গ্যারান্টর ও অর্থঋণ আদালত আইন
এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া : ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ঋণের বিপরীতে জামানত হিসাবে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই জামিনদার বা গ্যারান্টর হিসাবে এক বা একাধিক ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠান গ্যারান্টি দিয়ে থাকে। ঋণখেলাপি হলে গ্যারান্টরের উপরও দায় বর্তায় ঋণ পরিশোধের জন্য। আর সে জন্যই গ্যারান্টরও ঋণখেলাপি হন, যদিও তিনি ঋণ নেন নাই। আর তাই ঋণখেলাপি হলে ঋণ আদায়ের জন্য কেবলমাত্র ঋণগ্রহীতা নয় গ্যারান্টরের বিরুদ্ধে মামলা করার বিধান রয়েছে বিদ্যমান অর্থঋণ আদালত আইনে। কিন্ত গ্যারান্টর মূল ঋণগ্রহীতার সম্পূর্ণ খেলাপি ঋণ পরিশোধ করে তিনি কীভাবে সেই অর্থ আদায় করবেন তা বলা নেই এই আইনে। আবার অন্যদিকে তৃতীয় পক্ষ বন্ধকদাতা যদি ঋণ গ্রহীতার খেলাপি ঋণ পরিশোধ করে দেন তিনিই বা কীভাবে অর্থ আদায় করবেন তারও সুস্পষ্ট কোন বিধান নেই আলোচ্য আইনে। সম্পূর্ণ আইন পর্যালোচনা করলে কেবল একটি ধারায় এ সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করা হয়েছে আর তা হলো, ধারা ৬(৫)-অর্থঋন আদালত আইনঃ
সেখা বলা হয়েছে, “আর্থিক প্রতিষ্ঠান মূল ঋণ গ্রহীতার (Principal debtor) বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার সময়, তৃতীয়পক্ষ বন্ধকদাতা (Third party mortgagor) বা তৃতীয়পক্ষ গ্যারান্টর (Third party guarantor) ঋণের সহিত সংশ্লিষ্ট থাকিলে, উহাদিগকে পক্ষ করিবে; এবং আদালত কর্তৃক প্রদত্ত রায়, আদেশ বা ডিক্রি সকল বিবাদীর বিরুদ্ধে যৌথভাবে ও পৃথক পৃথক ভাবে (jointly and severally) কার্যকর হইবে এবং ডিক্রি জারির মামলা সকল বিবাদী-দায়ীকের বিরুদ্ধে একই সাথে পরিচালিত হইবেঃ
তবে শর্ত থাকে যে, ডিক্রী জারীর মাধ্যমে দাবী আদায় হওয়ার ক্ষেত্রে আদালত প্রথমে মূল ঋন গ্রহীতা-বিবাদীর এবং অতঃপর যথাক্রমে তৃতীয় পক্ষ বন্ধক দাতা (Third party mortgagor) ও তৃতীয় পক্ষ গ্যারান্টর (Third party guarantor) এর সম্পত্তি যতদূর সম্ভব আকৃষ্ট করিবেঃ
আরও শর্ত থাকে যে, বাদীর অনুকূলে প্রদত্ত ডিক্রির দাবি তৃতীয় পক্ষ বন্ধক দাতা (Third party mortgagor) অথবা তৃতীয় পক্ষ গ্যারান্টর (Third party guarantor) পরিশোধ করিয়া থাকিলে উক্ত ডিক্রি যথাক্রমে তাহাদের অনুকূলে স্থানান্তরিত হইবে এবং তাহারা মূল ঋণ গ্রহীতার বিরুদ্ধে উহা প্রয়োগ বা জারি করিতে পারিবেন।”
উপরোক্ত ধারা থেকে সুস্পষ্ট ‘ডিক্রির দাবি’ তৃতীয় পক্ষ গ্যারান্টর বা তৃতীয় পক্ষ বন্ধকদাতা পরিশোধ করলে যিনি পরিশোধ করেছেন তিনি ডিক্রিদার আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতই জারি মামলা বিবাদী-দায়িকদের বিরুদ্ধে করতে পারবেন। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এখানে ডিক্রীর দাবির কথা বলা হয়েছে, ঋণের কথা বলা হয় নাই। অর্থাৎ অর্থঋন মামলা করার পূর্বেতো নয়ই বরং মামলা চলাকালীন সময়েও যদি কোন তৃতীয় পক্ষ গ্যারান্টর বা বন্ধক দাতা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের দাবি পরিশোধ করেন তিনি এই সুবিধা পাবেন না!
মূল ঋণ গ্রহীতার খেলাপি ঋণের দাবি পরিশোধ করার বিনিময়ে গ্যারান্টরকে সান্ত্বনা পেতে হবে এই ভেবে যে তিনি এখন আর ঋণ খেলাপি নন আর অন্যদিকে বন্ধক দাতাগণ অর্থাৎ মূল ঋণ গ্রহীতা-বন্ধকদাতা বা তৃতীয় পক্ষ-বন্ধকদাতা যিনিই হোন না কেন তার বন্ধককৃত সম্পত্তি বন্ধক/দায় মুক্ত হয়ে ফেরত যাবে তার মূল মালিকের কাছে।
বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
‘ক’ একজন ধুরন্ধর প্রকৃতির অসৎ ব্যাবসায়ী তার পরিকল্পনা ব্যাংকের ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধ না করার। পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি ব্যাংকের নিকট তার ব্যাবসায়ীক প্রতিষ্ঠানের নামে ২ কোটি টাকার ঋণ চাইলেন। ব্যাংকের কর্মকর্তা তাকে চার কোটি টাকা সমমূল্যের জমি বন্ধক দিতে হবে বলে জানালেন এবং দুইজন গ্যারান্টর দিতে বললেন। ‘ক’ এর জমি আছে তবে তা অনেক কম মূল্যের তাই তিনি নিজের জমি এবং তার আত্মীয় ‘খ’ এর জমি বন্ধক দিলেন। আর তার সাথে তার স্ত্রী এবং ‘গ’ যিনি একজন আইন মান্যকারী সৎ গার্মেন্টস ব্যাবসায়ী এবং নিজেও অন্য ব্যাংকের নিয়মিত ঋণ গ্রহীতা তাদের কে ঋণের গ্যারান্টর করলেন। অর্থাৎ- এখানে ‘ক’ একই সাথে মূল ঋণ গ্রহীতা এবং বন্ধকদাতা, ‘খ’ তৃতীয় পক্ষ বন্ধকদাতা, ‘গ’ এবং ‘ক’ এর স্ত্রী তৃতীয় পক্ষ গ্যারান্টর।
পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ‘ক’ ব্যাংকের থেকে ঋণ নিয়ে কোন টাকা পরিশোধ করলেন না। যথারীতি ঋণ খেলাপি হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সি.আই.বি. ডাটাবেজে নাম উঠে গেল ক, খ, গ এবং ক এর স্ত্রী’র।
লেখক: ডেপুটি এটর্নি জেনারেল, বাংলাদেশ।
সূত্র : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড