চলন্ত বিশ্বকোষ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
বয়সের ভারে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সহধর্মিণীকে হারিয়েছেন কিছুদিন আগে। এখন তিনি হাসপাতালের বিছানায়। ইচ্ছে থাকলেও হাতে আর লেখার সামর্থ নাই। প্রতি বছর বাংলা একাডেমিসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বক্তব্য দিতে যিনি আমন্ত্রিত হন তিনি আজ অসুস্থতার কাছে হার মানতে যাচ্ছেন। বই নিয়ে পড়বেন এমন সামর্থ হারিয়ে ফেলেছেন। তবুও পড়ার জন্য নতুন নতুন বই চান। কাগজের উপর নতুন কিছু লেখবেন বলে উঠে বসার চেষ্টা করেন। তিনি অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ দিবসের কথা ভুলতেন না। কবি জসীম উদ্দীন হাসপাতালে দেখতে গেলে তিনি উঠার চেষ্টা করেন এবং বলেন আজ একুশে ফেব্রুয়ারী। আমি আজ আলোচনা সভায় অংশ নেবো আমার ব্যাগটা গুছিয়ে দাও। নিশ্চয় জানার ইচ্ছে করে এ মহৎ ব্যাক্তিটি কে? এ মহৎ ব্যাক্তিটি ছিলেন বহুভাষাবিদ ও চলন্ত বিশ্বকোষ হিসেবে পরিচিত ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ।
১০ জুলাই ১৯৮৫ সাল শুক্রবার। চব্বিশ পরগানা জেলার বশিরহাট মহকুমার পেয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এই জ্ঞানতাপস। বাবা মফিজুদ্দীন ছিলেন একজন ভাষাবিদ। তিনি চার পাঁচটা ভাষা জানতেন। সাত ভাইবোনের মধ্যে ষষ্ঠ ছেলে হয়ে পরিবারে কতটুকু আনন্দ দেবে তা শহীদুল্লাহর জন্মের পর বোঝা যায়। জন্মের পর আনন্দের শেষ রইলো না। আকিকা দিয়ে নাম রাখা হলো ইব্রাহিম। কিন্তু মা হুরুন্নেসার খাতুনের এটি পছন্দ হলো না। মা ডাকতেন শহীদুল্লাহ বলে। খুব হাসিখুশি চেহারার বলে পাড়ার অনেকেই জ্ঞানতাপসকে সদানন্দ বলে আহ্বান করতেন। কিন্তু তিনি নিজেকে পরিচয় দিতেন জ্ঞানানন্দ স্বামী বলে। এর অর্থ যে জ্ঞান লাভ করে আনন্দ পায়।
ছোট থেকেই একটু দুষ্টু ধরণের ছিলেন শহীদুল্লাহ। প্রায় দিন বাবার কাছে নালিশ নিয়ে আসতো পাড়ার ছেলেরা। বড় সংসারে সাত ভাইবোন মিলে সারাদিন হৈচৈ করে কাটতো। ছোটতে স্কুল যাওয়া হয়নি তাঁর। ছেলে বড় হচ্ছে এবং তাঁর মধ্যে প্রতিভার লক্ষণ পাওয়া যাচ্ছে । বাবা চিন্তা করলেন দ্রুত শহীদুল্লাহকে স্কুলে ভর্তি করা দরকার। তাই দশ বছর বয়সে পড়তে যান হাওড়ার ইংরেজী স্কুলে। সেখান থেকে পাশ করে হাওড়া জেলা স্কুলে ভর্তি হন ১৮৯৯ সালে। কে জানতো এ দুষ্টুর মধ্যে অনেক প্রতিভা লুকায়িত আছে। এই দুষ্টু ছেলেটি এক সময় ভাল ফলাফল করে সবাইকে চমকে দিলেন। সপ্তম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষায় ভাল ফলাফলের জন্য অর্জন করেন রুপার পদক। বাবার সব চিন্তা দূর হলো শহীদুল্লাহ ভাল ফলাফল করেছে বলে। ছোট থেকেই ভাষার প্রতি ছিল তার প্রবল আগ্রহ। তিনি নিজেই আঠারোটি ভাষা জানতেন এবং মনে করতেন নতুন একটি ভাষা শেখা অর্থ একটি দেশ জয় করা। তাই ছেলেরা যখন খেলাধুলায় ব্যস্ত তখন এই জ্ঞানতাপস ভাষাবিজ্ঞানী নিজে নিজেই বাড়িতে ভাষা চর্চা করতেন। লাটিম ঘোরানো, ঘুড়ি ওড়ানোর চেয়ে তিনি ভাষা চর্চায় বেশি আনন্দ পেতেন।
