সিএনজিতে সাংসদের সংসদ যাত্রা ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২৪; সময়: ২:৫৮ অপরাহ্ণ |
খবর > মতামত
সিএনজিতে সাংসদের সংসদ যাত্রা ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

এ বি এম কামরুল হাসান : নতুন সংসদের অধিবেশন শুরু হয়েছে গত ৩০ জানুয়ারী। সেদিন থেকে গণমাধ্যমের কল্যাণে একটি খবর চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। খবরটি ভাইরাল হয়েছে। খবর হল, যশোরের কেশবপুরের নবনির্বাচিত সাংসদ আজিজুল ইসলাম সিএনজি চালিত অটোরিকশা করে অধিবেশনে এসেছেন।

তিনি এই সংসদের কনিষ্ঠতম সাংসদও বটে। সংসদ ভবন চত্বরে যেখানে নামি দামি, উঁচু লম্বা গাড়ির মেলার মেলা বসে, সেখানে একজন সাংসদের গাড়ি না থাকায় সিএনজি চালিত অটো রিকশা চেপে সংসদে আসাটা একটা বিশাল খবরও বটে। কিন্তু কোটি টাকার প্রশ্ন হচ্ছে, কতদিন তিনি এই খবরে থাকবেন?

মেসেন্জারে দশ বছর আগের একটি এসএমএস খুঁজে বের করলাম। ২০১৪ সালের ১৫ জানুয়ারী একজন নবনিযুক্ত নবীন প্রতিমন্ত্রীকে তাঁর নতুন নিয়োগের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে আমার প্রত্যাশার কথা জানাই। না, তিনি আমার পরিচিত কেউ নন। নিজের পরিচয় দিয়ে লিখি। একজন প্রবাসী হিসাবে একজন স্বচ্ছ পরিচয়ের নবীন প্রতিমন্ত্রীকে সেদিন লিখেছিলাম। ‘আপনি দেশে একজন তরুণ মন্ত্রী। তরুণ এমপি মন্ত্রীদের কাছে দেশের তরুণদের অনেক প্রত্যাশা থাকে। ভবিষ্যতে দেশের উন্নয়নে আপনি আমাদের অন্যতম আশা।

আমরা আপনাকে অদূর ভবিষ্যতে একজন পরিচ্ছন্ন এবং সৎ (অবশ্যই) রাজনীতিবিদ হিসেবে দেখতে চাই। পরবর্তী হলফনামায় আপনার সম্পদের কোন অবিশ্বাস্য বৃদ্ধি দেখতে চাই না। আশা করি, আপনি আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবেন। তিনি আমার এসএমএস’র উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ধন্যবাদ, আমি এগুলো সব মনে রাখব।’

কাহিনীটা ভুলে গিয়েছিলাম। তরুণ, অপেক্ষাকৃত দরিদ্র সাংসদের সিএনজিতে চড়ে সংসদে আসার ভাইরাল খবরে আকৃষ্ট হয়ে গুগলে ঢু মারি সেদিনের সেই তরুণ মন্ত্রীর নির্বাচন পূর্ববর্তী হলফনামায়। দেখে সহজেই অনুমেয়, তিনি এই অজানা অচেনা সেদিনের তরুণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি মনে রাখেননি। হলফনামা অনুযায়ী, উক্ত সাবেক প্রতিমন্ত্রীর ২০০৮ সালে অস্থাবর সম্পত্তির মূল্য ছিল ২ কোটি ৩২ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ৬৬ কোটি টাকা। আর গেল নির্বাচনী হলফনামায় সেটার পরিমান ৮৯ কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল ২০০৯ সালে গঠিত মন্ত্রিসভার দুজন মন্ত্রীর কথা। একজন উত্তরবঙ্গের, আরেকজন দক্ষিণবঙ্গের। একজন মন্ত্রী হিসাবে শপথ নেয়ার জন্য ঢাকায় এসে উঠেছিলেন পুরান ঢাকার এক সস্তা হোটেলে। হোটেল থেকে বঙ্গভবনে শপথ নিতে যান সিএনজি বা রিকশা চড়ে। আরেকজন ঢাকায় কোন থাকার জায়গা না থাকায় মেয়ের বাসা থেকে বঙ্গভবনে যান মেয়ের জামাই এর গাড়িতে (অথবা সিএনজিতে)। একটা খবর বের হয় সে সময়, এ দুজন মন্ত্রীকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মন্ত্রী পাড়ায় একটি ঠিকানা দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন।

গুগলের দৃষ্টি এবার ২০০৯ সালের শপথের আগে ঢাকায় ঠিকানাহীন সেই সাবেক মন্ত্রী দুজনের দিকে। প্রথমে দক্ষিণবঙ্গ। ২০০৮ সালে তাঁর বার্ষিক আয় ছিল দুই লাখ টাকা। ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় সোয়া ২৭ লাখ টাকা । ২০০৮ সালে তাঁর গাড়ির মূল্য ছিল চার লাখ টাকা। ২০১৮ সালে তাঁর গাড়ির মূল্য ৫৫ লাখ টাকা।

উত্তরবঙ্গের সেই সাবেক মন্ত্রীর ২০১৪-২০২৩ সাল পর্যন্ত আয় খুব একটা বাড়েনি। তবে, নগদ অর্থের পরিমাণ নাকি বেড়েছে সাড়ে ৮৬ হাজার গুণ। ২০১৪ সালের হলফনামা অনুযায়ী তার হাতে নগদ অর্থের পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৫৯ টাকা। ২০২৩ সালে তার নগদ অর্থের পরিমাণ ৩ কোটি ১০ লাখ ১ হাজার ৪৯৭ টাকা। ঢাকায় যাঁর থাকার জায়গা ছিল না, ২০১৮ সালের হলফনামা অনুযায়ী ঢাকার উত্তরায় তাঁর রয়েছে পাঁচটি ফ্ল্যাট, যার প্রতিটির মূল্য দেখানো হয় ৬১ লাখ টাকা।

গণমাধ্যমের সুদৃষ্টিতে আজিজুল এমপি’র মত সেদিনও ভাইরাল হন এসব সাংসদ ও মন্ত্রীরা । আমরাও আপ্লুত হই এসব খবর পড়ে বা দেখে । অধিবেশন শুরুর দিন থেকে শুভার্থীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ইনবক্স ভরে যাচ্ছে ভাইরাল হওয়া এ বার্তায়। কিন্তু অতীতের দৃষ্টান্ত সমূহ ভেবে আজকাল আর মন গলে না । ভাইরাল হওয়া এসব খবরে ভাইরাস জ্বরাক্রান্ত হই না ।

এ জাতীয় খবর ভাইরাল করার আগে আমাদেরকে আরেকটি নির্বাচনী হলফনামা পর্যন্ত অপেক্ষা করা প্রয়োজন। যদি পরবর্তী হলফনামায় সম্পদের পরিমান ফুলে ফেঁপে না উঠে, তখন সিএনজি চড়ার খবর ভাইরাল করলে সেটি হবে জাতির জন্য মঙ্গলজনক । তবে সিএনজি যাত্রায় শরিক হওয়া সাংসদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তাটি হচ্ছে, যাঁদের কথা লেখাটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁরা সবাই এখন সাবেক।

লেখক: এ বি এম কামরুল হাসান, প্রবাসী চিকিৎসক, কলামিস্ট

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে