১৫ আগষ্ট, ১৯৭৫: একজন শিশুর স্মৃতিকথা
শাহানা হুদা রঞ্জনা : স্বাধীনতার পর সম্ভবত ৭৩/৭৪ সালে জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম অসুস্থ হয়ে পিজি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু কবিকে দেখতে গেলেন। কবির পরিবারের লোকজন বঙ্গবন্ধুকে কাছে পেয়ে খুব খুশি। কিন্তু শেখ মুজিব কবিকে কাছ থেকে দেখার জন্য, কথা বলার জন্য চেয়ার সরিয়ে রেখে বিছানার পাশে মাটিতে বসে পড়লেন।
মাওলানা ভাসানীর সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনার অনেক অমিল ছিল। বিশেষ করে বাকশাল গঠন করায় ভাসানী তীব্র সমালোচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর। কিন্তু বঙ্গবন্ধু যেমন এই অভিজ্ঞ নেতাকে মান্য করতেন, তেমনি মওলানা ভাসানী সমালোচনা করলেও বঙ্গবন্ধুকে খুব ভালবাসতেন। স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর পেয়ে উনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিলেন। এ প্রসঙ্গে মনেপড়ল আমার আব্বা, শামসউল হুদার একটি গল্প। আব্বা তখন মর্নিং নিউজ পত্রিকার সম্পাদক, সে দেখা করতে গেল অসুস্থ মাওলানা ভাসানীর সাথে। মাওলানা সাহেব বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ব্যর্থতা নিয়ে কিছু কথাবার্তা বললেন এবং শেষে এসে বললেন, “তোমরা তারে ( মুজিবকে) ভাল ভাল পরামর্শ দেও, যেন সে দ্যাশটারে শক্ত হাতে চালাইতে পারে। কিন্তু তোমরা সাংবাদিকরা সরকারের পদলেহনকারী হইও না।”
আব্বার মুখে শুনেছি অবিসংবাদিত নেতা হওয়া সত্ত্বেও কোনরকম অহংকার বঙ্গবন্ধুকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি একজন সাধারণ বাঙালির মতো ঘরে লুঙ্গি-গেঞ্জি পরতেন, সেই পোশাকে তাঁর অনেক অফিসিয়াল ছবিও আছে। তাঁর পরিচিত সাংবাদিক, কবি, লেখক, রাজনীতিবিদ অনায়াসেই একজন প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে যেতে পারতেন, কথা বলতে পারতেন। সেকারণেই ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল ‘নিউজউইক’ ম্যাগাজিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে প্রচ্ছদ করে লিখেছিল “বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন রাজনীতির একজন কবি। সেইজন্যই তার কথাবার্তা, আচার-আচরণ, স্টাইল এমন ছিল যে, যা দেখে, এই অঞ্চলের সব শ্রেণীর এবং সব আদর্শের মানুষ তাকে কাছের মানুষ মনে করতো এবং সবাই তাঁর ডাকে এক হয়ে যেতে পারতো।”
আর এরকমই একটি ঘটনার সাক্ষী আব্বা নিজে, “বঙ্গবন্ধু যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী, আমি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার নিউজ এডিটর। হঠাৎ একদিন অফিসে ফোন এল। আমি হ্যালো বলতেই ও পাশ থেকে গলদ গম্ভীর স্বর ভেসে এল। কে, শামসউল হুদা? বলতেছো? আব্বা বলল জি। আপনি? ঊত্তর এলো, আমি শেখ মুজিব। একথা শুনে আব্বা চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু আমাকে নিজে ফোন করেছেন? আব্বা যা বলেছিল, আমার দম আটকে যাচ্ছিল। কোনভাবে তোতলাতে তোতলাতে বলেছিলাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি আমাকে ফোন করেছেন? এতো আমি ভাবতেই পারছিনা। কী করতে হবে বলেন? বঙ্গবন্ধু আব্বাকে বলেছিল, “হুদা তুমি কালকে বাসায় চলে আসবা। তোমাকে মর্নিং নিউজের সম্পাদক বানানো হইছে।” একথা শুনে আব্বার হাত পা কাঁপতে শুরু করেছিল উত্তেজনায়। ইতোমধ্যে অফিসের সবাই চেয়ার ছেড়ে আব্বার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। খবর শুনে সবাই মিষ্টি খেতে চাইলো। আব্বার পকেটে তখন সেরকম টাকা ছিল না বলে সবাই মিলেই মিষ্টি কিনে খেয়েছিল। আম্মার কুলখানিতে এসে এই কথাটা আমাকে মনে করিয়ে দিলেন সাংবাদিক নেতা আজিজুল ইসলাম ভুইঁয়া ভাই।
অনেকে আমাকে বলেছে কেন আমি বঙ্গবন্ধুকে ভালবাসি? কেন দেশ শাসনে ওনার দুর্বলতাগুলো জানার পরও, ওনাকেই পরম পূজনীয় বলে ভাবি? এর কারণ মনে হয় আমার পরিবার এবং বাল্যকালের জোরালো স্মৃতি। আর চাঁদের বুকে কালো চিহ্ন আছে বলে কি আমরা চাঁদের আলোকে অস্বীকার করতে পারি? আমার বয়স তখন মাত্র ৯ বছর। ১৭ মার্চ ১৯৭৫ সাল। আমি আব্বার হাত ধরে গণভবনে গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে । ঐরকম বড়মাপের সুন্দর মানুষ আমি জীবনে প্রথম দেখলাম। স্পষ্ট মনে আছে ” যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা, গৌড়ি যমুনা বহমান ” কবিতাটির প্রথম চার লাইন শিখে আমি তাঁকে শুনিয়েছিলাম। উনি মাথায় হাত রেখে দোয়া করেছিলেন । আমার ছোট হৃদয়ে সেই যে বঙ্গবন্ধু নামটা গাঁথা হয়ে গেল, আর কোনদিন তা মুছে গেলনা। এই বয়সে এসেও চোখ বন্ধ করলে আমার সামনে সেই ক্যারিসম্যাটিক চেহারাটাই ভেসে ওঠে।
এরমাত্র ৫ মাস পর এলো ইতিহাসের সেই কালো অধ্যায় । ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্ট ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেলো প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দে। দৌঁড়ে আব্বা আম্মার ঘরে গেলাম। সবাই হতচকিত, আমি ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। আব্বা টেলিফোন করার চেষ্টা করছেন খবর জানার জন্য। শব্দটা এত কাছ থেকে আসছিল যে কান পাতা যাচ্ছিলনা। আমরা থাকতাম আসাদগেট নিউকলোনিতে, যা ৩২ নম্বর এর খুব কাছে। এরমধ্যে আম্মা হঠাৎ বলে উঠলো “শব্দটা কি বঙ্গবন্ধুর বাসা থেকে আসছে ? ওনাকে কি মেরে ফেললো? তুমি রেডিওটা ধর।” আম্মার এই কথার পর আব্বা সম্বিত ফিরে পেয়ে রেডিও অন করলো ।
ভেসে এল মেজর ডালিম এর কন্ঠস্বর। তাদের অপকর্মের কথা জোর গলায় ঘোষণা করছে। আমার বয়স তখন প্রায় ১০ বছর, কিন্তু সব ঘটনা স্পষ্ট চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আব্বা কান্নায় ভেঙে পড়লো। এর আগে আমি কখনও আব্বাকে কাঁদতে দেখিনি। আম্মাও কাঁদছে। আমিও বুঝে, না বুঝে কাঁদতে থাকলাম। মাত্র ৫ মাস আগে আমি যে মহান নেতাকে দেখেছি, আজকে তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে? এ আমি ভাবতেই পারছিলাম না।
আব্বা সেসময় ছিলেন প্রিন্সিপাল ইনফরমেশন অফিসার। সে পাগলের মত কাঁদছে, আর বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে খবর জানার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে আব্বার বন্ধু মাহবুব চাচার বাসায়। কারণ মাহবুব চাচা থাকতেন মুজিব ভবনের ঠিক পাশের বাসায়। কিন্তু অবিরত ফোন বেজে গেল কেউ ধরল না। পরে মাহবুবু চাচা বলেছিল বঙ্গবন্ধুর বাসায় প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দে তারা সবাই ভয়ে খাটের নীচে লুকিয়েছিল। আমাদের বাসায় তখন একটা ‘লাল ফোন’ ছিল, যেটা দিয়ে শুধু হাই প্রোফাইল ব্যক্তিদের সাথে কথা বলা যেতো। সেই ফোনটা সকাল ১১ টার দিকে বেজে উঠলো। ঐ পাশ থেকে একজন আব্বাকে বললো রেডি হয়ে নিতে, কারণ আব্বাকে নিতে গাড়ি পাঠানো হয়েছে।
এই কথা শুনে আম্মার অবস্থা হল আরো শোচনীয়। ততক্ষণে আমরা জেনে গেছি বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। তাঁর আশেপাশে যারা ছিল তাঁদেরও এক এক করে হত্যা করা হয়েছে। আম্মা চিৎকার করে আব্বাকে বলতে থাকলো, ” ওরা তোমাকেও মেরে ফেলবে, ওরা জানে তুমি বঙ্গবন্ধুর লোক।”
কিন্তু না যেয়ে তো উপায় নেই। আব্বা রেডি হয়ে নিল। বেলা ১২ টার দিকে সেনাবাহিনীর একটি জীপ এসে আব্বাকে নিয়ে গেল। নিউকলোনির মানুষ যার যার বাসা থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সেই দৃশ্য দেখার জন্য। চরম একটা অনিশ্চিত ও ভীতিজনক অবস্থা। বাসায় সব কাজ বন্ধ। চারিদেকে অসম্ভব থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এরপর প্রায় দেড়দিন চলে গেল, আব্বার কোন খবর পেলামনা। আম্মার কাঁদতে কাঁদতে পাগল হওয়ার অবস্থা।
ঠিক এরকম একটি অবস্থায় ১৫ আগষ্ট চলে গেল। ১৬ আগষ্ট সকালবেলাতে দেখলাম আমাদের বিল্ডিং এর নীচতলায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের একজন নেতা থাকতেন, স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার খবরে সে মিষ্টি বিতরণ করছে। অনেকেই হাসিহাসি মুখে সেই মিষ্টি খাচ্ছে। সেসময় জাসদের পত্রিকা ‘গণকন্ঠ’ এর সাংবাদিক আনোয়ার সাহেব থাকতেন কলোনিতে। উনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে মুজিবকে বংশশুদ্ধ হত্যা করার কাজটি কত ভাল হয়েছে, সে বিষয়ে উচুঁ গলায় বক্তৃতা দিচ্ছেন। আর তার পাশে দাঁড়ানো লোকেরা সেই হত্যাকান্ড নিয়ে নানারকম টিপ্পনী কাটছে।
আমি অবাক হয়ে সেই দৃশ্য দেখছিলাম। তখনও ভেবেছি, এখনও ভাবি, যে মানুষটি এই দেশকে স্বাধীন করলেন, তাঁকে কেন এইভাবে হত্যা করা হলো? এজন্য কিছু লোক মিষ্টিও খাচ্ছে। এরকম একটি নির্মম হত্যাযজ্ঞকে কেন এবং কারা সমর্থন করছে ? আমার সেইসময়ের শিশুমনে যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল, এর উত্তর আমি সেদিন পাইনি। কেন ওনাকে নির্বংশ করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল, কারা করেছিল — সেই ইতিহাস আমি এখন জানি। এরপরও যতবার ১৫ আগষ্ট আসে, ততবার সবকিছু ছাপিয়ে শুধু ঐ মিষ্টি বিলানোর দৃশ্যটিই আমার চোখে ভেসে ওঠে।
১৭ আগষ্ট দুপুরে সেই লাল টেলিফোন আবার বেজে উঠলো। টেলিফোনের ঐপাশে আব্বার কন্ঠস্বর। যাক তাহলে আব্বা বেঁচে আছে। আম্মার চোখের যে পানি শুকিয়ে গিয়েছিল, তা আবার ধারার মত নামতে শুর করলো। শুধু বলতে থাকলো, “তুমি কী খাইছো? ওরা তোমাকে মারে নাইতো? তুমি কখন আসবা?” আব্বা জানালো সে বঙ্গভবনে আছে। ভাত খেয়েছে। আব্বা আমাদের চিন্তা করতে মানা করল। বলল, কাজ শেষ হলে ওরাই বাসায় দিয়ে যাবে। ঐদিনই রাত ১২ টার দিকে আব্বা বাসায় ফিরে এল। আব্বার সেই বিধ্বস্ত, ক্লান্ত, অসহায় আর বিষন্ন চেহারাটা আমি কোনদিন ভুলবোনা।
এরও অনেক বছর পরে, সম্ভবত ৮০ এর দশকে একদিন বিকালে বাইরে থেকে বাসায় ফিরে দেখলাম বসবার ঘরে শশ্রুমন্ডিত খুব সুন্দর চেহারার একজন মানুষ আব্বাকে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছেন। দূর থেকে তাকে চিনতে পারি নাই। পরে বুঝলাম উনি তাহেরউদ্দীন ঠাকুর, আব্বার বন্ধু। বঙ্গবন্ধু যাঁকে ভালবেসেছিলেন। প্রচন্ড বিস্মিত হলাম দেখে। পরে আব্বা বলল তাহেরউদ্দীন ঠাকুর বঙ্গবন্ধুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য অনুতপ্ত। সেটা স্বীকার করে সে কাঁদছে। কিন্তু তার সেই কান্না কি পারবে বাংলার কালো অধ্যায়কে মুছে দিতে ?
সেই ১০ বছর বয়সে আমি যা বুঝিনি, পরবর্তী সময়ে এর অনেকটাই আমি বুঝেছি । বুঝেছি ইতিহাসে কালো অধ্যায় একবার যোগ হলে, তা বারবার ফিরে আসে। ১৯৭৫ এ সামরিক বাহিনীর সেই অপরাধকে যারা সমর্থন করেছিল, তারা নিজেরাই একদিন সেই জঘন্য কাজের বলি হল। বারবার সামরিক অভ্যুথানে ক্ষতবিক্ষত হল দেশ ও দেশের মানুষ। আমি এখনও বিশ্বাস করি এবং সারাজীবন বিশ্বাস করে যাবো — ১৫ আগষ্টের সেই হত্যাযজ্ঞ বাংলাদেশকেই পরাজিত করেছে এবং এর জের আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে।
বিশ্বাসঘাতকদের শাস্তি, মানুষ না দিলেও প্রকৃতি দেবেই। নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করিয়ে বাংলার স্বাধীনতা সূর্যকে অস্তমিত করার জন্য যারা কাজ করেছিল সেই মীরজাফর, মীরকাসিম, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, ঘসেটি বেগমসহ অন্যান্যদের কারোই স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। এমনকী প্রবল প্রতাপশালী লর্ড ক্লাইভেরও।
লেখক: সিনিয়র কোঅর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
১৫ আগষ্ট, ২০২০
সূত্র : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড