বিশ্ব মহামারীতে বঙ্গবন্ধুই আমাদের শক্তি
স্বদেশ রায় : বিশ্ব মহামারীর এক ভয়াবহ অবস্থানে আমরা দাঁড়িয়ে। যে যাই বলি না কেন ভবিষ্যত এখনও সকলের কাছেই অস্বচ্ছ এবং অস্পষ্ট। শুধু আমরাই নই গোটা বিশ্বই এখনো জানে না বর্তমানের এই অবস্থা থেকে কবে এবং কীভাবে মুক্তি পাবে মানুষ। তারপরেও ইতোমধ্যে বেশ কতগুলো বিষয় সারাবিশ্বে স্থান, কাল ও পাত্রভেদে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। আমাদের ক্ষেত্রেও অনেকগুলো বিষয় এখন স্পষ্ট। আমরা এখন সকলেই বুঝতে পারছি এই বিশ্বমহামারিকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হলে বা মহামারীর ক্ষতকে সারিয়ে তুলতে হলে আমাদের কী কী প্রয়োজন।
পাশাপাশি আরও একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে উন্নয়ন ও সভ্যতা যতই এগিয়ে যাক না কেন, সেটা বিপদমুক্ত নয়। যেকোনও সময়ে যেকোনও ধরনের আঘাত আসতে পারে এই উন্নয়ন এবং সভ্যতার ওপর। এবং তা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা সত্যি অর্থে পৃথিবী এখনও অর্জন করেনি।
তাই একটি দেশ, জাতি বা একটি সভ্যতাকে এমনভাবে গড়ে উঠতে হবে যা কিনা যে কোন বড় ধরনের আঘাতকে সহ্য করেও টিকে থাকতে পারে। এটা শুধু আমাদের মত দরিদ্র দেশের জন্যে নয়, গোটা পৃথিবীর সভ্যতার জন্যই দরকার। আমরা ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই- হাজার হাজার বছরের নানান সভ্যতা ধ্বংস হয়েছে প্রাকৃতিক ও মানুষসৃষ্ট দূর্যোগের কারণে। সাধারণ দুর্যোগ এবং ভয়াবহ দুর্যোগ পৃথিবীতে আসবেই। এটাকে মনে রেখেই আমাদের সভ্যতাকে গড়ে তুলতে হবে।
এবারের বিশ্ব মহামারিতে আরো একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে আধুনিক রাষ্ট্রগুলো ও সভ্যতাগুলো বড় বেশি মনোযোগ দিয়েছে মানুষসৃষ্ট দুর্যোগ ও রাষ্ট্রগুলোর পারষ্পারিক সামরিক কৌশল প্রতিরোধের দিকে। তারা প্রকৃতির নির্দয়তার কথা অনেকখানি ভুলে গিয়েছিল। তাদের কিছুটা হলেও ধারণা জন্মেছিল তারা প্রকৃতিকে জয় করেছে। অর্থনৈতিক ও সামরিক উন্নয়নের জৌলুসে সভ্যতার অতীতের দার্শনিকদের কথাও তারা ভুলে গিয়েছিল বলেই মনে হয়। যে চীন থেকে এই বিশ্ব মহামারীর সৃষ্টি তাদেরই দার্শনিক ‘তাও’ প্রায় দুই হাজার বছর আগে স্পষ্ট করে বলে গেছেন- “প্রকৃতি নির্দয়। সে তোমাকে যে কোন মুহূর্তে পূঁজো শেষের খড় কুটোয় তৈরি মুর্তির মতোই ফেলে দেবে”।
প্রকৃতির এই ভয়াবহ চরিত্র দুই হাজার বছর আগে চীনের মানুষের কাছে স্পষ্ট করে তুলে ধরা হলেও তারা যে সেটা ভুলে গিয়েছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় এবারের কোভিড-১৯ এর সময়। প্রকৃতির এ আঘাতের জন্য তাদের সচেতন কোনও প্রস্তুতি ছিল না। এমনকি আঘাতটি আসছে বা কোভিড-১৯ আক্রান্ত হবার বিষয়টি জানার পরেও তাদের প্রতিরোধ করার কাজে নামতে সময় লেগেছে ১৯ দিন। এ উনিশ দিন সময় যদি তাদের নষ্ট না করতে হতো তাহলে হয়তো পৃথিবীর এই অবস্থা হতো না। হয়তো কোভিড-১৯ কে খুব ছোট পরিসরে রেখেই পৃথিবী মোকাবেলা করতে পারতো। এখন এটা আরও স্পষ্ট, এই অবস্থা গোটা পৃথিবীরই। কেউই প্রস্তুত ছিল না প্রকৃতির এই ধরনের নির্মম আঘাত মোকাবেলার। প্রত্যেকেই সময় নষ্ট করেছে। অধিকাংশই ছোট পরিসরে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে কোভিডকে আটকে রাখতে পারেনি। অর্থাৎ আগেই যে কথা বলেছি সেটাই প্রমাণিত হয়, আমাদের সভ্যতা ও উন্নয়ন শতভাগ টেকসই নয় মানুষসৃষ্ট ও প্রকৃতিসৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলার ক্ষেত্রে।