স্কুল শিক্ষকের মারের ভয়ে ফার্সি না নিয়ে সংস্কৃত নিলেন। তবে তিনি বাড়িতে স্কুল বয়সেই ফার্সি, উড়িয়, হিন্দি, উর্দু ভাষায় দখল এনেছিলেন। স্কুল জীবনে বাংলা ও ইংরেজিতে যেকোন বিষয়ে লেখতে পারতেন। অষ্টম শ্রেণীতে শিক্ষক নারিকেল গাছ সম্বন্ধে ইংরেজীতে একটি প্রবন্ধ লেখতে বললে সবার আগে সুন্দর করে লেখে ফেলেন। এমন সুন্দর প্রবন্ধ দেখে শিক্ষক বিশ্বাস করতে পারেনি এটি শহীদুল্লাহ লেখেছেন। তিনি ক্লাসে বরাবরই ১ম বা ২য় স্থান অধিকার করতেন। ক্লাসে শতাধিক ছাত্র থাকলেও মুসলমান ছিল কেবল তারা দু’জন। দু’বছর পর তার সহপাঠী আব্দুল হামিদ পাকিস্তানে চলে যায়। ফলে তিনি মুসলমান হিসেবে পড়ে যান একা।
ছোট থেকেই শহীদুল্লাহ ছিলেন ধার্মিক। তবে ক্লাসের হিন্দু সহপাঠীদের সাথে ছিল তার গলায় গলায় ভাব। ভাই গিরিশচন্দ্রের কুরআন শরীফের বঙ্গানুবাদ ও তাপসমালা এবং মুহাম্মদ চরিত পড়ে ধর্মের প্রতি তার অনুরাগ গাঢ় হয়েছিল। নামাজ পড়ার অভ্যাস ছিল তার ছোট থেকেই। হিন্দু ছেলেদেরকে পেছনে ফেলে তিনি পরীক্ষায় প্রথম হলে সহপাঠীরা পণ্ডিতকে খেপাবার জন্য বলে “স্যার, আমরা বামন-কায়েতের ছেলে থাকতে, আপনি ঐ মুসলমান ছেলেটাকে বরাবর ফাস্ট করে দেন, এ আপনি অন্যায় করেন স্যার। তাতে তিনি বলেন, “আমি কি করবো ও সিরাজুদ্দৌলা লেখে ভাল; তোরা তো তেমন লেখতে পারিস না। পণ্ডিত মশায় শহীদুল্লাহ নাম মনে রাখতে পারতেন না বলে তাকে সিরাজুদ্দৌলা বলে ডাকতেন।
এন্ট্রাস পাশ করে ১৯০৪ সালে গিয়ে ভর্তি হন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে। এখানে তিনি যা পড়তেন তা নিজের স্মৃতিতে গেঁথে রাখতেন। ঠিক দুই বছর পর এফ. এ পাশ করে সংস্কৃতে অনার্স পড়ার জন্য হুগলি কলেজে ভর্তি হন। অনার্স শেষে মাস্টার্স করার জন্য চলে গেলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তুু সংস্কৃতের ক্লাসে হিন্দু ধর্মগ্রস্থ বেদ পড়ানো হয় বলে এক গোঁড়া অধ্যাপক বেঁকে বসেন। তিনি ঘোষণা করেন হিন্দু ছাড়া কেউ বেদ পড়তে পারবে না। তাই শহীদুল্লাহও তা পড়তে পারবেন না। বাধ্য হয়ে অন্যান্য শিক্ষকের পরামর্শক্রমে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯১২ সালে এ বিষয়ে তিনি এম. এ পাশ করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ।
এবার কর্ম জীবনে নামার পালা। কারণ সারা জীবন শুধু পড়ালেখা করলে পেটতো আর মানবে না। কিন্তুু সে সময় ইংরেজ সরকার মুসলমানদেরকে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চাকুরি দেয়ার ক্ষেত্রে অনেক বিপরীত কাজ করতো। তাই শহীদুল্লাহ বাধ্য হয়ে কলকাতার এক মুসলিম এতিমখানায় ম্যানেজারি করতে লাগলেন। কিন্তুু তার পড়াশোনা একটুও কমলো না। চাকুরির পাশাপাশি তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে ভর্তি হয়ে গেলেন। চাকুরির সাথে সমান তালে তাঁর আইন চর্চা অব্যাহত থাকলো। ১৯১৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বি. এল পরীক্ষায় পাশ করলেন।
এবার দেশে ফিরে চট্টগ্রামে শুরু করলেন ওকালতি পেশা। মাঝখানে হাইস্কুলের এক বছর হেডমাস্টারিও করেছেন। আইন পেশায় থাকাকালে তিনি অসংখ্য গরীব, হতভাগ্য দরিদ্র মুসলমানকে আইনী সহযোগিতা দান করেছেন। এখানেও তাঁর সাহিত্য চর্চা একটুও কমেনি। দেশ বিদেশের বিভিন্ন পত্রিকা তার প্রবন্ধ ছাপতে থাকলো। দিকে দিকে তার নাম ছড়িয়ে পড়লো। তবে উকিল হিসেবে নয় পণ্ডিত হিসাবে। বাংলা পত্রিকা কোহিনুর, সংস্কৃত পত্রিকা ভারতীতে তিনি নিয়মিত কবিতা-প্রবন্ধ লেখতে লাগলেন। অন্যান্য মুসলিম সাহিত্যিকদের নিয়ে গড়ে তুললেন বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতি।
১৯২১ সালে ঢাকায় গড়ে ওঠে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবার জন্য দেশবিদেশের নামকরা পণ্ডিতদের ডাকা হয়। ইতহাসে রমেশচন্দ্র মজুমদার, রসায়নে জ্ঞানচন্দ্রঘোষ, পদার্থবিজ্ঞানে সত্যেন সেন। জ্ঞানতাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকেও ডাকা হয় বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগে ক্লাস নেয়ার জন্য। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক হিসেবে ২ জুন ১৯২১ সালে যোগদান করেন। শিক্ষকতার সাথে সাথে এখানে বিভিন্ন আবাসিক হলের দায়িত্ব পালন করেন। আইন বিভাগের খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
শিক্ষকতা করার সময়ও ভাষা শিক্ষার জন্য ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছুটে গেছেন। প্যারিসের সোরবান বিশ্ববিদ্যালয়ে দুনিয়াজোড়া নামকরা পণ্ডিতদের কাছ থেকে তিনি শেখলেন নানান ভাষা। সেখানে ওড়িয়া, নেপালি, মালদ্বীপি, মারাঠি, গুজরাটি ভাষা শেখার পর ছুটি হলে চলে গেলেন জার্মানিতে। ভর্তি হয়ে গেলেন ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানেও তিনি অনেক কিছু শেখেন। ছুটি শেষে সোরবান বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার সবচেয়ে পুরোনো কবিতা সম্পর্কে দুই বছর গবেষণা করে ডক্টরেট উপাধি অর্জন করেন। ফিরে আসেন দেশে, যোগদান করেন শিক্ষকতার মহান পেশায়। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করেছেন। বগুড়া আজিজুল হক কলেজে তিনি দীর্ঘ চারটি বছর অধ্যাপনা করেছেন। ১৯৫৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে তিনি এখানে বাংলা বিভাগে যোগদান করেন।
ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন সর্বদা কর্মব্যস্ত মানুষ। তার ব্যস্ততা কেবল সাহিত্য আর লেখালেখি নিয়ে। শত সমস্যার মাঝেও তিনি লেখে গেছেন অনেক কিছু। বাংলা ও সংস্কৃতে অনুবাদ করেছেন বিভিন্ন রচনা। প্রবন্ধ গ্রন্থ- ভাষা ও সাহিত্য, গল্পগ্রন্থ’- রকমারি, এছাড়াও দুখণ্ডে প্রকাশিত আঞ্চলিক ভাষার অভিধান রচনা করেছেন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি অনুবাদ করেছেন ইকবালের কবিতা, উমর খৈয়ামের রুবাই। সম্পাদনা করেছেন ইংরেজি মাসিক পত্রিকা চবধপব, তকবীর, বঙ্গভূমিক ইত্যাদি।
শিশুদেরকে ভালবাসে না এমন মানুষ খুব কম আছে। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ শিশুদেরকে ভালবাসতেন এবং হাসি-তামাসা করতেন সব ধরণের মানুষের সাথে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাকালে ছাত্ররা তাকে নানা বলে সম্বোধন করলে তিনি উত্তরে বলতেন নাতী কেমন আছো? ছাত্রদের সাথে তিনি রসিকতায় মেতে উঠতেন। শিশুদের জন্য তিনি লেখেছেন অনেক কিছু। শিশুরা যেন সহজেই বুঝতে পারে তাই রচনা করেছেন অত্যন্ত সহজ করে। তিনি লেখেছেন ছোটদের রাসুলুল্লাহ, সেকালের রুপকথা, এছাড়াও বিভিন্ন মজাদার বই। তিনি শিশুদের জন্য আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ ও ছবিযুক্ত মাসিক আঙ্গুর পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। এখানে লেখেছেন শিশুদের জন্য মজার মজার হরেক রকম লেখা ।
ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন একজন পরহেজগার মানুষ। তাঁর শরীরে সর্বদা পায়জামা-পাঞ্জাবি থাকতো। মাথায় ছিল একটা টুপি। ধর্মের প্রতি ছিল তাঁর অসাধারণ ভক্তি। তাঁর চোখের ক্ষমতা ও মেধা ছিল তীক্ষ্ন। কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করতেন খুব সুন্দরভাবে আর অর্থ বুঝে নিজের জীবনে বাস্তবায়নের চেষ্টা করতেন। নামাজ-রোজায় কখনো তিনি অবহেলা করতেন না। মসজিদে ইমামতিও করতেন। কোন ধর্মীয় আলোচনা বা জালসা হলে ছুটে যেতেন সবার আগে। বহুকাল থেকে তিনি ইচ্ছে পোষণ করতেন হজ্জ করার। তাঁর সে ইচ্ছেও পূরণ হয়েছিল ১৯৫৫ সলে।
দুবছর কঠিন অসুস্থ হয়ে অবশেষে ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ জ্ঞানতাপস ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। জুলাই মাসে যার জন্ম ঠিক জুলাইয়ে তিনি দুনিয়া থেকে চলে যান। মুত্যুকালে তার বয়স ছিল ৮৪ বছর। তাঁর প্রিয় প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে সমাহিত করা হয়। যতদিন বাংলা ভাষা ও বাংলাদেশ থাকবে আমরা ততদিন তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবো।
লেখক: শাহাদাত আনসারী
[ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক]