শেষরাতের ভাঙাপুরাণ
কনক আমিরুল ইসলাম
১.
আর একবার ভালোবাসি সখী, আয়
তোর গ্রীবাজুড়ে এঁকে দেই
সভ্যতার ক্রমবিবর্তন।
হয়ে যাক সংলাপ
আমাদের প্রথম আলিঙ্গনের ভাষায়।
হেরোডটাস তখন গ্রীসে …
তুমি আর আমি
আমাদের প্রাণের বাংলাদেশে।
হোকনা অনুসন্ধান ভালোবাসার
আমাদের প্রথম চুম্বন রেখায়
স্বরলিপি হয়ে থাক অন্তহীন ঠোঁটের কিনারে
এসো ইতিহাস হই আমরাও
আজ কাল ও আগামীর দিনগুলি
চেপে ধরে থাক না
আমাদের ঘামে ভেজা দাগ হয়ে।
২.
আমরাও উত্তেজিত হই গরম নিশ্বাসে
ভার্জিল-ওভিদ -লিভি
কেউ নয় আজ …
আমাদের এ রাতে শুধুই হোমার
ইলিয়াড-ওডেসি-হেক্টোর-একিলিস
বিকাশের প্রক্রিয়ায়
আমরাও মহাকাব্য হবো প্রশ্বাসে
তোর ক্লান্ত চোখের তারায়
কখনো রবীন্দ্রনাথ-শেক্সপীয়র
নীহাররঞ্জন রায়ের ঝুলিভরা যাদু থেকে
হাজার বছরের বাঙালি
মৃদু কম্পনে আমাদের সভ্যতা
আর একবার দেখে নেবো,
ঠোঁটের নোনা স্বাদে ।
৩.
আজ কোনো কাব্য নয়
স্মৃতিস্তম্ভ হোক শরীরের মুদ্রায়
আমাদের যা কিছু ঘটে যায়
আজ হবো তাই ইচ্ছে মতোন,
লেখা হবে নাকো
হেরোডটাস-জনসন-র্যাপসন
আর সি মজুমদারের ভাষায়
তোর কোমর ছুঁয়ে শিলালিপি আঁকি
এ রাতের কাহিনি শুধুই আমাদের
কী সাধ্যি লিখে রাখে থুচিদাইদিস্ টয়েনবি
আমাদের এখনই সময় শুধু বুক দিয়ে ছবি আঁকার,
আমাদের অন্তরালে আমরা এক হই একত্রে
অথবা ভিজে উঠি প্রশ্বাসে
জীবনের ইতিহাস অথবা ইতিহাসের জীবন
আঁকি আমাদের দুই হাতে।
আমাদের চুম্বনের ক্রমিক বিবরণ লেখা হোক
সৃষ্টির সূচনায়।
গতিধারা হয়ে থাক
আজ ও আগামীর দিনগুলি
অলিখিত ইতিহাস করে দেবো তোর শয্যা
অনুলিপি হোক হাসির প্রত্ন
ভালোবাসার আর্কাইভসে।
৪.
ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানের মতো
ফিরে আসুক
আমাদের যাযাবর দিনগুলি
অথবা হায়ারোগ্লি¬ফিক আঁকি তোর মুখে
বুকের মেসোপটেমিয়ায় গড়ে তুলি সুমেরীয় সভ্যতা
হাম্মুরাবির এশিরীয় বালিকা নিপ্পুর রাজপ্রাসাদ।
বাগদাদের পথে পথে স্তনশোভা বিস্ফোরণ
সিরিজ বোমার আঘাতে
বড্ড ক্লান্ত আমার ক্যাল্ডীয় দুহাত
আয় সখী সাঁতার কাঁটি মহেঞ্জোদারোতে
তোর পায়ের পাতায় রঙিন হোক স্নানাগার
হেঁটে চলি লংমার্চ করে,
আফ্রিকা-গ্রীস হয়ে এশিয়া-মাইনরে
ফিনীশীয় বর্ণমালায় লিখে রাখি
আমাদের প্রথম প্রেমপত্র।
জরথুস্ত্র স্বাগত জানাবে আমাদের
পারস্যের পথে
কনফুসিয়াসও যোগ দেবে
মাঝপথে।
৫.
চীনের পাহাড়ে
লালগার্ড হয়ে আমাদের একরাত যাত্রা বিরতি
চোখ মেলে তাকা সখী
আর একবার
হেলেনিক চাহনি দেখি
তোর দুচোখের পিউপিলে
টাইবার নদীতে ধুয়ে নিবি মুখ
আমাদের পায়ের তলে রাজধানী জুলিয়াস সিজারের,
আমরাও হেঁটে চলি
দশ-বিশ-পঞ্চাশ হাজার বছর পেরিয়ে
কর্ডোভা থেকে প্যারিসের পথে
আর এক রাত
চকমকি পাথরের পুরোপলীয় দিনগুলি
শোভা করে দেবো তোর শোকেসে
আবারো সিন্ধুবাসীরা জেগে উঠবে
নবোপলীয় যুগ হয়ে।
৬.
তোর উজ্জ্বল ত্বকে পৃথিবীর মানচিত্র আঁকি
গ্রীসের নগর সভ্যতার মতোন
ওসিরিস সাঁতরে চলে নীলনদ
আমরাও টাইগ্রীসে নেমে পড়ি চল
আর্মেনিয়া পর্বত হয়ে,
অথবা হেঁটে চলি সাইবেরিয়ার পথে
গিলগামেস লেখা হবে আর একবার
তোর চাহনির মতো জেগে উঠবে বাগদাদ,
আমাদের বুকের স্পন্দনে স্পার্টাকাস হবে
প্রতিটি শিশু
অথবা দারুণ চে
পেরিক্লিসের এথেন্স হোক আমাদের শয়ন কক্ষ।
পেছন ফিরে দেখে নেবো
পাঁচ সহস্র খ্রিস্টপূর্বাব্দ
অথবা সিয়াটোল সাউথ আফ্রিকা।
তোর বুকে পিরামিড হোক
নাইজেরিয়ার রক্তপাথরে
আমিও ভাস্কর হবো তখন
গড়িয়ে পড়া রক্তে
পাথর সমাধি হবে ফারাওদের
সাদা কালো নয় লাল হবে প্রিয় রং।
মাৎস্যন্যায়েরও শেষ আছে প্রিয়তমা।
শেষ আছে বাংলার এমন দিনের
আমাদের হাত আরও মজবুত হবে
আবার আসবে হিউয়েন সাঙ
নতুন পর্যটনে লেখা হবে দিনলিপি
বিস্মিত জিউস
অলিম্পাসে বসে দেখে নেবে
বাংলাদেশ।
৭.
তোর নাকে নাক ঘষে
গড়ে তুলি মেসোপটেমিয়া
সুমেরীয় হাতে
আমাদের প্রেমের স্তবক গাইবে
মারডক দেবতা
আশুরিবাণি পালের পাঠাগারে
ভোর হবে
জলঘরি আর চন্দ্রপঞ্জিকা
শোভা পাবে
আমাদের ভালোবাসার মিউজিয়ামে
আবার পথশোভা হবে
প্রজাপতি খেলা করবে শূন্য উদ্যানে
আমাদের হেঁটে চলার পথে
কোথায় হারিয়ে যাবে আলেকজাণ্ডার
সিসেরো আসবে
তুই পা চালা প্রেয়সী,
পরবর্তী সমাবেশ আলেকজান্দ্রিয়ায়।
৮.
সাতশত পঁচাত্তর খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিনভর অপেক্ষা
মাঠভর্তি দর্শক অলিম্পিক উৎসবে
আমাদের অভিষেক আয়োজন এখানেই।
হাত ধরো সখী
একিমেনিস জাস্টিনিয়ান আসবে
চোখ মেলে তাকা প্যালেস্টাইনে
হিব্রু সভ্যতার বড়োই দুর্দিন আজ
ফুঁসে উঠছে গাজা উপত্যকা
রামাল্লার ঘরে ঘরে আগুন
বিস্ফোরিত বিষবাষ্প ঈগলের চোখে
দুচোখের পাতাভরা দৃষ্টি দিয়ে
ধুয়ে দে আমার ক্লান্ত দুপুর
পুড়িয়ে দে পেন্টাগন
আর তালেবানের আস্তানা।
কাবুলের পথে পথে বুদ্ধমূর্তির টুকরা
কান্দাহারের পথে পথে কার্পেট বোমায়
ফেটে যাওয়া নারীমুখ
পাইপ লাইনে লাখো শিশুর রক্তস্রোত
সাবধানে পা চালা প্রেয়সী
হিট্রাইট হতে চায় আমার দুই হাত।
৯.
আজ গঙ্গাস্নান হবে আমাদের
তোর শরীরের ভিজে ওঠা জলে
ত্রিহুত পাহাড়, বরেন্দ্র, রাজমহলজুড়ে
তেলিয়াগড়ের দুর্গম গিরিপথে
অবিশ্রাম আমাদের পথ হাঁটা।
একচোখে পুনর্ভবা, অন্যচোখে সুরমা
করতোয়া, আত্রাই, বুড়িগঙ্গা
আমাদের পথে পথে,
আমাদের মিলন রেখায়
বিশাল হয়ে যায়
গঙ্গা যমুনা হাকালুকি হাওড় অথবা চলনবিল
নাভিকেন্দ্র হয়ে ওঠে তোর স্নায়ুজল
মধুপুর সিলেট ভাওয়াল ময়ূরভঞ্জ
সুন্দরবন অথবা কখনো হিমালয়।
তোর চোখে গোলপাতার ছায়া করে দেবো
শেষ চুম্বনের মতো
পায়ের ধুলোয় জেগে উঠবে
মৌর্য-গুপ্ত-পাল-সেন কিংবা অতীতের
কোনো এক বিস্মৃত রাজবংশ
তোর নিশ্বাসে পাহাড়পুর
বুকের জমিনে মহাস্থান-ময়নামতি
কবেকার জৈন মন্দির
শক-হুণ-মোগল অথবা পাঠানের ধ্বংসযজ্ঞ
তুই পা চালা প্রেয়সী
রাত ভোর হয়ে এলো
সুমুখেই সোনার বাংলা।