একবিংশ শতাব্দীতে এই বিশ্ব মহামারির পরে নিশ্চয়ই প্রতিটি দেশকে, প্রতিটি মানবগোষ্ঠীকে সচেতন হতে হবে নতুন করে। যার যার অবস্থানে থেকে এবং নিজ নিজ পারিপার্শ্বিক অনুযায়ী কীভাবে টেকসই একটি সভ্যতা ও উন্নয়ন গড়ে তোলা যায় সে পথই খুঁজতে হবে। যাতে যে কোনও ধরনের প্লেগ মোকাবেলা করে বা কখনো কখনো দুর্যোগকে সঙ্গে নিয়ে টিকে থাকতে পারবে সভ্যতা ও মানুষ। আর এক্ষেত্রে এই পথটি খুঁজতে হবে প্রতিটি দেশ বা সমাজকে তার নিজ নিজ অবস্থান থেকে। যেমন, আমাদের ওপরে কী কী আঘাত এসেছে সেগুলো আমাদের আগে চিহ্নিত করতে হবে। যেহেতু এবারের দুর্যোগটি একটি ভয়াবহ রোগ তাই তার প্রথম আঘাতটি এসেছে স্বাস্থ্যের ওপর। স্বাস্থ্যের ওপর আঘাত মোটা দাগে ভাগ করলে দেখা যায় দুই ধরনের। এক, চিকিৎসা। দুই, স্বাস্থ্য সচেতনতা ও স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কিত আমাদের জীবন আচরণ।
এবারের বিশ্ব মহামারীর কারণ যে করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ এটা যদিও বলা হচ্ছে একেবারে নতুন। কিন্তু বাস্তবে কি শতভাগ নতুন? কারণ কোভিড-১৯ মূলত সার্স-২। সার্সে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ আক্রান্ত হয়েছিল ২০০৪ সালে। এই কোভিড-১৯ মোকাবেলার ক্ষেত্রে সার্স মোকাবেলা করার অভিজ্ঞতা যে কাজে লেগেছে তার প্রমাণ দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় বেশ কয়েকটি দেশ। যেমন- সিঙ্গাপুর, হংকং, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া বেশ সফলভাবে সার্স-২ অর্থাৎ কোভিড-১৯ মোকাবেলা করেছে। তারা শুরু থেকে যথেষ্ট সঠিক চিকিৎসা দিতে সমর্থ হয়েছে।
সার্স আমাদের দেশে আসেনি। কিন্তু আমরা যদি সচেতন হতাম এবং দূরদর্শী হতাম- সর্বোপরি প্রকৃতির আঘাত সম্পর্কে সচেতন থাকতাম তাহলে আমাদের কাজের ধরণ ভিন্ন হতো। নিঃসন্দেহে সার্স সম্পর্কে আমরা অভিজ্ঞতা অর্জন করতাম বা যথেষ্ট ধারণা রাখতাম। আর এটা যদি আমরা করতাম তাহলে হয়তো আমাদের এত ডাক্তারের মৃত্যু হতো না। এর থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট আমরা দৈনন্দিন চিকিৎসা নিয়েই ব্যস্ত। ভবিষ্যতমুখী বা পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে স্বাস্থ্য নিয়ে যে বিপত্তি ঘটছে সে সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন নই। এখানে অবশ্য অনেকেই প্রশ্ন তুলবেন পাশ্চাত্যের অনেক উন্নত দেশের অবস্থা আমাদের থেকেও খারাপ। সেটা স্বীকার করেই বলছি তাদের থেকে অনুন্নত ও দরিদ্র হলেও ভিয়েতনামের মত সচেতন একটি দেশ ও জাতি হওয়া উচিত ছিল আমাদের এবং এই মহামারীতে আমাদের স্থান ভিয়েতনামের পাশাপাশি থাকা উচিত ছিল। কেন উচিত ছিল সে বিষয়ে পরে আসছি। এরপরে আসছে স্বাস্থ্য সচেতনতা ও স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কিত আমাদের জীবন আচরণ।
এই কোভিড-১৯ মহামারীর ভিতর দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে আমাদের সচেতনতা অত্যন্ত নিম্নমানের। অথচ এর বিপরীতে আমরা অনেক বেশি স্বাস্থ্য সচেতন ও আধুনিক জীবনাচরনের অধিকারী হতে পারতাম। আমরা সামাজিকভাবে আধুনিক চিন্তা চেতনার অধিকারী হলে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে সফলতা আরও বেশি আসতো। আমাদের সফলতা দিয়ে আমরা প্রমাণ করতে পারতাম দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা একটি ভিয়েতনাম বা তার থেকে অনেক অগ্রসর ।
এখন প্রথম প্রশ্ন আসে, কেন আমরা ভিয়েতনামের মত হতে পারতাম? এর উত্তরে বলা যায়, ভারত বা পাকিস্তানের সমাজের ও রাষ্ট্রের মানুষের ধারা থেকে বের হয়ে এসে আমরা ভিয়েতনামের মত বা তাদের থেকে অনেক বেশি সুশৃঙ্খল হতে পারতাম। আর তেমনটি হবার জন্যেই এ রাষ্ট্রটির জম্ম হয়েছিল সামাজিক জাগরণ ও রাষ্ট্রীয় বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। আসলে একটি জাতিগোষ্ঠি বা একটি রাষ্ট্রের নাগরিক কেন অন্যের থেকে বেশি সুশৃঙ্খল হয়? এর মূলে দেখা যায়, যে রাষ্ট্রের নাগরিকরা বা যে জাতিগোষ্ঠি যত বেশি নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সামাজিক বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে নিজেদেরকে এগিয়ে নিয়েছে সে জাতি তত বেশি সুশৃঙ্খল ও আধুনিক। একটি জাতিগোষ্ঠির বা রাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে এই বিপ্লব প্রবাহিত হয় কোনও এক মহান নেতার বা মানবসভ্যতার পরিবর্তনকারী নেতার (গেইম চেঞ্জার) হাত ধরে।
বাঙালি জাতির সৌভাগ্য হয়েছিল এমনই মানব সভ্যতা পরিবর্তনকারী বা এগিয়ে নেওয়া নেতার হাত ধরে রাষ্ট্র ও বেশ কিছুটা সমাজ বিপ্লব ঘটানো। বাস্তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা যে স্বাধীনতার সংগ্রামটি করেছিলাম তাকে কোনও ছোট পরিসরে দেখার সুযোগ নেই। সেটাকে যদি আমরা শুধু একটি সাদামাটা স্বাধীনতা সংগ্রাম হিসেবে দেখি, শুধু একটি সশস্ত্র যুদ্ধ হিসেবে দেখি- সেটা অনেক বড় ভুল হবে। অথচ এই ভুল আমাদের মাথার ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টের পর থেকে। আমরা আমাদের দীর্ঘ ও বিশাল রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পরিবর্তনের বা বিপ্লবের বিষয়টিকে কেবল কিছু সশস্ত্র যুদ্ধের ঘটনার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে উপলব্ধি করতে বা বিচার করতে শুরু করেছি। ১৯৭৫ পরবর্তী রাষ্ট্র আমাদের সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিকে সেই ধারায় প্রবাহিত করেছে। অথচ এই রাষ্ট্র ও সমাজ সৃষ্টির জন্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে দীর্ঘ পথচলা সেটা ছিল একটি পরিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় বিপ্লবের লক্ষ্যে এবং একটি ধারাবাহিক সামাজিক বিপ্লবের সূচনা। বাস্তবে সামাজিক বিপ্লবের ধারাবাহিকতার ভেতর দিয়ে রাষ্ট্রীয় বিপ্লব হয় আবার ওই রাষ্ট্রই সামাজিক বিপ্লবকে প্রবাহমান থাকতে সাহায্য করে।
১৯৭১ সালে যে মুক্তিযুদ্ধে বা রাষ্ট্র বিপ্লবে আমরা অনেকখানি ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। আমাদের এই ঐক্য ও আধুনিক রাষ্ট্র চাহিদাটি একদিনে আসেনি। কারণ আমরাই (পূর্ববাংলার জনগোষ্ঠি) ছিলাম পাকিস্তান নামক পশ্চাদপদ শতভাগ অতীতমুখী দর্শনের একটি রাষ্ট্র সৃষ্টির মূলনায়ক। আমাদের এই চিন্তার জগতকে বাইশ বছরের ধারাবাহিক আন্দোলন ও পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে ১৯৭১ এর পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাস্তবে এই পরিবর্তনটি কী? আমরা অতীতমুখী থেকে আধুনিক হয়েছিলাম। আমরা তথাকথিত ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের কূপমন্ডুকতা থেকে বা অন্ধকারাচ্ছন্ন চিন্তা থেকে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের আধুনিকতায় সমাজের একটি বড় অংশের মানুষকে নিয়ে যেতে পেরেছিলাম। আর এই নিয়ে যাবার নেতৃত্বই শুধু দেননি বঙ্গবন্ধু তিনি এই ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের শিখাটি আমাদের প্রাণে প্রাণে জাগিয়েছিলেন। মানব সভ্যতায় মানুষের চেতনার দিক পরিবর্তনকারী এই যে সব নেতারা আসেন এরা সব সময়ের জন্যে বিশ্বনেতা।
কারণ, মানুষের এই পরিবর্তন কোন একটি ভূখণ্ডে আটকে রাখা যায় না। আর বঙ্গবন্ধু বাঙালি নরগোষ্ঠির একটি বৃহৎ অংশের মধ্যে যে পরিবর্তন ঘটিয়ে ছিলেন তাকেও কেবল ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উত্তরণ হিসেবে দেখলেও ভুল হবে। বঙ্গবন্ধু একটি নরগোষ্ঠিকে আধুনিকতার পথে, আত্মশক্তিতে চলার পথে তুলে দিয়েছিলেন। এর প্রভাব পড়ে সারা বিশ্বে।
এই আধুনিকতার বা আত্মশক্তিতে চলার পথটি কখনওই কেবল তাত্ত্বিক ও মনোজাগতিক বিষয় নয়। এর প্রায়োগিক দিকও আছে। যেমন আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিশ্বমহামারী এসে আমাদের সব থেকে বেশি আঘাত করেছে স্বাস্থ্যখাতেও অর্থনীতির খাতে। আর এই আঘাত প্রতিরোধে আমাদের অন্যতম একটি বাধা আমাদের চরিত্র ও মনোজগত। অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে এই তিনকে অর্থাৎ স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও মনোজগতকে কিন্তু টেকসইভাবে পরিবর্তনের পথে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। প্রথমেই স্বাস্থ্যখাত ধরা যাক। বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনায় দেখা যাচ্ছে, তিনি শুধু রাজধানীকেন্দ্রিক সরকারি উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও বেসরকারীর নামে বিশাল অর্থব্যয়ের এই চিকিৎসা ব্যবস্থার ধারার প্রবর্তক নন। তাঁর পরিকল্পনায় ছিল প্রতিটি থানাভিত্তিক উন্নত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা না হলে তিনি অতি সহজে আমাদেরকে আরো বিশ বছর নেতৃত্ব দিতে পারতেন। বঙ্গবন্ধু আরো বিশ বছর নেতৃত্ব দিলে ও রাষ্ট্র পরিচালনা করলে আমাদের থানাভিত্তিক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো শুধু প্রতিষ্ঠিত হতো না সেগুলো উন্নতমানের