বাংলাদেশের উন্নয়ন এখনও ভঙ্গুর

প্রকাশিত: মে ৩০, ২০২৩; সময়: ১১:৩৬ পূর্বাহ্ণ |
বাংলাদেশের উন্নয়ন এখনও ভঙ্গুর

পদ্মাটাইমস ডেস্ক: বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তবে এ অগ্রগতি এখনও ভঙ্গুর। কারণ যারা দারিদ্র্যসীমা থেকে বের হয়েছে, তারা যে কোনো সময় আবার দরিদ্র হয়ে যেতে পারে। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা এখনও এত মজবুত হয়নি। যে কোনো ধরনের বাড়তি অর্থনৈতিক চাপ তারা সামাল দিতে পারবে না বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের চরম দারিদ্র্যবিষয়ক বিশেষ দূত অলিভিয়ার ডি শ্যুটার।

চরম দারিদ্র্য ও মানবাধিকার পরিস্থিতি দেখতে অলিভিয়ার ডি শ্যুটার ১২ দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছেন। সফর শেষে তাঁর পর্যবেক্ষণ নিয়ে রাজধানীর একটি হোটেলে গতকাল সোমবার বিকেলে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে ঢাকার জাতিসংঘ কার্যালয়। বাংলাদেশ সফরকালে ঢাকা, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও কক্সবাজারে শ্রমিক, কৃষক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, মানবাধিকারকর্মী এবং সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। ২০২৪ সালের জুনে বাংলাদেশ বিষয়ক সর্বশেষ প্রতিবেদন মানবাধিকার কাউন্সিলে পেশ করবেন এ দূত।

বাংলাদেশের উন্নয়নকে ভঙ্গুর বলার কারণ জানতে চাইলে অলিভিয়ার ডি শ্যুটার বলেন, অনেকে হয়তো দারিদ্র্যসীমার সামান্য ওপরে উঠেছে। তবে তাদের সেই পরিমাণ সম্পদ নেই। হঠাৎ কোনো বিপদ এলে তা মোকাবিলা করতে পারবে না। যদি ঘূর্ণিঝড়ে ফসলের ক্ষতি হয়, তা পূরণের অবস্থায় নেই অনেকের। এই হঠাৎ বিপদে তারা আবার দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে আসবে।

দারিদ্র্য নিয়ে বাংলাদেশের পরিসংখ্যান বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, বাংলাদেশের পরিসংখ্যান বিষয়ে আমার যথেষ্ট সম্মান রয়েছে। দারিদ্র্য নির্ণয়ে বাংলাদেশের শক্তিশালী পদ্ধতি রয়েছে। এখানে একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরতে চাই। সেটি হচ্ছে ২০০০ সালে অতিদারিদ্র্য ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে এখন তা ৫ দশমিক ৬ শতাংশে নেমে এসেছে, যা উল্লেখযোগ্য অর্জন। তবে বিশেষ দূত হিসেবে আমাকে চ্যালেঞ্জগুলোও দেখতে হয়। আমি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে ভবিষ্যতে আয়-ব্যয় জরিপের ক্ষেত্রে পুষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ঘর ভাড়াও আমলে নিতে আহ্বান জানাই।

শ্রমিকদের দরিদ্র রেখে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ন্যায্যতা পায় না জানিয়ে বিশেষ দূত বলেন, স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) মর্যাদা থেকে প্রত্যাশিত স্তরে উন্নীত হওয়ার পর একটি অধিকারভিত্তিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে বাংলাদেশ সরকারকে সস্তা শ্রমের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। মানুষকে দরিদ্র্যের মধ্যে রেখে একটি দেশ তার আপেক্ষিক সুফল বা উন্নয়ন ভোগ করতে পারে না।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) সমালোচনা করে অলিভিয়ার বলেন, যখন সরকারি কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসার সময় হয়, তখন ডিএসএ বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। কারণ তখন ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের কারণ দেখিয়ে তার অধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়। যদিও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য এ আইনটি করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, এর কারণে সুশীল সমাজ স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। স্বাধীন মতামত প্রকাশের কারণে এ আইনের আওতায় সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, বিরোধী দলের রাজনীতিক, শিক্ষকদের আটক করা হয়েছে।

এ আইনটি কার্যকর হওয়ার পর ২ হাজার ৪০০ জনের বেশি মানুষকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অনেককে দীর্ঘ সময় ধরে আটকে রাখা হয়েছে। যারা মানবাধিকারের জন্য লড়াই করে, তারা ভয়ভীতির মধ্যে বসবাস করবে– এটি স্বাভাবিক নয়। যতক্ষণ না এ আইনের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত এ আইনটি স্থগিত রাখার সুপারিশ করছি।
অলিভিয়ার ডি শ্যুটার বলেন, দেশ সার্বিক আয়ের বৈষম্য হ্রাসে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন হলেও এখন পর্যন্ত বহুমাত্রিক দারিদ্র্য রয়ে গেছে। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে আয়-বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। সার্বিক অর্থনৈতিক অগ্রগতি অসম হয়েছে। আদিবাসী, দলিত, বেদে, হিজড়া এবং ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘু যেমন– বিহারিদের সুযোগ বঞ্চিত করা হয়েছে। সরকার উন্নয়নের নামে অনানুষ্ঠানিক বসতিগুলোতে উচ্ছেদ চালিয়েছে। এক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে বা পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন প্রদান না করে বাসস্থানের অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে।

তৈরি পোশাক খাতে ন্যূনতম মজুরি ৫১ হাজার প্রস্তাব করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন মূলত তৈরি পোশাকশিল্পের মতো একটি রপ্তানি খাত দ্বারা ব্যাপকভাবে চালিত, যা সস্তা শ্রমের ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। ২০২৬ সালে এলডিসি মর্যাদা থেকে আসন্ন উন্নীতকরণের সুযোগকে ব্যবহার করে তৈরি পোশাকশিল্পের ওপর তার নির্ভরতা পুনর্বিবেচনা করার জন্য আহ্বান জানান।

বাংলাদেশের শ্রম আইনের সমালোচনা করে বিশেষ এ দূত বলেন, ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা, কর্মীদের শিক্ষিত করা ও প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং সামাজিক সুরক্ষার উন্নতিতে সরকারকে আরও বেশি সময় এবং সম্পদ ব্যয় করা প্রয়োজন। এ জাতীয় উদ্যোগ শুধু সুনামের চিন্তা করে এমন বিনিয়োগকারীদেরই আকৃষ্ট করবে না, এটি বাংলাদেশে উন্নয়নের একটি নতুন রূপরেখা তৈরি করবে, যা বৈষম্যমূলক রপ্তানি সুযোগের পরিবর্তে অভ্যন্তরীণ চাহিদা দ্বারা চালিত হবে।

সরকারকে সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও যৌক্তিক করার জন্য আহ্বান জানান অলিভিয়ার ডি শ্যুটার। তিনি বলেন, কর থেকে প্রাপ্ত জিডিপির অনুপাত উল্লেখযোগ্য হারে কম হয়েছে, যা প্রায় ৭ দশমিক ৮ শতাংশ এবং সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে অর্থায়নের জন্য প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সরকারি রাজস্ব আসে পরোক্ষ কর থেকে। অথচ আয়ের ওপর প্রত্যক্ষ কর থেকে আসে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। চিত্রটি উল্টো হওয়া উচিত।

রোহিঙ্গা নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে জাতিসংঘ দূত বলেন, যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হওয়া উচিত। তবে এ মুহূর্তে প্রত্যাবাসনের জন্য এখনও সহায়ক পরিবেশ তৈরি হয়নি। রোহিঙ্গারা চাইছে সেখানেই ফেরত যেতে, যেখান থেকে তারা পালিয়ে এসেছিল। তারা চাইছে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব, যা দেশটি প্রত্যাখ্যান করছে। আর রোহিঙ্গাদের চাওয়া হচ্ছে নিরাপত্তা, যে পরিস্থিতি সেখানে এখনও তৈরি হয়নি। ফলে কেউ বিশ্বাস করে না, প্রত্যাবাসন এখনই বাস্তবসম্মত।

রোহিঙ্গাদের জরুরি মানবিক প্রয়োজন মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও তহবিল দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে অলিভিয়ার ডি শ্যুটার বলেন, আন্তর্জাতিক দাতারা এতই কম অবদান রাখছেন যে, চাহিদার মাত্র শতকরা ১৭ ভাগ অর্থায়ন জোগাড় হয়েছে। মার্চ থেকে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি মাসিক ভাউচার ১২ ডলার থেকে কমিয়ে ১০ ডলার করতে হয়েছে। এটি আগামী জুনে আরও কমিয়ে ৮ ডলার করা হবে। রোহিঙ্গাদের কাজ করতে না দেওয়াকে মানবাধিকার লঙ্ঘন জানিয়ে কাজ করতে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে