বিশ্বের প্রথম সেলফি তোলা হয় ১৭৬ বছর আগে
পদ্মাটাইমস ডেস্ক : একটি ছবি হলো হাজারটি শব্দের প্রতিরূপ। কোনো কিছু বলে বা লিখে যত সহজে বোঝানো যায়, ছবির মাধ্যমে তা আরো সহজে ফুটিয়ে তোলা যায়। মানুষের মনে কথার থেকে ছবি অনেক বেশি প্রভাব ফেলে। আজ বিশ্ব আলোকচিত্র দিবস। ছবি তোলাটা অনেকের কাছে ফ্যাসিনেশন বা প্যাশন।
ছবি তোলা কারো কাছে নেশা আর কারো বা পেশা। ছবি তোলার নেশায় শহর থেকে শহরতলি সর্বত্রই ক্যামেরা হাতে ছুটে বেড়ান তারা। ছবির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলে অনেক না বলা গল্পকে। আর এই ছবিপ্রেমীদের জন্য প্রতিবছরই ১৯ আগস্ট পালন করা হয় বিশ্ব আলোকচিত্র দিবস। সারা পৃথিবীতে সবাই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালন করে এই দিনটি।
১৮৩৯ সাল থেকে আগস্ট মাসের ১৯ তারিখকে আলোকচিত্রের দিন হিসেবে উদযাপন করে আসছে পুরো পৃথিবী।প্রিয় মুহূর্তগুলোকে ফ্রেমে বন্দি করে রাখার চিন্তা কিন্তু মানুষের মাথায় অনেক আগেই এসেছিল। ১৮ শতকের প্রথম দিকে বিজ্ঞানীরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন প্রকৃতির যেকোনো মুহূর্তকে ধরে রাখতে পারবে। ফরাসি উদ্ভাবক ‘জোসেফ নিসেফোর নিপেক’ প্রথম ছবিটি তিনি তোলেন ১৮২৭ সালে। তাকেই বলা হয় ফটোগ্রাফির জনক। তিনি ছিলেন ফ্রান্সের একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা।
নাইসফোর নিপেক ও লুইস ডেগুইরে ১৮৩৭ সালে, ডেগুরে টাইপ ফটোগ্রাফিক সিস্টেম আবিষ্কার করেন। এই উপায়ের নাম হলো ডেগুইররিয়ো টাইপ। বিজ্ঞানী লুইস ডেগুইর সর্বপ্রথম ছবি তোলার ব্যবহারিক এ উপায় আবিষ্কার করেন। তার নাম অনুসারেই ছবি তোলার এই উপায়ের নাম দেয়া হয় ডেগুইররিয়ো টাইপ ফটোগ্রাফি। ১৯৩৯ সালের ১৯ আগস্ট ফ্রান্স সরকার এটিকে স্বীকৃতি দান করে। তখন থেকেই ফটোগ্রাফিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। তখন থেকে আজ ডিজিটাল যুগ পর্যন্ত প্রতি সেকেন্ডে লাখো মানুষ কোটি কোটি ছবি তুলে।
এ তো গেল প্রথম ফটোগ্রাফির কথা। তবে জানেন কি, কবে প্রথম সেলফিটি তোলা হয়েছিল? বর্তমানে ছবি তোলার অন্যতম মাধ্যম সেলফি ক্যামেরা। এখন আর বিশেষ মুহূর্ত ফ্রেমবন্দি করতে কারো সহায়তা লাগে না। নিজের ছবি পছন্দসই তোলা যায় ইচ্ছামতো। কেউবা মুখ বাঁকিয়ে আবার পাউট করে ছবি তোলার কায়দা রপ্ত করেছে। তবে কখনো কি মনে হয়েছে প্রথম সেলফি কে তুলেছিলেন আর কবেই বা তুলেছেন?
১৮৩৯ সালের প্রথম দিকে আমেরিকান রবার্ট কর্নেলিয়াস একটি সেলফি ক্লিক করেছিলেন। কর্নেলিয়াস তার ক্যামেরাটিতে টাইম সেট করেন এবং লেন্সের পেছনে গিয়ে দারান। এভাবেই বিশ্বের প্রথম সেলফি তোলা হয়। ১৯৫৭ সালে প্রথম ডিজিটালটি তোলা হয়। এর রেজোলিউশন ছিল ১৭৬ × ১৭৬। সে সময় ছবি তোলার কাজটি মোটেই সহজ ছিল না। তখন ছিল টাইপের জামানা। টাইপ ছিল ছবি তোলার এক ধরনের পদ্ধতি, যেটির উদ্ভাবক ছিলেন এক ফরাসি শিল্পী ও বিজ্ঞানী লুইস ডেগুইরে।
১৮৩৯ সালে, রবার্ট কর্নেলিয়াস যে বছর তার সেলফি তোলেন সে বছরই টাইপের আগমন ঘটে, ছবি তোলার সেরা পদ্ধতি হিসেবে যা টিকে ছিল প্রায় ২০ বছর। একদিন খেয়ালের বশে ক্যামেরার লেন্সের সামনের ঢাকনাটি সরিয়ে ক্যামেরার সামনে টানা ১৫ মিনিট নিজের ছবি তুলেছিলেন পেশাদার রসায়নবিদ কর্নেলিয়াস।
সেলফি নামকরণের ঘটনাও বেশ মজার। শব্দটির প্রথম ব্যবহার হয় ২০০২ সালে এক অস্ট্রেনীয় তরুণ ইন্টারনেটের একটি ফোরামে নিজের ২১তম জন্মদিনে তোলা একটি ছবি পোস্ট করে এটিকে সেলফি নাম দেন। ইনস্টাগ্রাম হ্যাশট্যাগ হিসেবে সেলফির প্রথম ব্যবহার হয় ২০১১ সালের ২৭ জানুয়ারি। এতে হয়তো ভাবতে পারেন, সেলফি নামে হালের এই হুজুগের বয়স বোধ হয় খুব বেশি নয়। তবে শুনে তাজ্জব হবেন বৈকি বিশ্বের প্রথম সেলফিটি তোলা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ১৭৬ বছর আগে!
ফটোগ্রাফির সেই আদিকালে, ১৮৩৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়া শহরের এক যুবক রবার্ট কর্নেলিয়াস নিজেই নিজের ছবি তুলে সেলফির ইতিহাসের আদি পিতার আসনে বসতে সক্ষম হয়েছেন। পরে ছবির উল্টোপিঠে নিজের হাতে লিখে রেখেছিলেন- ‘দ্য ফার্স্ট লাইট পিকচার এভার টেকেন, ১৮৩৯’।
কর্নেলিয়াস কেবল রসায়নবিদই ছিলেন না, ছবি তোলার ব্যাপারে তার প্রচুর উৎসাহ ছিল। কাজ করতেন তার বাবার বাতির দোকানে, যেখানে আরো অনেক কাজের সঙ্গে কোনোকিছুর ওপর রূপার আবরণ দেয়া বা সিলভার প্লেটিংয়ে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন তিনি। দোকানের এক খদ্দের একটি টাইপের জন্য সিলভার প্লেটিংয়ের কাজ নিয়ে এসেছিলেন। তার কাছেই ছবি তোলার এই নতুন পদ্ধতির কথা শোনেন কর্নেলিয়াস এবং শুরু করেন এর চর্চা।
কীভাবে টাইপকে আরো উন্নত করা যায় তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা শুরু করেন তিনি। এই গবেষণা করতে করতেই একদিন তুলে ফেলেন সেই বিখ্যাত ছবি, যা শুধু বিশ্বের সর্বপ্রথম সেলফিই নয়, ক্যামেরায় তোলা বিশ্বের সর্বপ্রথম প্রতিকৃতিও। টাইপ যখন প্রথম উদ্ভাবিত হলো, তখন অনেকে সমালোচনা করে বলেছিলেন, এটি দিয়ে পোট্র্রেট বা প্রতিকৃতির ছবি তোলা সম্ভব নয়। এসব শুনেই কর্নেলিয়াসের আরও বেশি করে আগ্রহ জন্মায় নিজের ছবি তোলার ব্যাপারে।
সেই বিখ্যাত ছবিটি তোলার পর আলোকচিত্র নিয়ে আরো অনেক কাজ করেন রবার্ট কর্নেলিয়াস। ১৮৪০ সালে ‘ফিলাডেলফিয়া লেজার’ নামে একটি পত্রিকায় বিশ্বের সর্বপ্রথম বিজ্ঞাপনী আলোকচিত্র প্রকাশিত হয়, সেটি তারই তোলা। যুক্তরাষ্ট্রের সর্বপ্রথম ফটোগ্রাফি স্টুডিওগুলোর একটি তারই প্রতিষ্ঠা করা, যদিও ব্যবসায়িক ব্যর্থতার কারণে অচিরেই স্টুডিও বন্ধ করে দিয়ে বাবার ব্যবসা দেখাশোনাতেই ফের আত্মনিয়োগ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে প্রচারবিমুখ কর্নেলিয়াস কিন্তু আলোকচিত্রের ভুবনে নিজের কাজ নিয়ে খুব একটা কথাবার্তা বলতেন না।
১৮৬০ সালে সক্রিয় কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণের পর মোটামুটি নিভৃতেই জীবন কাটিয়ে দেন তিনি। ১৮৯৩ সালে, মৃত্যুর কয়েক দিন আগে নিজের তোলা কয়েকটি ছবির কথা এক বন্ধুকে বলে যান কর্নেলিয়াস। তার মৃত্যুর ৮২ বছর পর আমেরিকান ফিলোসফিক্যাল সোসাইটির এক গ্রন্থাগারিক কর্নেলিয়াসের তোলা একটি ছবি আবিষ্কার করেন। এরপর একে একে তার প্রায় ৩০টি আলোকচিত্র আবিষ্কৃত হয়। এর বেশিরভাগই ছিল ফিলাডেলফিয়া শহরের নামিদামি লোকদের টাইপ। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে সাড়া জাগিয়েছে ১৮৩৯ সালে তোলা তার সেই সেলফি। রবার্ট কর্নেলিয়াসের বিখ্যাত এই সেলফি বর্তমানে লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে রক্ষিত আছে।