অনুভূতির বন্ধু, করোনা!
মুন্নী সাহা : করোনা নিয়ে আমার প্রথম অনুষ্ঠানটির শিরোনাম দিয়েছিলাম ‘ভয় করোনা’। করোনাকে ভয় নয়, জয় করতে যাতে পারি, তারই ডাক। তখনো এক্কেবারে নতুন। মানে বাংলাদেশে ল্যান্ড করেনি করোনা। অন্যদেশে হাজারে বিজারে মৃত্যুর খবর দিচ্ছি। ভয়বিলাসী আর ভয়ের ব্যবসায়ীরা আমার এই করোনাকে ‘ভয়’ না-করার অভয় আচরণকে বালখিল্য-চটুলবাজি বলে আড়ালে-আবডালে সমালোচনা করছিল। চির-ফাঁকিবাজ কলিগদের কাছে আমি, এম্নিকালে-স্বৈরাচার, আর করোনাকালে ‘অমানবিক’ বিশেষণে ভূষিতা। করোনা শুরু হতে না হতেই অন্যসব গণমাধ্যমে ছুটি, সপ্তাহে ২ দিন বা ৩ দিনের ডিউটি রোস্টার উদাহরণ টেনে এটিএন নিউজ, মানে নিজেদের অফিস নিয়েই দীর্ঘশ্বাসের স্ট্যাটাস দেওয়া শুরু করল। অ্যাজ ইফ, পালিয়ে থাকলেই করোনামুক্ত থাকা যায়, আর আমি সেটা হতে দিচ্ছি না। এমনি অবস্থায়, সবার জন্য সুসংবাদ বয়ে নিয়ে এলো, সহকর্মী আশিকুর রহমান অপু। ৪০০ কর্মীর এটিএন নিউজ… এক ঝটকায় ৩৪ কর্মীতে নামল। অন্য টিভির বন্ধুরা, সহযোগিতার হাত বাড়াল। করোনাকালে কোনো প্রতিযোগিতা নেই, যেন বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে বড় ইনভেস্টমেন্ট। যারা করোনা ছুটি চাইছিলেন, তারা মেঘ না চাইতেই আইসক্রিম পেয়ে, ‘ঘরে থাকুন সুস্থ থাকুন’ আওয়াজ তুলছিলেন। কিন্তু জীবন তো ২৪/৭-এর। কোলাহলের। ঘামের গন্ধের। লড়াইয়ের। সবাই মিলে বেঁচে থাকার… বাঁচিয়ে রাখার! এই অভ্যস্ততায় গলাগলি করা বাঙালির ওপর কিছু ইম্পোর্টেড কনসেপ্ট চাপিয়ে দেওয়া হলো সোশ্যাল ডিসটেন্সিং, স্যানিটাইজার, কন্টাক্ট ট্রেসিং, মাস্ক, হাইজিন ইত্যাদি।
মনে মনে করোনাকে পাত্তা না দিলেও, সব শেয়াল যখন হুক্কাহুয়া করছে একযোগে, ইম্পোর্টেড সুরে… তখন আর স্রোতের বিপরীতে লড়াইটা সহজ হয় না। তবুও চেষ্টা করে গেছি… যাচ্ছি, ‘যশ্মিন দেশে যদাচার’ থিউরিতে করোনাকে মেনে নিতে টেনে নিতে। করোনা ভাইরাসটা বোধহয়, এটাই চেয়েছে বা চায়… মেনে নেওয়া, আদরে টেনে নেওয়া। এনজিওর ভাষায় যেটাকে বলে adaptation..
কিন্তু, করোনা যেহেতু অবিশ্বাস আর ভার্চুয়াল নেশার ঘোরের সময়ে এসেছে… জীবন নয়, জীবিকার আধিপত্যের বিশ্বব্যবস্থার সময়ে এসেছে, যুক্তি নয়, ভয়ের ব্যবসার সময়ে এসেছে… তখন অপরচুনিস্টরা ছেড়ে দেবে কেন? করোনা দিয়ে কেউ ৎবমরসব বদলাবে, করোনা বেচে কেউ বিশ্বের ১ নম্বর ধনী হবে… এই তো? কারণ, করোনা একটি অদৃশ্য ভাইরাস, অদৃশ্য বলেই এর শক্তি সম্পর্কে কোটি কোটি মতবাদ, আর আমরা, অজ্ঞ-যুক্তিহীন-স্ক্রিনটাচ্ জেনারেশন মাথাটা গলিয়ে তো বসেই আছি।
এমনি একটি সময়ের পুরোটা মুহূর্ত উপভোগ করার নেশায় বুঁদ হয়ে রইলাম। একটি বেলাও করোনার ভয়ে পালাইনি, ঘরে বন্দি থাকিনি, কাজ বন্ধ করিনি। তবে হ্যাঁ… আমার এই বুঁদ হয়ে থাকার সঙ্গে পরিপার্শ্বের বুঁদ হওয়াটার আকাশ-পাতাল পার্থক্য। চারদিক ‘ভয় বিলাসে’ বুঁদ। আমি করোনাকে ভয় করি না বলে যতই স্বাভাবিকে থাকতে চেয়েছি, চারদিকে সন্দেহ-অবিশ্বাসের চোখ, আমার ভব্যতাবোধকে উসকে দিতে বাধ্য করেছে। ফলে, চলাচলে সীমিতকরণ, বেড়ানো, ঢাকার বাইরে কাজে যাওয়া সবটাতেই সীমিতকরণের সমীকরণে পড়ে গেছি। এই ফর্মুলায়, যাদের করোনায় ভয় নেই, তারাই করোনাকালে কর্মক্ষেত্রে প্রাণের স্পন্দন দেওয়ার দায়িত্বে। অন্যরা যখন ‘ভয়-ভ্যাকেশনে’, তখন আমাদের মতে ৪০০ তে ৩৪ জনের ডিউটি আওয়ার ২৪/৭। এটাকেই অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। টের পেলাম, মাল্টি টাস্কিং-এর জমানা আসছে। স্লিম-স্লিক-আইডিয়া অফিস, মানে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা। মনে মনে বললাম থ্যাংক ইউ করোনা…
প্রায় সাড়ে তিন মাস, করোনায় করণীয় নিয়ে কপচানো অব্যাহত রেখেছিলাম। এর মধ্যে অনেক যুক্তি, অনেক তক্কো!
করোনাকালের শুরুতেই যে স্ট্যান্ড আমার ছিল অর্থাৎ করোনা যতটা না ভাইরাস, তারচেয়ে বেশি ধারণা, সেটাই ‘বিটুইন দ্য লাইন’ রেখেই।
কখনো মনে হয়েছে, সুপরিকল্পিত ভাবে একটি সাময়িক ফ্লু বা ভাইরাল ওয়েভকে, ২১ শতকের ‘সেলফি’ অভ্যাস, ভাইরাল পলিসি, যুক্তিহীন মনের মিশেলে এক চিমটি ভয় মিশিয়ে ঘুটা দেওয়া রেসিপি বাজারে ছেড়ে দিয়েছে কেউ… তারপর এর ডালপালা, অর্থনৈতিক সেটব্যাক্… নানান কিছু।
আবার মনে হয়েছে হয়তো মাথায় মুকুট পরা রাজদর্শনের কাঁটাওয়ালা কোনো অণুজীব… যে মানুষের সঙ্গে সহাবস্থান চায়।
এই নানান কিছুতে ভালো যেমন, মন্দও কম নয়। মনে করতে পারি, বাংলাদেশে করোনা ছোঁয়ার ১ মাস পূর্ণ হওয়ার দিনটি। ৮ এপ্রিল। ড্রোন ক্যামেরা নিয়ে সারা শহর চষে বেড়ানো। আইল্যান্ডের জংলা গাছগুলোতে ফুল, রমনা পার্কে হলুদ বসন্ত পাখি, নীরব-নিথর পরিচ্ছন্নতায় প্রকৃতি যেন দম পেল। গোটা বিশ্বে একই রূপ। আর, অন্যদিকে ওয়ার্ল্ডোমিটার গরম হচ্ছে, আজ ১ লাখ তো পরশু ৩ লাখ মানুষের মৃত্যুর খবর, সারা বিশ্বে।