হতো। সেগুলোতে আধুনিক সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও মোটামুটি অনেক গবেষণার সুযোগ থাকতো। আর সেটা যখন পরিপূর্ণ হতো তখন আমাদের স্বাস্থ্য কাঠামো একটি টেকসই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে যেত। আর বঙ্গবন্ধু যেহেতু প্রতি মুহূর্তের সামাজিক বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে আমাদের এগিয়ে নিয়ে আসতেন- তাই আর যাই হোক আমরা বর্তমানে যেমন একটি দুর্নীতিবাজ, অসৎ ও অনেকখানি চরিত্রহীন জাতি এমন জাতি বা নরগোষ্ঠি হতাম না। আমাদের শিক্ষিত সমাজ ও নেতৃত্বদানকারী সমাজ যারা সমাজের ও রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে নেতৃত্ব দেন, তাদের চরিত্র বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের অনুকরণে নির্মল চরিত্রই হতো। কারণ, বঙ্গবন্ধুর মত অতিমানব যখন কোন নরগোষ্ঠির নেতৃত্বে থাকে তখন স্বাভাবিকই দেখা যায় তার চরিত্রের আলোকরশ্মি সাধারণের মধ্যে প্রতিটি কাজের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আমাদের সেটা ঘটতো। তাই তার পরবর্তীতে যারা দেশ ও সমাজ পরিচালনা করতেন তারা সকলে তার আদর্শ অনুযায়ী নির্মল সৎ চরিত্রের হতো। যার ফলে যে দীর্ঘ দুর্নীতির ধারা বাংলাদেশে চলে আসছে বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর থেকে এই দুর্নীতির প্রবেশ সমাজে ও রাষ্ট্রে ঘটতো না। আর ৪৫ বছর সৎ নেতৃত্ব, সৎ নাগরিকের হাত বেয়ে যদি প্রত্যেকটি থানায় এই আধুনিক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো গড়ে উঠতে পারতো তাহলে আজ কি আমরা ভিয়েতনামের মত এক মাসের বা তার থেকেও কম সময়ে সারা দেশের মানুষের কোভিড-১৯ পরীক্ষা করে, কে আক্রান্ত আর কে আক্রন্ত নয় এটা শনাক্ত করে ফেলতে পারতাম না? আর প্রথম এক মাসের মধ্যে এটা করতে পারলে আমাদের কোভিড আক্রান্তের হার কমে গিয়ে অতি সীমিত আকারের মধ্যে কি সীমাবদ্ধ হতো না?
আর এ কাজের ভেতর দিয়ে আমরা কি ভিয়েতনামের মত বা তার থেকেও সফলভাবে কোভিড-১৯-কে শুরুতে আটকে দিতে পারতাম না? অবশ্যই পারতাম। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আমাদের লোক সংখ্যাও কম থাকতো। কারণ, তিনি নিঃসন্দেহে সমাজ থেকে পশ্চাদপদতা দূর করতেন, সেই লক্ষ্যেই তিনি ১৯৪৮ থেকে প্রতিটি মুহূর্তে কাজ করে গেছেন। তাই তিনি বেঁচে থাকলে দশ বছরেই আমরা একটি আধুনিক সমাজ পেতাম। আর একটি আধুনিক সমাজ নিশ্চয়ই এমন অপরিকল্পিত ও ভাগ্যবাদীদের মত সন্তান জম্ম দেয় না। বরং বঙ্গবন্ধুর শক্তিতে একটি পরিকল্পিত পরিবারের সমাজই গড়ে উঠতো। আর সেটা গড়ে তোলার সকল শক্তি, সকল আধুনিকতা তার ভেতর ছিল। একটু চিন্তা করলেই স্পষ্ট বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধু স্বাস্থ্যের যে অবকাঠামো গড়তে চেয়েছিলেন সেটা যদি হতো আর তার আদর্শে যদি পরিকল্পিত পরিবার হলে- আজকের চিত্র ভিন্ন হতো। অর্থাৎ বর্তমানের থেকে অনেক কম জনগোষ্ঠির এই রাষ্ট্র ও সমাজটি থাকতো। আর তাহলে আমরা কি ভিয়েতনামের থেকেও ভালো পারদর্শিতা এই স্বাস্থ্যখাতে বিশ্বমহামারীকালে দেখাতে পারতাম না!
বিশ্বমহামারী স্বাস্থ্যের পরেই আঘাত করেছে অর্থনীতিতে। কিন্তু একটু চিন্তা করলে বা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অর্থনীতির সব জায়গায় কিন্তু আঘাত করতে পারেনি। শহরকেন্দ্রিক শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যে আঘাত করেছে। এখন ভেবে দেখা যেতে পারে আজ যদি এই দেশে বঙ্গবন্ধুর চিন্তার অর্থনৈতিক কাঠামো বাস্তবায়িত হতো- অর্থাৎ গ্রাম ও শহর প্রায় সমমানের হিসেবে তৈরি করা হতো- তাহলে কি এই আঘাত এভাবে লাগতে পারতো? পারতো না। এই বিশ্বমহামারীতে সব থেকে বেশি অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে নিম্মবিত্ত ও নিম্ম মধ্যবিত্ত। তাদের এই সংকটে পড়ার বড় কারণ তাদের আয়ের বড় অংশই ব্যয় হয়ে গেছে বড় বড় শহরে বাসা ভাড়ায় অর্থ ব্যয় করে। তারা সঞ্চয় করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক ও যোগাযোগ পরিকল্পনা যদি এ দেশে বাস্তবায়িত হতো তাহলে মানুষকে কিন্তু উম্মুল হবার প্রয়োজন হতো না। নিজ নিজ বাসস্থানে থেকে অধিকাংশ মানুষই তাদের কাজের স্থানে যেতে পারতো , সন্তানকে যথার্থ শিক্ষা দিতে পারতো- সর্বোপরি তার গ্রামের নিজস্ব সম্পদটুকু সঠিক ব্যবহার করতে পারতো। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে তার চিন্তা চেতনা থেকে সরে এসে ধীরে ধীরে যে অর্থনৈতিক অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে তা মূলত কয়েক ব্যক্তির জন্যে, একটি বিশেষ গোষ্ঠির জন্য- দেশের সাধারণের কথা চিন্তা করে নয়। তাছাড়া শত চেষ্টা করলেও বর্তমানের এই ব্যবস্থায় দেশের অধিকাংশ মানুষের যোগ ঘটানো যায় না। অথচ বঙ্গবন্ধুর যে গ্রামভিত্তিক অর্থনীতির চিন্তা ছিল সেটা বাস্তবায়িত হলে দেশের অর্থনীতির কাঠামো ভিন্ন হতো। যেমন আজ যদি কৃষি ও কৃষিজাত শিল্প পাশাপাশি এবং ছোট ছোট আকারে থাকতো তাহলে কি ছবি ভিন্ন হতো না? তাহলে দেশের অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ শিল্পের উদ্যেক্তা হতো। আবার মোট কৃষিজাত শিল্পপণ্যের উৎপাদনও বেশি হতো।
এই বিশ্বমহামারী সেই শিল্পকে আঘাত করতে পারতো না। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই এই আধুনিক দাস প্রথার শ্রম শোষণের পোশাক শিল্প গড়ে উঠতো না। এ ধরনের রপ্তানিজাত পণ্যের শিল্পগুলো দেশব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে তৈরি হতো। যার ফলে উম্মুল শ্রমিকগোষ্ঠি না গড়ে উঠে একটি পরিবারকে স্বচ্ছল করার শ্রমিকগোষ্ঠি গড়ে উঠতো। তাছাড়া শ্রমের মূল্য অনেক বেশি পেতো বাংলাদেশের শ্রমিকরা। এখন যে শিল্পের মাধ্যমে কানাডায় ‘বেগম পাড়া’ বা মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম গড়ে’ উঠছে মালিকদের এর বদলে মালিকরা বাংলাদেশের অর্থনীতি পরিবর্তনের এক একজন ব্যক্তি হয়ে উঠতেন। এবং শ্রমিকরাও পেতো উন্নত জীবন। আর নিশ্চয়ই এই বিশ্ব মহামারীতে কর্মহীন হতে হতো না হাজার হাজার পোশাক শ্রমিককে। ভিয়েতনামে কিন্তু কর্মহীন হতে হয়নি কাউকে। বঙ্গবন্ধু শুধু মাত্র শহরকেন্দ্রিক না করে সমগ্র দেশকে নিয়ে অর্থাৎ গ্রাম ও শহরভিত্তিক টেকসই অর্থনীতি গড়ার জন্যেই তিনি তার অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করেছিলেন।
সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করা হলে আমাদের জাতীয় চরিত্র এভাবে নষ্ট করার সুযোগ পেতো না সামরিক শাসকরা। আমাদের সমাজে সকল ক্ষেত্রে এমন অনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে উঠতো না। পশ্চাদপদ মধ্যযুগীয় চিন্তা চেতনা জেঁকে বসার সুযোগ পেতো না এ সমাজে। কারণ, বঙ্গবন্ধুই ১৯৪৮ থেকে ধীরে ধীরে মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন ঘটিয়ে দেশের একটি বড় অংশের মানুষকে, বড় অংশের তরুণ সমাজকে আত্মত্যাগী, সৎ ও নির্ভীক হয়ে ওঠার পথে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি রাষ্ট্র ও সমাজের নিয়ন্ত্রক যদি আরও বিশ বছর থাকতে পারতেন, তিনি নিঃসন্দেহে আমাদের জাতীয় চরিত্রের আরও অনেক পরিবর্তন ঘটাতে পারতেন। তাতে আজ যে সকল ক্ষেত্রে, সকল মূল্যবোধ বিসর্জন দেয়ার একটি স্রোত সমাজে বয়ে চলেছে এটি সৃষ্টি হতে পারতো না। এর বিপরীতে একটি স্বচ্ছ ও সৎ স্রোতধারা তৈরি হতো সমাজে।
তাহলে আজ এই বিশ্বমহামারীর সময়ে স্বাস্থ্যখাতে দুর্বলতা, দুর্নীতি, অর্থনৈতিক খাতের দুর্বলতা এবং দুর্নীতি বের হতো না। বরং দেখা যেতো নিষ্ঠার সঙ্গে, বীরত্ব দিয়ে, সততা দিয়ে আমরা এটা মোকাবেলা করছি। এই মহাদুযোর্গে আমাদের সকলের ভেতর কিছুটা না কিছুটা বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের ছাপ ফুটে উঠতো। আর ওই চরিত্রই আমাদেরকে বিশ্বমহামারীর সঙ্গে যুদ্ধ করার শক্তি দিতো। তাই বিশ্বমহামারী মোকাবিলায় সত্যি অর্থে মূল অস্ত্র রয়েছে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের ভেতর। তার ভেতর থেকে প্রকৃত শক্তি খুঁজে নিয়েই আমাদের বর্তমান সময়ের এই বিশ্বমহামারী রুখতে হবে। তার এই জম্ম শতবর্ষে তার নিহত হবার দিন পালন মানে তাই কোন আনুষ্ঠানিকতা নয়। তার এই নিহত হবার দিন, এই জাতীয় শোক দিবস পালন সঠিকভাবে করতে হলে তার চরিত্রই এ জাতির প্রত্যেকে নিজ চরিত্রে ধারণ করতে হবে। যাতে সেই চরিত্রের বলে এই দুঃসময়ে নিজ নিজ অবস্থানে শতভাগ সততার সঙ্গে সঠিক কাজটি করতে পারে। যদি আমরা আমাদের সমাজ ও সভ্যতাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারি তাহলে ভবিষ্যতে কোন বিশ্বমহামারীতে আমদের এমন অসহায় হতে হবে না।
এখানে আমরা স্মরণ করতে পারি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে কিন্তু এখন আমরা ঘূর্ণিঝড়ের মত দুযোর্গকে সাধারণভাবেই মোকবেলা করে যাচ্ছি। তাই এই বিশ্বমহামারীতেও তিনিই আমাদের ভবিষ্যতের পথ প্রদর্শক। আমাদের নিজ নিজ চরিত্র, জাতীয় চরিত্র তৈরিতে, দুর্নীতিসহ সকল অপরাধ থেকে নিজেদেরকে বের করে আনতে হলে আমাদেরকে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের থেকেই পথ নির্দেশিকা নিতে হবে। তার জম্মশতবার্ষিকীতে, তার নির্মম মৃত্যুদিনে এই আত্মোপলব্ধি যেন সকলে করি এটাই হোক প্রার্থনা।
সূত্র : বিডিনিউজ