কোন দেশের মানুষ বেশি আত্মহত্যা করে?

প্রকাশিত: ১২-০৯-২০২০, সময়: ১৪:২৫ |

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : আত্মহত্যা বা আত্মহনন হচ্ছে কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের জীবন বিসর্জন দেয়। ল্যাটিন ভাষায় সুই সেইডেয়ার থেকে আত্মহত্যা শব্দটি এসেছে। যার অর্থ হচ্ছে নিজেকে হত্যা করা। যখন কেউ আত্মহত্যা করেন, তখন জনগণ এ প্রক্রিয়াকে আত্মহত্যা করেছে বলে প্রচার করে।

ডাক্তার বা চিকিৎসকগণ আত্মহত্যার চেষ্টা করাকে মানসিক অবসাদজনিত গুরুতর উপসর্গ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। ইতোমধ্যেই বিশ্বের অনেক দেশেই আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে এক ধরনের অপরাধরূপে ঘোষণা করা হয়েছে। অনেক ধর্মেই আত্মহত্যাকে পাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যিনি নিজেই নিজের জীবন প্রাণ বিনাশ করেন, তিনি – আত্মঘাতক, আত্মঘাতী বা আত্মঘাতিকা, আত্মঘাতিনীরূপে সমাজে পরিচিত হন।

প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-এর মতে প্রতি বছর সারা বিশ্বে যে সব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে আত্মহত্যা ত্রয়োদশতম প্রধান কারণ। প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যার কারণে যেসকল লোকেদের মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যায় তাদের মধ্যে দুই দশমিক শূন্য ছয় শতাংশ বাংলাদেশী। এছাড়া কিশোর-কিশোরী আর যাদের বয়স পঁয়ত্রিশ বছরের নিচে, তাদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হচ্ছে আত্মহত্যা। পরিংগখ্যান বলছে নারীদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে আত্মহত্যার হার অনেক বেশি। পুরুষদের আত্মহত্যা করার প্রবণতা নারীদের তুলনায় তিন থেকে চার গুণ।

জানেন কি? আজ বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। ২০০৩ সাল থেকে প্রতি বছর সেপ্টেম্বরের ১০ তারিখ বিশ্বব্যাপী এই দিনটিকে ‘আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। মূলত নিজেকে শেষ করে দেওয়ার উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে সচেতনতা তৈরি করার লক্ষেই এই উদ্যোগ। কিন্তু তারপর থেকে দেড় দশকের বেশি সময় কেটে গেলেও ঠিক কতটা পরিবর্তন এসেছে পরিস্থিতিতে? পরিসংখ্যানের দিকে চোখ রাখলে কিন্তু আশান্বিত হওয়ার বিশেষ কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে যে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল ও নিম্নআয়ের কোনো দেশেই আত্মহত্যা প্রতিরোধের জন্য নির্দিষ্ট কোনো কৌশল বা কর্মপন্থা ঠিক করা হয়নি।

সেলিব্রেটি থেকে সাধারণ মানুষ হতাশায় ভোগেন প্রতিনিয়ত। মূলত মানসিক অবসাদ থেকেই আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটে। সম্প্রতি বলিউড অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর পর দেশজুড়ে তোলপাড় তুলেছিল আত্মহত্যার প্রসঙ্গ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১১ সালে বাংলাদেশের মানুষের আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল ১৯ হাজার ৬৯৭ জন। পুলিশ সদর দফতরের মতে, ২০১৩ সালে বাংলাদেশে ১১ হাজার ৯৯ জন আত্মহত্যা করেছে। দ্য ডেইলি স্টারের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০০২ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ৭৩ হাজার ৩৮৯ জন আত্মহত্যা করেছে। এরমধ্যে ৩১ হাজার ৮৫৭ জন নিজেকে ফাঁসি দিয়ে এবং ৪১ হাজার ৫৩২ জন বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে।

আচ্ছা জানেন কি? কোন দেশের মানুষ বেশি আত্মহত্যা করে, আর কেনই বা করে? চলুন জেনে নেয়া যাক সেসব দেশ সম্পর্কে-

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুসারে, এই তালিকায় শুরুতেই আছে ক্যারিবীয় দেশ গায়ানায়। ছোট এই দেশে প্রতিএক লাখ নাগরিকে আত্মহত্যার ঘটনা ৪৪.২ শতাংশ। প্রচণ্ড দারিদ্র্য, মাত্রাতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন এর কারণ বলে জানা গেছে। তরল বিষ পান করেই গায়ানার মানুষ বেশি আত্মহত্যা করেছে।

তালিকায় গায়ানার পরেই উত্তর কোরিয়ার অবস্থান। প্রতি বছর গড়ে সেখানে প্রায় ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে৷ মানবাধিকার লঙ্ঘন, আর্থিক দৈন্যতা, সরকারি নির্যাতনের ভয় থেকে সৃষ্ট চাপ। এসব কারণে সেদেশের মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এরপর তালিকার আছে দক্ষিণ কোরিয়া, ২৮.৯ শতাংশ। চাকরির চাহিদা পূরণের চাপ এবং পড়ালেখা ও সামাজিক চাপের কারণে দক্ষিণ কোরিয়রা আত্মহত্যা করে থাকে। বিশেষ করে নভেম্বরে কলেজ ভর্তি পরীক্ষার আগে আত্মহত্যার হার যায় বেড়ে। বিষয়টি এতটাই উদ্বেগজনক যে, সরকার সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর উপর নজরদারি করে সম্ভাব্য আত্মহত্যা ঠেকানোর পদক্ষেপ নিয়ে থাকে।

দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কাতেই সবচেয়ে বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে। এক লাখে তাদের আত্মহত্যা করার প্রবণতা ২৮.৮ শতাংশ। দারিদ্র্য ও বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা এর কারণ বলে জানা গেছে। এরপরের অবস্থানে আছে লিথুয়ানিয়া, ২৮.২ শতাংশ। ইউরোপের মধ্যে এই দেশটিতেই আত্মহত্যার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সামাজিক ও আর্থিক সমস্যাই সেখানকার মানুষের আত্মহত্যার মূল কারণ। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে দেশটিতে আত্মহত্যার হার ছিল আরো বেশি।

এরপর সুরিনাম, ২৭.৮ শতাংশ। তালিকায় এর পরের অবস্থান মোজাম্বিক, প্রতি এক লাখে তাদের আত্মহত্যার ঘটনা ২৭.৪ শতাংশ। তারপর আছে নেপাল,২৪.৯ শতাংশ। এরপর তানজানিয়া, ২৪.৯ শতাংশ। তালিকার দশের মধ্যেই আছে কাজাখস্থান,২৩.৮ শতাংশ এবং বুরুন্ডি,২৩.১ শতাংশ।

তবে হাইস্কুলের নিচে পড়ে এমন শিশু আত্মহত্যার ঘটনা সবচেয়ে বেশি জাপানে। জাপানের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত তিন দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শিশু আত্মহত্যা করেছে ২০১৭ সালে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের মার্চ মাস পর্যন্ত প্রাথমিক থেকে হাইস্কুলের ২৫০ জন শিশু আত্মহত্যা করেছে বলে জানা গেছে।১৯৮৬ সালের পর থেকে জাপানে এত বিপুল সংখ্যক শিশু আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেনি।

আত্মহত্যার আগে ঐসব শিশুরা যেসব সমস্যার কথা জানিয়েছিল তার মধ্যে রয়েছে পারিবারিক সমস্যা, ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা এবং বন্ধুদের কাছ থেকে অবজ্ঞা বা তাচ্ছিল্য পূর্ণ ব্যবহার।তবে স্কুলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এসব ঘটনার ১৪০টিরই সঠিক কারণ তারা জানে না কারণ সেসব ক্ষেত্রে শিশুরা আত্মহত্যার আগে কোনো নোট রেখে যায়নি। আত্মহত্যা করা অধিকাংশ শিশুই হাই স্কুলের শিক্ষার্থী। ১৮ বছরের কম বয়সী জাপানি শিক্ষার্থীরা সাধারণত এসব স্কুলে পড়ে।

২০১৫ সালে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা প্রবণ দেশগুলোর একটি ছিল জাপান; তবে এই প্রবণতা বন্ধ করতে জাপান সরকার বিভিন্ন ধরণের পদক্ষেপ নেয়ার পর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয় বলে উঠে আসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে। ২০০৩ সালে জাপানে মোট আত্মহত্যার ঘটনা ছিল ৩৪ হাজার ৫০০টি, যা কমে ২১ হাজারে নেমে আসে ২০১৭ সালে। এর মূল কারণ হিসেবে বলা হয় জাপানে ঐতিহাসিকভাবে প্রচলিত ‘সম্মানজনক আত্মহত্যা’র ঐতিহ্যকেও দায়ী মনে করেন অনেকে। এছাড়া জাপানে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করলে, আত্মহত্যা করা পাপ নয়। জাপানে আত্মহত্যা সংক্রান্ত ঘটনায় বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো সহজেই বীমার অর্থ হস্তান্তর করে।

তবে যাই হোক না কেন। বেঁচে থাকার আনন্দ উপভোগ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। মানসিক অবসাদ দূর করার অনেক উপায় আছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, সঠিক চিকিৎসায় মানসিক হতাশা, অবসাদ দূর করা সম্ভব।

উপরে