করোনা তো, ফ্লু… অর্থাৎ একগুচ্ছ ভাইরাসের মধ্যে ১টা, কভিড-১৯। কিন্তু গুচ্ছের অন্যরাও তো নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়… ফ্লু নামে। ফ্লুতে কেউ কি মরে? সহকর্মী সাদাত হাবীবি সেতু, নীশিথ সূর্য্য, আহমেদ রাব্বি তানিমকে নিয়ে খোঁজ লাগালাম, এই করোনা উপসর্গ মানে জ্বর-কাশি-শ্বাসকষ্টে, আগের আগের বছরগুলোতে মৃত্যুর পরিসংখ্যান কী? নেই। এমনকি, উত্তর ইতালির লুম্বার্ডের হাসপাতাল, যেখানে বুড়ো মানুষরা বেশি মরেছেন, সেখানে কোনো পরিসংখ্যান নেই, আগের বছর সর্দি-কাশিতে কতজন মারা গেছে। নিউইয়র্ক, লন্ডনের পরিসংখ্যানও খুঁজে পাইনি গুগলে। দেখা যাক, দেশে কী অবস্থা?
প্রতিদিন, মেডিসিন-রেস্পিরেটরি বিশেষজ্ঞদের ইন্টারভিউ করি। একটা কমন প্রশ্ন, কৌতূহল… জ্বর-কাশি-সর্দিতে প্রতি বছর কত লোক মারা যায়?
প্রায় শত ভাগ চিকিৎসক উত্তর দিয়েছেন… এগুলোর তো কোনো রেকর্ড নেই। কিন্তু মারা তো যায়? তাই না?
জ্বর-কাশি-সর্দিতে মরে না, অন্য উপসর্গের সঙ্গে এই ইনফ্লুয়েঞ্জা-নিউমোনিয়া সহায়ক, সে কারণে রেকর্ড নেই। রাখি না। তাহলে, করোনাকালে, একজন দীর্ঘদিন ক্যানসারের রোগীর, জ্বর-কাশি উপসর্গ যদি থাকে এবং মারা যান, তাহলে সেটা করোনা না ক্যানসার?
ক্যানসারের চিকিৎসক স্পষ্ট জানালেন, করোনার প্যানডেমিক না থাকলে, ওটা ক্যানসারে মৃত্যু হয়েছে… এবার, দুই হেড-এ যাবে। ক্যানসার এবং করোনার মৃত্যুর পরিসংখ্যানে।
কেমন উল্টাপাল্টা লাগে? তাহলে এটা তথ্য-তত্ত্বের বিরাট খেলা… আমার মিডিওকার ব্রেইনে তা কুলায় না। লড়াইয়ে যুক্তিবাদী বন্ধু খুঁজি… সহযোদ্ধা খুঁজি, গুরু খুঁজি… নেই! এটাও একটা করোনাকালীন প্রাপ্তি! একা একা আওড়াই… খেলিছো এ বিশ্ব লয়ে, বিরাট শিশু আনমনে। অবশ্য, বড় বড় ফিলোসফাররা একে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পথের খেলা হিসেবে মন্তব্য করা শুরু করেছেন।
সে যাক্গে… আমি তো করোনাকাল উপলব্ধির আবেশে আছি! মায়া-মমতা-স্বার্থপরতা-উদারতা-কৃতজ্ঞতা-অকৃতজ্ঞতা সব নতুন রূপে, নতুন চেহারায়। বিরাট আধিপত্য… দম্ভ, হামবড়া সব ওভার নাইট ধুলোয় মিশে… কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নিয়ে, এয়ারক্রাফটে হোটেল বানিয়ে বসে আছে অনেকে… কিন্তু, উড়ছে না জীবনের গাড়ি। টাকা? কয়েক টুকরো কাগজ ছাড়া আর কী! এই বোধ হাতেনাতে ধরিয়ে দিল। এদেশে কেবল ধনী-গরিবের বিভেদ রচিত হলো অন্য ভাবে… টাকা নয়, সাহস বাঁচায় করোনার হাত থেকে। পরিসংখ্যানে দেখা গেল, এখনো পর্যন্ত নিম্ন মধ্যবিত্তের মানুষ কম মারা যাচ্ছে করোনায়। আমাদের রোকসানা বুয়ার ডায়লগ… ‘আমগো এলাকায় হমানে মাইনসের ডায়রিয়া হইতাছে, এট্টু জ্বর জ্বর… ফেলাজিল খাইয়াই ভালো। আল্লায়ই গরিবরে রহম করতাছে। আর আপনের অনুষ্ঠানে প্রত্যেকদিন ডাক্তাররা ডর দেহায়, হাগা হইলেও করোন্না! তয় বেটারা, তরা মরছ ক্যা?’
রোকসানা বুয়া ঠিকই বলেছে ডর!! ডর দেখানো… ইম্পোর্টেড ডর। ডরের গাইডলাইন আসছে বিশ্ব সংস্থার কাছ থেকে। যে দেশের যে আচার… সে লাইনের ধার ধারবে না বড় বড় বিশেষজ্ঞরা। কারণ এতে, করোনা মোকাবিলা ফান্ডের নামে হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য, অসুস্থ মন্ত্রণালয়ের হাতছাড়া হয়ে যাবে। ফলে এই দুষ্ট চক্রের বাইরে হঁাঁটলে সিনিয়ররা নাজেহাল হবেন। ভেন্টিলেশন-আইসিইউ বাবদ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য নষ্ট হয়ে যাবে, এটা করোনা ব্যবসায়ীরা মানবে কেন?
আর সামান্য একটি কাপড়ের মাস্ক করোনা থেকে দূরে রাখতে পারে সবাইকে, এর প্রমাণ ছাড়া শুনবে মানুষ? যতই বলি না কেন, বিশ্বে ৮৫ ভাগ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে বুঝে ওঠার আগেই সুস্থ হয়ে যায়, সৈয়দ মুজতবা আলীর থিওরি… সর্দি… ওষুধে সারবে ৭ দিনে, না অষুধে ১ সপ্তাহে। এই, ‘বোঝে না সে বোঝে না’র করোনাকালে, করোনা হওয়ার কোনো রকমের অভিজ্ঞতা ছাড়া কমিউনিকেটর বা সংবাদকর্মীর কথাও কেউ বিশ্বাস করছে না, শুনছেও না। শতবর্ষের একবারের মহামারীকালের সংবাদকর্মী হিসেবে নিজেকে অপ্রয়োজনীয় লাগছিল, যতই মাস্ক পরার ক্যাম্পেইন করি না কেন… ভয় না করার কথা বলি না কেন!
ভয়বিলাসীরা এমন কুদৃষ্টিতে আমার এই আকুতির দিকে তাকান, বা তাকাতেন… যার অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, ‘তুই বেটি করোনার কী জানিস! করোনা আওয়ামী লীগের সৃষ্টি, ডা. আবদুল্লাহর মতো কইরা ভয় না করার কথা কস! আওয়ামী লীগের দালালি?
অবশ্য দেশে তো এখন ‘আও-আম’ ছাড়া কেউ নেই! কাঁঠাল ছেড়ে ‘আও-আম’ পার্টিবাজরা, করোনা ক্রাইসিস সৃষ্টি করেছে সেটা সত্য। অন্তত আমার মতো একজন দুই টাকার রিপোর্টারের মতে। ক্যামনে? সোকল্ড- পিপিই’র নামে হুজ্জতি শুরু, যারা কোনোদিন পিপিই চক্ষে দেখেনি, যারা জীবনেও একজন সাধারণ মানুষের চিকিৎসা করেনি, তারা ক্রাইসিসের প্রথম ইন্সটলমেন্ট হাজির করে পিপিইর নামে। যেটা তারা খুলতে-পরতে জানে না, জীবনে দেখেওনি। তারপর, ছুটি ডিস্টেন্সিং, রেড জোন, লকডাউন, অক্সিমিটার, আইসিইউ, আরটিপিসি নানান বোধ্য-অবোধ্য শব্দ দিয়ে ভয়ের প্রোডাক্ট বিক্রি শুরু করল। বলা যায় বাটপারি। এখন… বাটপারদের হাতে করোনা বাটপারি চলছে চলবে…!
পরিস্থিতি যখন এমন জটিল, তখন লড়াইয়ের জন্যও করোনা চাই। সেই মুকুট পরা ভাইরাস। কিন্তু, চাইলেই করোনা হয় না। ভাইরাস লোড লাগে। গত সাড়ে ৩ মাসের অভিজ্ঞতায় তাই-ই বলে। কারওয়ান বাজারের মতো একটা জনবহুল এলাকার ২৪ ঘণ্টার অফিসে, শুধু মাস্ক ব্যবহার করে হাত ধুয়ে, পরিচ্ছন্ন থেকে, আমরা প্রায় সবাই করোনা থেকে মুক্ত থেকেছি।
পরিবারের সদস্য, রামেন্দ্র সুখন চোখে কনজেন্টিবায়োটিস-এর উপসর্গ নিয়ে, এক বিছানায় গড়াগড়ি না করলে, আমার আক্রান্ত হওয়ার সুযোগ হতো না, এত সহজে। মনে মনে করোনার অভিজ্ঞতাটা চাইতাম, এবং প্রথম শিক্ষা হলো ভাইরাস লোড। অর্থাৎ গলাগলি করে ভাতিজার সঙ্গে আড্ডাবাজি, রাতের মুভি দেখা এগুলোর সময়ই শ্বাস-কথা বা ঝালমুড়ি বাদাম খাওয়া থেকে ভাইরাসটা বেশি মাত্রায় নিয়েছি। এবং সুখন পজিটিভ শনাক্ত হওয়ার ৫ দিনের মাথায়ই আমার হালকা জ্বর।
পেয়ে গেলাম, কাক্সিক্ষত করোনার স্বাদ! হ্যাঁ… স্বাদ! আহা স্বাদ।
নাকটা নিয়ে আমার মা প্রায়ই ঠাট্টা করে আমাকে… ‘এ্যাঁ আইছে এক নাকওয়ালি! ঘরে ঢুইক্কাই চেঁচাইতে থাকে, এটা নষ্ট, ওইটা পঁচা, মাছ কাটছে কে… কাঁঠাল আনছে কে’?
মায়ের এই খোঁচামারা ডায়লগের ভেতরই লুকিয়ে আছে আমার গন্ধবাতিকগ্রস্ততা। সুন্দর করে বললে, সার্প সেনসেশন। জিব্বাটার ব্যাপারেও তাই। লবণ-চিনি তেতো টক সব মিশিয়ে দিলেও চেখে বলতে পারি, কোনটা কী? এটা একটা ব্লেসিং। অনেকেরই এই বোধটা ভোঁতা। তার ওপর অনুভূতির অনুভব। বিশেষ বিশেষ ঘটনা, কখনো কোনো আবেগি মুহূর্তে কানের নিচে গলার কাছটা তিড়তিড় করা। অনভিজ্ঞ আমি, ডাক্তারও দেখিয়েছি, সেই তিড়তিড়ানি কেন হয় জানতে। ডাক্তার মুচকি হেসে বলেছেন… ‘আপনি সেনসিটিভ মানুষ, সব ইন্দ্রিয়ের সবটাই বুঝতে পারেন। এমনটাই থাকুন, আমাদের সাংবাদিক’!
এই টমবয় মার্কা আমি, আহ্লাদিত হয়ে একটু লালচে হয়েছিলাম কি না নিজেরটা নিজে দেখিনি, তবে মনে মনে রবিঠাকুরের গান… ‘কেন প্রেম দিলে প্রাণে’!
আমার কনফিডেন্সের জায়গা এটাও, সহজে ভয় পাই না আর রূপ-রস-গন্ধ-অন্ভুূতির অনুভব। অনেকের চেয়ে বেশি ধারালো, শিক্ষিত, শিল্পিত।
হঠাৎ হালকা জ্বরে চেনা রেগুলেটরের সঙ্গে অনুভব মেলে না! একি! করোনার রূপ?
সিনিয়র চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বললাম। তাদের সব কটা গৎবাঁধা প্রশ্নের সবটারই উত্তর… ‘না’। মানে জ্বর ১০২ না, কাশি না, গলা ব্যথাও না, শ্বাসকষ্টও নেই। উনারা সবাই, অনুভব অনুভূতি নিয়ে হাসলেন, করোনা নয়, নিশ্চিত করলেন। তবুও নিশ্চিত করোনা আক্রান্ত ভাতিজার সঙ্গে শোয়া-বসা আড্ডা মারার দোষে দুষ্ট আমি কারও জন্য বিশেষ ঝুঁকির কারণ হতে চাইনি। বিশেষ করে মা। ৭৬ বছর বয়সি আমার অবাধ্য অবুঝ কিশোরী মা। দূরে দূরে থাকো, না ছুঁয়ে থাকো বললে যে কোনো গ্রামারে মেলাতে পারে না। তাই টেস্টের জন্য গেলাম। গেলাম তো গেলাম… এক্কেবারে চলে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটল। ঐ যে ঢেঁকি! পিপিই পরে যখন হাসপাতালে করোনা পরীক্ষা করাতেই গেলাম, কত মানুষের কত রকম অসুবিধা… নিই না মাইক্রোফোনটা হাতে! জুনের শেষের ভ্যাপসা গরমে ৩/৪ ঘণ্টা পিপিই’র সেই হ্যাজামাত পোশাকের ভেতর শরীরটা নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না, তার ওপর ভেতরে করোনার ছোবল। হাসপাতালের করিডরে অজ্ঞান হয়ে গেলাম। যখন জ্ঞান ফিরল, পুরো সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল যেন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে শঙ্কায়। সেলাইন চলছে। অক্সিমিটারে স্যাচুরেশন দেখতে দেখতে হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. মামুন বললেন… দিদি একটু সাহস ডোনেট করে যান, আপনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন নরমাল। আপনি ভয় পাননি, করোনা আপনারে কিচ্ছু করতে পারবে না… চলেন, ওঠেন। বাসায় গিয়ে বই পড়েন।
এই স্পোর্টিং মুডের চিকিৎসকের অভয়বাণী অল্পতে বুঝিয়ে দিল, অক্সিজেন কত কারণে ওঠানামা করতে পারে, আর করোনা আক্রান্তের জন্য প্রথম ফ্যাক্টর… ভয়। ভয়ে অর্ধেক মরে, বাকি অর্ধেক ওভার ট্রিটমেন্টে। না না… আমার কথা না। ডা. দীপঙ্কর ঘোষের কথা। পিচ্চি ডাক্তার। ভীষণ মেধাবী। ঢাকা মেডিকেল কলেজে করোনা রোগী সামলাচ্ছে। নিজের শিক্ষক, ডা. কাশেম করোনা আক্রান্ত হওয়ায় যে দীপঙ্কর তার সঙ্গে, তার কেবিনে থেকে, স্যারকে পুরো সুস্থ করেছেন জীবন বাজি রেখে। সেই দীপঙ্করের। এটিএন নিউজের অনুষ্ঠানে দীপঙ্করের যেদিন ইন্টারভিউ করেছি ওর সাহস, ওর মহানুভবতার… তার পরেরদিনই আমার করোনা পজিটিভের সুসংবাদটি দিই ফোনে। এক কথা দুই কথায়, দীপঙ্কর আমার ভাই ব’নে গেল, আর ওর হুকুম কোনো ওষুধ খাওয়া যাবে না। অ্যান্টিবায়োটিক তো নয়ই…
যাদের করোনা হয়নি, তাদের জন্য বলি… করোনা পজিটিভ হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকেই বারবার এসএমএস আসে ফোনে। কিছু উপসর্গের কথা উল্লেখ করে প্রেসক্রিপশন এবং জরুরি সেবা নম্বরে ফোন করে চিকিৎসকের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের অনুরোধ জানিয়ে। ভালো সিস্টেম। কিন্তু দীপঙ্কর বোঝাল… দিদি তোমাকে তো করোনাভাইরাস আক্রমণ করেছে, অ্যান্টিবায়োটিক কেন খাবে? তুমি শিক্ষিত… তুমি ফাইট করো, এনজয় করো…!
এনজয়ের কথা উঠতেই, স্বাদ-গন্ধ-অনুভূতির ইম্ব্যালান্স নিয়ে কথা বলি। এবার আমার পিচ্চি ডা. এক্সপেরিমেন্টের মজা পায়। লম্বা সময়, আমার এসব অনুভূতির গল্প শোনার পর, ওর করোনা ওয়ার্ডে গবেষণা চালায়, গবেষণা আমিও চালাই জানা করোনাওয়ালাদের। হুম… মিলে যায় দুর্গন্ধ-সুগন্ধ কিছুই জানান দেয় না… টক মিষ্টি ঝালেও ভুল বোঝাবুঝি! আহা অন্ভুব… আহা অনুভূতি।
লন্ডন থেকে ডা. লিউনিক রলিও আমার অনুভূতির অনুভবে তাল দিল। এই করোনাকালে সবচেয়ে বেশি রোগীর তথ্য-উপাত্ত নিয়ে নাড়াচাড়ার অভিজ্ঞতা যার। এমন একটা সার্বক্ষণিক এক্সাইটমেন্ট- এক্সপেরিমেন্টে করোনার গভীর আক্রমণের দিনগুলো যেন উড়েই গেল। কখনো ধূপকাঠিটা নাকের কাছে ধরি, কখনো কাঁঠাল শুঁকি, শুঁটকি মাছের ভর্তা খেতে চাই… আসলে স্বাদ-গন্ধ-অনুভব অনুভূতির থাকা না থাকার বিষয়টির আস্বাদ নিচ্ছিলাম।
পরিবারের সবাই, বন্ধুবান্ধব অফিস কলিগ… সবাই উদ্বিগ্ন, কখন কী ঘটে যায়। আসলে আমি তো মনোযোগ দিয়ে করোনাটা উপভোগ করছি, আমার সঙ্গে অ্যাটাক- পাল্টা অ্যাটাক হয়ইনি। শুধু একটু শাসন করেছে… দীর্ঘদিন ধরে যে মাইগ্রেনকে গাফিলতি করেছি, সেটাকে চাগিয়ে দিয়ে আমাকে করোনা শাসিয়ে বলেছে…
Please take care of it… ফেলে রেখো না, না হয় মাইগ্রেনে মরবে, লোকে বলবে করোনা!
১৫ দিনে রীতিমতো প্রিয় হয়ে উঠল, করোনায় ছিনিয়ে নেওয়া স্বাদ-গন্ধহীন জীবনের স্বাদ। আমার সাধ না মিটিল আশা না পুরিল গাইতে লাগলাম, বেসুরো গলায়। করোনা বোধহয় বাংলাদেশে এমন বেজায়গায় আর পড়েনি। প্রথমত: করোনা পেয়ে খুশি, দ্বিতীয়ত: করোনায় স্বাদ-গন্ধ হারিয়ে খুশি, তৃতীয়ত: পরিপাশ্বের শত্রু শত্রু হয়ে ওঠা দেখেও খুশি। করোনা এতটা খুশি নিজেও না। শেষে ১০ দিনের মাথায় একটা ‘নেগেটিভ’ মেরে লুকিয়ে রাখা অনুভব অনুভূতির ছিপিটি খুলে দিয়ে পালাল। কানে কানে বলেই গেল… এমন করে বন্ধু করে নিলে, বন্ধু হয়েই থাকি। মারি না। অনিয়মের বাংলাদেশে নিয়ম মানো, বন্ধু করো…
লেখক : অডিও-ভিজুয়াল মাধ্যমের খ্যাতিমান সাংবাদিক, এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী সম্পাদক । করোনাকালে গণমাধ্যম পরিচালনার অভিজ্ঞতার সঙ্গে গল্পচ্ছলে জানিয়েছেন নিজের করোনা আক্রান্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা।
সূত্র : দেশ রূপান্তর