ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার আবরণে হিন্দুত্ববাদ
মনোয়ারুল হক : অনেকেই প্রশ্ন করেন, পাকিস্তান যদি ইসলামি প্রজাতন্ত্র হতে পারে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলে, ভারত কেন হিন্দু রাষ্ট্র হতে পারবে না?
এর উত্তর হচ্ছে অবশ্যই হতে পারবে। দক্ষিণ এশিয়ার সংকীর্ণ আত্মপরিচয়ের জনপদে সেটাই স্বাভাবিক। গোটা বিশ্বে ভারতকে তার বহিরাঙ্গে ধর্ম-নিরপেক্ষ কস্টিউমের কারণে সভ্য ও আলোকিত জনপদ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রগুলোর চেয়ে শ্রেয়তর সংস্কৃতির রোল মডেল বলে ভাবা হতো, সেটার অবসান ঘটবে।
কিন্তু কোন সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট আত্মার মধ্যে না থাকলে; বহিরাঙ্গের নান্দনিক পোশাক দিয়ে খুব বেশিকাল ঢেকে রাখা যায় না তার অন্তর্গত ক্লেদ।
বেশ কিছু মানবিক, রাজনৈতিক নেতা, লেখক, শিল্পী, চলচ্চিত্রকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ভারত ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের বাইরে গিয়ে মানবিক সূর্যোদয়ের যে আলো দেখিয়েছিলেন, তা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের উদার সংস্কৃতির বিচ্ছিন্ন মানুষকে মানবিক ও শৈল্পিক ভাবনার অনুপ্রেরণা দিয়েছিল।
পাকিস্তানের সংকীর্ণ মুসলমান আত্মপরিচয়ের রোগের কারণে রাষ্ট্রটি বিশ্বজুড়ে নিন্দিত হয়েছে। অন্যদিকে ভারত তার উদার অসাম্প্রদায়িক আত্মপরিচয়ের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার আলোকভূমি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বিশ্বসমাজে।
গত পাঁচবছরে অসাম্প্রদায়িক ভারতের কস্টিউমটি বিবর্ণ হয়ে ধীরে ধীরে ‘হিন্দু ভারত’উদয় ঘটেছে। এই মেটামরফসিস বা রূপান্তরকে বুঝতে গেলে প্রণব মুখার্জি চরিত্রটিকে বুঝতে হবে। তিনি ভেতরের কট্টর হিন্দুত্বকেন্দ্রিক সংকীর্ণতাকে সেক্যুলার দলের কোট পরে ঢেকে রেখে দশকের পর দশক অসাম্প্রদায়িকতার বাতিঘর হিসেবে বিরাজ করেছেন সর্বত্র।
পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কট্টর ইসলামপন্থার লোকেরা তাদের সংকীর্ণ আত্মপরিচয় নিয়ে প্রথম থেকে বিরাজ করায়; তাদেরকে নিয়ে নবীন প্রজন্মের ভ্রান্ত-অধ্যায় তৈরির কোন সমস্যা হয়নি। লোকটা পঁচা মুসলমান; সে অন্য ধর্মের মানুষকে ভালোবাসার মতো মানব হৃদয়ের অধিকারী না হওয়ায়; উপমানব হয়েই রয়ে গেছে; এটা বুঝতে সমস্যা হয়নি। আবার কট্টর ইসলামপন্থাজনিত সন্ত্রাসীদের মানবতার শত্রু হিসেবে বুঝতেও সহজ হয়েছে। কারণ তারা কট্টর ভাইরাসের রোগী হিসেবে ‘এজ ইট ইজ’ নিজেদের উপস্থাপন করেছেন।
যারা ধর্ম-বর্ণ-গোত্র এইসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাতকুয়া ভাবনার বাইরে প্রশস্ত মানবিক ও ধরিত্রী ভাবনায় আগ্রহী; তারা প্রথম থেকে কট্টর ইসলামপন্থার রোগ থেকে দূরে থাকতে পেরেছে। তাদের সামাজিক জীবনটি তৈরি হয়েছে কট্টর ‘শিবির’ ভাবনাকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে।
কিন্তু প্রণব মুখার্জির মতো যারা কট্টর হিন্দুত্ববাদের রোগ শরীরে পুষে রেখে; অসাম্প্রদায়িক সভা-সমিতিগুলো আলোকিত করেছেন এতকাল; হিন্দু সমাজের তরুণেরা বিভ্রান্ত হয়েছে এইরকম ফেইক আইকন দেখে; তাদের কাছ থেকে শিখে। এরপর অনেকেই এতকাল পরে এসে যখন দেখছে সেক্যুলারিজমের আস্তিনের নীচে লুকিয়ে ছিলো কট্টর হিন্দুত্ববাদ; তখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে। ফলে তাদের সামাজিক জীবনটি কট্টর ‘শিবসেনা’ ভাবনাকে দূরে রাখার অভিনয় দিয়ে প্রতারিত হয়েছে।
এ কারণেই মৌলিকত্ব বা স্বকীয়তা বিষয়টি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। তাতে রোগ নির্ণয় ও প্রতিষেধক ব্যবহার সহজ হয়।
আজকের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হচ্ছে, সত্যজিৎ রায়ের মতো অসাম্প্রদায়িক ভাবনার জলসাঘরটি মানবতাপ্রিয় দক্ষিণ এশীয় জনগোষ্ঠীর স্বপ্নের প্রত্নগৃহ; পোড়োবাড়ি। আর আজকের ভারত হচ্ছে ক্রমশ হিন্দুভারত হয়ে ওঠার নব্য বজরংগৃহ।
একদিকে যেমন গুজরাটি অমিত মোদিজীরা দেশটিতে নতুন হিন্দুত্বের বানানোর স্বপ্নে বিভোর। স্বপ্নে রাম মন্দির বানানোয় ব্যস্ত সেই দেশের অন্য দ্বিতীয় ধর্ম বিশ্বাসীরা তার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই ও আন্দোলনে ব্যস্ত। কাশ্মীর থেকে আসাম প্রায় সর্বভারতীয় কাঠামোতে ধর্মনিরপেক্ষতার আওয়াজ তুলতে ব্যস্ত। কিন্তু বৃটিশদের ইন্ডিয়া ত্যাগ করার ৭০ বছরেও নিজ ধর্মের নারীদের প্রতি তিন তালাকের নামে চরম সামাজিক সহিংসতা বজায় রেখেছিল পশ্চিম বাংলার জামায়েতে ইসলামের সর্বভারতীয় নেতা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরিরা কিংবা হায়দ্রাবাদের আসাদউদ্দীন ওয়ারসিরা ।
অবশেষে বর্তমান মোদি সরকারের আমলে মুসলিম নারীদের প্রতি চরম সামাজিক নিগ্রহ তিন তালাক ব্যাধি রোধ করতে সুপ্রিম কোর্টের একটি বৃহৎ বেঞ্চ বিষয়টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং মোদি সরকার তিন তালাকের বিরুদ্ধে নতুন আইন তৈরি করে।
এর পরে ভারতে বসবাসরত ইসলাম পন্থীরা তিন তালাক বিরোধী নতুন আইনের বিরোধিতা শুরু করে। তৃণমূল কংগ্রেসের মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লাহসহ অন্যরা মাঠ গরম করতে থাকে। তৃণমুল কংগ্রেস পার্লামেন্টে এই আইনের বিরুদ্ধে ভোট দেয়।
আমাদের এই ভুখন্ডে এক সময় একই সামাজিক ব্যাধি চালু ছিল ইসলাম ও শরিয়া আইনের নামে। ১৯৬১ সালে সামরিক শাসক আইয়ুব খান অর্ডিন্যান্স জারি করে তিন তালাক নিষিদ্ধ করে ছিলেন। কিন্তু আজকের পাকিস্তানে সেই পুরানো তিন তালাক ব্যাধি ফিরে এসেছে বলে জানা যায়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিপক্ষে তার দ্বিতীয় স্ত্রী হোয়াটস এ্যাপে তালাক পাঠানোর অভিযোগ করেছিলেন। মজার বিষয় হলো, বিশ্বে মুসলিম ধর্ম অনুসারী দেশগুলোতে এই তালাক বিষয়ে একক কোন অবস্থান নেই।
বৃটিশরা অবিভক্ত ইন্ডিয়া শাসনকালে হিন্দু ধর্ম অনুসারীদের মধ্যে প্রচলিত বহু সামাজিক সহিংসতা দুর করেছিল যার মধ্যে সতীদাহ, বিধবা বিবাহ, কেরালার দলিত নারীদের স্তন কর ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু হিন্দু নারীদের বিবাহ বিচ্ছেদের অনুমতি কিংবা নারীদের সম্পত্তির উত্তরাধিকারত্ব ছিল না বৃটিশ ইন্ডিয়ায়। নতুন রাষ্ট্র ভারত জন্মের পর ১৯৫৬ সালে হিন্দু নারী বিবাহ ও সম্পত্তি আইন প্রতিষ্ঠালাভ করে। যার মাধ্যমে হিন্দু নারীরা সম্পত্তির উত্তারাধিকারত্ব লাভ করে। এই আইন স্বাধীন নতুন রাষ্ট্রে ধর্মীয় প্রচলিত ধারণা পাল্টে দিয়েছে।
১৯৬১ সালের সামরিক শাসক আইয়ুব খান পাকিস্তানে মুসলিম পারিবারিক আইনের মাধ্যমে তিন তালাক ব্যবস্থা বাতিল করা হলেও, নারীদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার আইনে এক স্থায়ী বৈষম্য রেখে দেয়া হয়। কোরানের আলোকে উত্তরাধিকার হিসাবে পুত্র তুলনায় কন্যা পৈতৃক সম্পত্তির অর্ধেক প্রাপ্ত হবেন। অথচ কোরানের কোথাও পিতার সম্পত্তিতে পুত্র ও কন্যার সমান অংশ পাওয়ার ক্ষেত্রে কোন নিষেধ নেই। এখানে পুরুষতান্ত্রিকতা প্রাধান্য পেয়েছে। কোরান ব্যাখ্যাকারীরা পুরুষদের অনুকুলে ব্যাখ্যা দেয় যেন নারী সমান অংশ না পায়। এই আইনের ক্ষেত্রে মুসলিম দেশগুলোতে প্রায় একই অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। অথচ এই দেশগুলোর মানুষেরা যখন ইউরোপে যায় তখন উত্তরাধিকারের প্রশ্নে ‘নারী পুরুষ সমান’ এই ধারণা মেনে নেয়। এই দেশে কবে নারী পুরুষ উভয়ে একই সাথে, একইভাবে এই দাবী উপস্থাপন করবে সেদিনের প্রত্যাশায়।
সূত্র : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড