ঔষধ সাম্রাজ্যবাদ: মুনাফা যেখানে শেষ কথা
মনোয়ারুল হক : পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাণিজ্য পণ্য কোনটি? নানা মত পাওয়া যাবে। অনেকে বলবেন অস্ত্র অথবা অন্য কিছু। আসলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক পণ্য ঔষধ। আজকের ৭৮০ কোটি মানুষের পৃথিবীতে এমন কাউকে খুজেঁ পাওয়া যাবে না যিনি জীবনে ঔষধ গ্রহণ করেননি। কোন না কোন ঔষধ যেমনএ্যালেপ্যাথি/ হোমিওপ্যাথি / আয়ুর্বেদী/ কবিরাজি / ইউনানী নানা দেশে নানা নাম কিন্তু উদ্দেশ্য, দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার স্বপ্ন যা প্রকারান্তে প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করা।
পৃথিবীর জন্মের ধর্মীয় ব্যাখ্যা আর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এক নয়। আমরা যেটাই গ্রহণ করি প্রকৃতির কাছে সকল প্রাণী চির পরাজিত। মানুষ যতই দীর্ঘকাল বাঁচার চেষ্টা করুক না কেন সাধ্য নেই অনন্তকাল বেঁচে থাকার। পৃথিবীর সকল প্রাণিকুলের জন্য প্রকৃতি তার নিজস্ব পছন্দমত একটা জীবনচক্র নির্ধারণ করেছে, তার কোন ব্যত্যয় ঘটেনি। এই প্রকৃতির আরেক নাম সৃষ্টিকর্তা। পৃথিবীর ৭৮০ কোটি মানুষের মধ্যে খুব সামান্য যারা সৃষ্টিকর্তার এই কর্তৃত্ব অস্বীকার করেন।
সৃষ্টিকর্তা নানা নামে পরিচিত পৃথিবীর মানুষের কাছে। পৃথিবীর জানা ইতিহাসের অন্যতম দক্ষিণ আমেরিকার মায়া সভ্যতা। এই জনগোষ্ঠীর মধ্যেও বেঁচে থাকার লড়াইয়ের কথা জানা যায়। হাজার হাজার বছরের পুরানো সমাজগুলোতে মানুষের প্রকৃতির নিয়মের বাইরে বেঁচে থাকার চেষ্টাকে পুঁজি করে পৃথিবীর সকল সমাজে গড়ে ওঠে এক ব্যবসা যার নাম চিকিৎসা।
পুরাতন সমাজগুলোতে প্রথমে গড়ে ওঠে আধ্যাত্মিকতার ব্যবসা। আগমন ঘটে ধর্মের। প্রসারিত হয় মানুষকে দীর্ঘকাল বাঁচিয়ে রাখার ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতার।
এর পরেই আগমন ঘটে ঔষধ নামক বাণিজ্যিক পণ্যের। সমাজ থেকে সমাজে ঔষধ বাণিজ্য আস্তে আস্তে আধ্যাত্মিক বাণিজ্যের জায়গা দখল করে নেয়। প্রথম সময়কার ঔষধের কাঁচামাল ছিল প্রাকৃতিক যা কিনা মানুষের শরীরের ব্যাপক কোন ক্ষতি সাধন করতে পারত না। এর পরে ধীরে ধীরে গড়ে উঠল রাসায়নিক ঔষধ যা আজকের ঔষধ সাম্রাজ্যবাদ।
আর কেমিস্টদের হাত ধরে যখন বিভিন্ন রাসায়নিক পণ্য উৎপাদন শুরু হলো, বিপত্তি আসলো তখন থেকেই। প্রাণিকুলের জন্ম, মৃত্যু, বেড়ে ওঠা, সবই প্রকৃতি দ্বারা নির্ধারিত। সাধারণভাবে কোন প্রাণীর এই জীবনচক্রের বাইরে যাওয়া সম্ভব না। বিভিন্ন প্রাণীর বিভিন্ন জীবনচক্র। মানবকুল সাধারণভাবে শতাধিক বছরের জীবনচক্র, এর বাইরে যাওয়ার উপায় নাই।
ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার প্রভাবে প্রাণীর জীবনচক্র দীর্ঘায়িত করার লড়াইয়ে অনুপ্রবেশ ঘটলো রাসায়নিক ঔষধের। যার প্রভাবে মানবজাতি নিমজ্জিত হল নানা নামের নতুন রোগে। গত শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রোগের নামের সন্ধান দিল ওষুধ বিজ্ঞানীরা, যার নাম এইচআইভি (HIV)। বলা হলো, এ এমন এক রোগ যা নিয়ন্ত্রণ নাহলে মানবকুল ধ্বংস হয়ে যাবে। কিছুকালের মধ্যে ঔষধ ব্যবসায়ীরা নানা ধরনের ঔষধ নিয়ে হাজির হলো। HIV নিয়ে যে আতংক সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া হলো তার মাধ্যমে লক্ষ কোটি ডলার উপার্জন হলো ঔষধ ব্যবসায়ীদের। আছে ক্যান্সার নামক আরেক রোগ, যে রোগের নিরাময়ের কোন ব্যবস্থা ঔষধবিজ্ঞান আজও স্পষ্ট করতে পারে নাই। অথচ প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানি কেমোথেরাপির মাধ্যমে লুটে নিচ্ছে কোটি কোটি ডলার।
ঔষধ সাম্রাজ্যবাদের মোড়ল আমেরিকা। তার নিজ দেশে ফেডারেল ড্রাগ এ্যাডমিনেস্ট্রশন (FDA) যাদের কাজ নতুন ঔষধের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে অনুমতি প্রদান করা। বছরের পর বছর অনুমতিপ্রাপ্ত এই সমস্ত ঔষধ মানুষের শরীরে ব্যবহারের পর অনেক ঔষধ প্রত্যাহার করা হয় অকার্যকর প্রমাণ হওয়ায়, অথচ শত শত কোটি ডলার হাতিয়ে নেওয়ার পর শুধু ঔষধটি প্রত্যাহার হয়, তাদের কোন শাস্তি বা জরিমানা হয় না।
আমাদের দেশের ঔষধ প্রশাসন আরো দূর্বল ও অকার্যকর। এখানকার দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও লুটপাঠ প্রায় খবরের শিরোনাম হতে দেখা যায়। ঔষধ কোম্পানিগুলি ডাক্তারদের নানাভাবে উৎকোচ প্রদান করে অপ্রয়োজনীয় ঔষধ রোগীদের চাপিয়ে দিচ্ছে।
বিশ্বকে আবার ঔষধ সাম্রাজ্যবাদের খপ্পড়ে পড়তে হয়েছে কেভিড -১৯ এর কারণে। প্রথমে শুরু হলো, চিন কর্তৃক ভাইরাস রফতানি তত্ব। বিশ্বের কাছে সবচেয়ে হিংস্র সাম্রাজ্যবাদ আমেরিকার ট্রাম্প ঘোষণা করলেন, এই ভাইরাস চিন তাদের দেশে রফতানি করা হয়েছে। সেই তত্ব কিছুদিনের মধ্যে নতুন তত্বে পরিনত হলো, ট্রাম্প বললেন, বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা চিনের পক্ষে কাজ করছে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার চাঁদা পরিশোধ বন্ধ করে দিল। এরপর শুরু হলো ম্যালেরিয়ার ঔষধ ক্রয় বিক্রয়ের নতুন ঔষধ রাজনীতি। কিছুদিন পরে জানানো হলো, এ ঔষধ কোনো কাজে আসেনা ।
আমাদের দেশে জন্ম নিল রিজেন্ট হাসপাতাল। সাবরিনা শাহেদের সন্ধান পাওয়া গেল। শুরু হলো এন ৯৫ মাস্ক কেলেংকারী। পাওয়া গেল দেশের গণমানুষের খেদমত দাবীদার নানা প্রতিষ্ঠানের ভাইরাসের কিট কেলেংকারী।
কয়েক মাসের এই সব কিছুর পর শুরু হলো ভ্যাকসিন যুদ্ধ। হঠাৎ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন শোনালেন ভ্যাকসিন আবিস্কারের গল্প। অনেকটা স্বপ্নে পাওয়া তাবিজের মত। চিন যদিও আগে থেকেই ভ্যাকসিনের কাহিনী নিয়ে বাংলাদেশের উপর ভর করছিল। ভারতের মোদিজী তো দিনক্ষণ নির্ধারন ফেলেছিলেন। রাশিয়া প্রস্তাব করেছে ভারতের সাথে যৌথভাবে টিকা গবেষণা শেষ করবে। বাংলাদেশের সাথে চিনের প্রস্তাব আটকে গেছে কোন অদৃশ্য হাতে। এই হচ্ছে আজকের বিশ্বের ঔষধ সাম্রাজ্যবাদের কাহিনী যেখানে আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাদের গিনিপিকে পরিনত করা হয়।
সূত্র : দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড