইতালির কেন্দ্রীয় অঞ্চল লাৎসিও-র বাংলাদেশি অভিবাসীদের ব্যাপক পরীক্ষার আওতায় আনা হয়েছে। ইতালির রাজধানী রোম একইসঙ্গে এই অঞ্চলটিরও রাজধানী। লাৎসিও অঞ্চলে করোনাভাইরাস মোকবিলায় কর্তব্যরতরা ধারণা করছেন, গত কয়েক সপ্তাহে অন্তত ৬০০ কভিড–১৯ রোগী ইতালিতে এসেছেন। যাদের অধিকাংশই বাংলাদেশ থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে এসেছেন দেশটিতে। প্রতিবেদনটিতে ঢাকায় করোনাভাইরাস সার্টিফিকেট বিক্রির চিত্রও উঠে আসে। এতে বলা হয়, ফ্লাইটে করে দেশ ছাড়তে ঢাকায় সাড়ে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজারের মধ্যে ভুয়া স্বাস্থ্যসনদ বিক্রি হচ্ছে। প্রতিবেদনটিতে ঢাকায় করোনাভাইরাস নেগেটিভ সার্টিফিকেট বিক্রির চিত্রও উঠে আসে।
অনেক অনলাইন এবং পত্রপত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটের ১৬৫ জন যাত্রীকে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি ইতালি। ইতালির রোমের ফিউমিসিনো বিমানবন্দরে কাতার এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে থাকা যাত্রীদের বিমান থেকে নামতে দেওয়া হয়নি। একদিন আগেই ইতালি সরকার ঘোষণা দিয়েছিল বাংলাদেশ থেকে সব ধরনের ফ্লাইট বন্ধ থাকবে। এদিকে কাতার এয়ারওয়েজ জানিয়েছে, এসব যাত্রীকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনবে। অর্থাৎ নোভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মনে করে তাদেরকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোন নেগেটিভ সার্টিফিকেট তারা পাত্তা দিচ্ছে না। কীজন্য বা দিবে পাত্তা! ভূয়া সার্টিফিকেট কি আর পাত্তা পেতে পারে? কিন্তু এই ভূয়া সার্টিফিকেট তৈরি হতো সম্প্রতি বহুল আলোচিত রিজেন্ট হাসপাতালে। ইংরেজি Regent শব্দটির বাংলা অর্থ ‘রাজপ্রতিনিধি।‘ একজন প্রতারক, অর্থলোভী, জালিয়াত কিনা ‘রাজপ্রতিনিধি’।
কদিন আগে পাপুল কাণ্ডে বিদেশ-বিভূইয়ে খোয়া গেছে ভাবমূর্তি। জেকেজি করোনাভাইরাস পরীক্ষার ভুয়া সনদ দিয়ে দেশের মানুষকে ঠেলেছে মৃত্যুর মুখে। সেটা নিয়েও তদন্ত চলছে। কবে শেষ হবে, কে জানে? সাহেদ ও রিজেন্ট হাসপাতালের কাণ্ডে ঘরে-বাইরে ফের ঘোর বিপদের মুখে রাষ্ট্র। প্রতারক, প্রবঞ্চক, সুযোগসন্ধানীদের যথাযথ শাস্তি না দেওয়ার দায়ের বোঝা ক্রমেই বাড়ছে রাষ্ট্রের কাঁধে।
সাহেদ কী করেছে? বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রের সরকারের ক্ষমতাধরদের নিকটস্থ হয়ে সে ছবি তুলেছে; ছবি তোলার সুযোগ কাজে লাগিয়েছে সুনিপুণভাবে। শুরুতে এমএলএম ব্যবসা করে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। এরপর রিজেন্ট হাসপাতাল, পত্রিকাসহ অনেক খাতে বিনিয়োগ করেছে। ক্ষমতার দম্ভে বিনা বাঁধায় দাপিয়ে বেড়িয়েছে। নিজের নামের সাথে প্রয়োজনে যোগ করেছে অনেক পদবীও! আওয়ামী লীগের কেন্দ্রিয় কমিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপ কমিটিতে ঢুকে পড়েছে। সবশেষ নিজের প্রতিষ্ঠিত হাসপাতাল থেকে মানুষকে মুড়িমুড়কির মতো দিয়েছে সর্বনাশের সার্টিফিকেট।
এই ঘোর করোনাকালে প্রতারণায় বহুল আলোচিত রিজেন্ট হাসপাতালের একটি শাখার লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয় ছয় বছর আগে, আরেকটি শাখার তিন বছর আগে। তা সত্ত্বেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে করোনাভাইরাসে (কোভিড–১৯) আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়ার অনুমতি পেয়েছিল রিজেন্ট হাসপাতাল। আবাসিক ভবনে গড়ে তোলা মেয়াদোত্তীর্ণ এ হাসপাতালটির সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার চুক্তি করে। হাসপাতালটির অপকর্ম প্রকাশ পাওয়ার পর পাতাল থেকে উঠে আসছে হাজারো প্রশ্ন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিভাবে এদের সাথে করোনাভাইরাস টেস্টের চুক্তি সমঝোতা করেছিল? তারা কেন খোঁজ নেয়নি? নাকি অভ্যন্তরীণ আলাদা কোন সমঝোতা রয়েছে? মন্ত্রী-নেতাদের সঙ্গে তার কিভাবে এমন সক্ষতা? রাষ্ট্র কি এগুলো দেখে না? আম জনতার মধ্যে এমন নানা প্রশ্ন ও গুঞ্জন চলছে। কিন্তু মিলছে না উত্তর।
কিন্তু এই প্রশ্ন, গুঞ্জন আজ শুরু হয়নি। এই তো কদিন আগে রিজেন্ট হাসপাতালের মতো জেকেজি নামে আরেক ভূয়া প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নোভেল করোনাভাইরাস টেস্টের জন্য চুক্তি করেছিলো। সেখানেও করোনা টেস্টের ভুয়া সার্টিফিকেট তৈরি হয়েছে। জেকেজি তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে মোট ২৭ হাজার রোগীকে করোনাভাইরাস টেস্টের সনদ দেয়। তার মধ্যে আইইডিসিআরের মাধ্যমে ১১ হাজার ৫৪০ জনের করোনার নমুনার সঠিক পরীক্ষা করানো হয়েছিল। বাদ বাকি ১৫ হাজার ৪৬০ রিপোর্ট তারা গুলশানের তাদের কার্যালয়ের ১৫ তলার একটি ফ্লোরে বসে ল্যাপটপে তৈরি করেছিল। খবর বেরিয়েছিল, ওই ফ্লোরে একটি ল্যাপটপ, একটি বিছানা আর টেবিল ছাড়া কোনো সামগ্রী ছিল না। জেকেজির ৭–৮ জন কর্মী দিনরাত ওই ল্যাপটপে বসে ভুয়া রিপোর্ট বানাতেন। কর্মীরা যেন বিষয়টি বাইরে প্রকাশ করে না দেন সেজন্য ভিন্ন কৌশল হাতে নেন ডা. সাবরিনা ও তার স্বামী আরিফ। সপ্তাহে ছয় দিন কাজ করার পর একদিন আনন্দ ট্রিপের নামে ঢাকার বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে একজন নারী একজন পুরুষ কর্মীকে আলাদাভাবে পাঠানো হতো। এটার নাম দিয়েছিল ‘হানিমুন ট্রিপ‘। এমনকি মহাখালীতে তিতুমীর কলেজের মাঠে জেকেজি যে বুথ স্থাপন করেছিল সেখানে প্রায় প্রতি রাতে মদের পার্টি বসত। জেকেজির কর্মীরা রাতভর সেখানে নাচানাচি করতেন। এ নিয়ে তিতুমীর কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে জেকেজির কর্মীদের মারামারির ঘটনা ঘটে।
এ প্রতারণাপ্রবণদের নিয়ে অনেক আগেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আবদুল মান্নান একটি কলামে লিখেছিলেন যে, প্রতারকের স্বর্গরাজ্য ও উর্বর ভূমি হলো এ বাংলার মাটি। তার কাছে জাপান থেকে ভেরিফাই করতে পাঠানো হয়েছিল বেশ কিছু সার্টিফিকেট। যেগুলোর ৯০ শতাংশ ছিল ভূয়া । অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেনি এমনই ছিল বেশির ভাগ! কিন্তু সার্টিফিকেট বানিয়ে জাপানের রাষ্ট্রে অনেকে পিএইচডি গবেষক হয়েছিলেন। পাঠকদের হয়তো মনে রয়েছে– খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম ডিপার্টমেন্টের একজন শিক্ষক ও একজন সাংবাদিকদের পিএইচডি ডিগ্রির গবেষণা প্রতারণা ও জালিয়াতির কথা! প্রতারণার ঘটনা বিশ্বের সব প্রান্তেই ঘটে কম-বেশি। কিন্তু পৃথিবীর আর কোন রাষ্ট্রে করোনাভাইরাস মহামারীকে পুঁজি করে, বিশেষত ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করে প্রতারণা ও জালিয়াতির হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।
এই রাষ্ট্রে অতীতে সংগঠিত প্রতারণার যথোপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত হয়নি বলেই হয়ত আজকে মহামারী করোনাভাইরাস টেস্ট নিয়ে প্রতারণা বাণিজ্য হলো। বাঙালির নীতিনৈতিকতা জ্ঞান নিয়ে ফের উঠল প্রশ্ন। রাষ্ট্রকে তাই নৈতিকতা চর্চা বাড়াতে হবে সর্বক্ষেত্রে এবংনিশ্চিত করতে হবে আইনের যথোপযুক্ত প্রয়োগ। নিরাপত্তা এবং ঘরে-বাইরের ইমেজের স্বচ্ছতার প্রয়োজনে আইনপ্রণেতা, মন্ত্রী, আমলাদের দিকে তাকাতে হবে আরও অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে। ছবি তোলার ছলে কোন প্রতারককে তারা ছায়া দিচ্ছেন, কার কাছ থেকে উৎকোচ নিচ্ছেন, এসবে রাখতে হবে কঠোর নজরদারী। কিংবা নেতা-আমলাদের সঙ্গে ছবি তুলে, তা দেখিয়ে/বিকিয়ে, প্রয়োজনে হুমকি-ধামকি দিয়ে যারা লুটের রাজ্য কায়েম করছে, তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তা না হলে প্রতারণার স্বর্গরাজ্য হবে এ দেশটি!
নেতার সঙ্গে একটি সত্যিকারের ছবি বা ফটোশপে বানানো ছবিও যে অনেক অন্যায়, দুর্নীতির পথ খুলে দেয়, অতীতে এমন ঘটনা আছে ভুরিভুরি। কিন্তু অতীতের ছবিগুলোর কথাগুলো সেভাবে কানে তোলেনি রাষ্ট্র। সাহেদদের জন্মও বাড়ন্ত সে কারণে।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে মন্ত্রী, এমপি, বড়-বড় কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, উকিল, সাংবাদিক ও রাঘব-বোয়ালদের সঙ্গে সাহেদের মিষ্টিমুখ করা ছবিগুলো তাই অতীতের মতো বর্তমানেও অনেক কথা বলছে। রাষ্ট্রের দায়টাও দেখাচ্ছে খুব পরিষ্কারভাবে।
সূত্র :বিডিনিউজ