মাথা উঁচু করা শিক্ষক ছিলেন ড. শহীদ শামসুজ্জোহা

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৪; সময়: ১১:৫৮ পূর্বাহ্ণ |
খবর > মতামত
মাথা উঁচু করা শিক্ষক ছিলেন ড. শহীদ শামসুজ্জোহা

প্রফেসর ড. আসাবুল হক : ১৮ ফেব্রুয়ারি ড. শহীদ জোহা দিবস। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রতি বছর এ দিনটিকে ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালন করে এবং রসায়ন বিভাগ জোহা স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করে। ১৯৬৯ সালে জোহা স্যার প্রক্টরিয়াল দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শহীদ হন।

দুদিন আগে সন্ধ্যায় প্রক্টর অফিসে তিনজন ছাত্র এসে জোহা স্যার সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন কী জানতে চাইল। যেহেতু আমি প্রক্টরের দায়িত্বে আছি, এ জন্য হয়তো তাদের এই আগ্রহ। তারা পত্রিকায় লেখালেখি করে। আমি দুই লাইনে আমার কথা বললাম, ‘মাথা উঁচু করা শিক্ষক ছিলেন ড. শহীদ শামসুজ্জোহা। তিনি ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনে পাকসেনাদের হাত থেকে তার প্রাণপ্রিয় শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে নিজে বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে বুকে গুলি নিয়েছিলেন ভয়শূন্য চিত্তে।’

তারা তখনকার সময়ে আর এখনকার সময়ে প্রক্টরিয়াল দায়িত্ব পালনে কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে কিনা জানতে চাইল। বোঝা গেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলার বিঘ্ন ঘটছে- এ বিষয়ে তারা বেশ উদ্বিগ্ন। বিশ্ববিদ্যালয় হলো জ্ঞান বিতরণের জায়গা, মুক্তবুদ্ধির চর্চার জায়গা। এখানে ভিন্নতা থাকবে, মতের মিল থাকবে তার পরও অন্যকে সম্মান করতে হবে- এ জাতীয় কিছু জ্ঞানের কথা বললাম তাদের। আসলেই চারদিকে তাকালে বড় অস্থির লাগে। কেমন যেন একটা প্রচ্ছন্ন অস্থিরতা চারপাশে।

এই সময়ে দাঁড়িয়ে জোহা স্যারের কথা বলতে খুব কি স্বস্তি লাগবে? প্রক্টর হিসেবে জোহা স্যার আমাদের আদর্শ। জোহা স্যারসহ দেশের অনেক শ্রদ্ধাভাজনের ত্যাগের বিনিময়ে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ বেগবান হয় এবং আমরা লক্ষ্যে পৌঁছাই। রসিকতা করে ছাত্রগুলোকে বললাম- এখনকার সময়ে জোহা স্যার প্রক্টর হয়ে আসলে তার অধীনে কাজ করে দেখতাম তিনি কি জাদু দিয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে হেমিলিয়নের বংশীবাদকের মতো চলতেন!

সম্প্রতি কিছু বিষয় আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। গত ১২ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টায় ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বনাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ত্রিকেট ফাইনাল খেলা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনায় স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়কে জেতানোর জন্য যখন শিক্ষার্থীরা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে গগনবিদারি চিৎকার দিচ্ছিল, সে এক দেখবার বিষয়। তাদের চোখমুখ ও উৎসাহ-উদ্দীপনা বলে দিচ্ছিল, কোনো পেশিশক্তি নয়, টাকার বিনিময় নয়, কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে নয়- আমরা এসেছি বিশ্ববিদ্যালয়কে ভালোবেসে একটি পরিছন্ন ক্রিকেট খেলা দেখতে, দলের সাফল্য কামনা করতে। কিন্তু তেমনটি হয়নি। শিক্ষার্থীরা গ্যালারিতে বসে খেলা দেখবে সেটা তাদের নোটিশ করে জানানো হয়েছিল।

স্টেডিয়ামের ভেতর বেশ কয়েকজন শিক্ষক, প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা বিভক্ত হয়ে মাঠে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত ছিলেন। খেলা শুরুর ২০ মিনিটের মধ্যেই দক্ষিণ পাশের গ্যালারির গেট ও কাঁটাতারের বেড়া ভেঙে শিক্ষার্থীরা মাঠে ঢুকে পড়ে। আমরা অনেক অনুরোধ করে তাদের শান্ত রাখতে পারিনি। গুটিকয়েক দর্শকের অতি আবেগে একটা খেলার পরিবেশ নষ্ট হলো, এতে ছোট হতে হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেস বিজ্ঞপ্তি এবং গণমাধ্যমে একটি বিভ্রান্তিমূলক ছবিসহ সংবাদের মাধ্যমে ঘটনাকে আরও উসকে দেওয়া হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের অস্থিরতা আমরা করোনা মহামারিসহ অন্যান্য সময় দেখেছি। ২০২২ সালে ক্যাম্পাসের আম-কাঁঠালের বাগান লিজ না দিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রাখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সেখানেও দেখলাম শিক্ষার্থীদের অতি-উৎসাহী কার্যকলাপ। তারা ক্যাম্পাসের অপরিপক্ব আম-কাঁঠাল পেড়ে নষ্ট করছে, বাড়িতে পাঠাচ্ছে এবং তাদের কাজকে জাস্টিফাই করতে নানা যুক্তি তুলে ধরছে। সেখানেও আমরা তাদের বোঝাতে অক্ষম হলাম।

রমজান মাসের ইফতারি, বিভাগগুলোর বনভোজন, নবীনবরণ, জেলা-উপজেলা সমিতির অনুষ্ঠান ইত্যাদি সব জায়গাতে প্রচণ্ড রকমের অস্থিরতা কাজ করছে। আসলে কোথাও একটা সমস্যা থেকে যাচ্ছে। আমরা সবাই যেন নেটওয়ার্কের বাইরে চলে যাচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয় হলো মানুষ গড়ার কারখানা। আমরা যারা মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখাই, গল্প শোনাই এবং শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড়িয়ে যখন বলি- ‘মানুষ হও, অমানুষ হইও না।’ এ ধরনের উপদেশ শিক্ষার্থীদের অনেকে হয়তো আমলে নিচ্ছে না। আসলেই আমরা হয়তো তাদের বাস্তবমুখী ও বিশ্বাসযোগ্য স্বপ্ন দেখাতে পারছি না। আমরা যারা কারিগর আমাদের ভেতরেও অনেক সমস্যা আছে। এসব বিষয় নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার।

ভাষার মাস। ভাষার জন্য যারা রক্ত দিয়েছে, তাদের গভীরভাবে স্মরণ করছি। এ মাসেই আমাকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। দেখতে দেখতে দুই বছর হয়ে গেল। আমার প্রক্টরের সময়কালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকতা-কর্মচারীসহ অনেকে নানাভাবে আমাকে পরামর্শ দিয়েছে। এখনো পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। আপনাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমি চেষ্টা করি পরামর্শগুলো আমলে নিয়ে বাস্তবায়ন করতে। তবে বলব পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে অনেক কিছু করা সম্ভব হয় না।

জোহা স্যারের উত্তরসূরি হিসেবে বলতে চাই, ১৮ ফেব্রুয়ারিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ‘শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। কাজেই এ দিবসটিকে ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হলে জাতি আনন্দে চিত্তে তা গ্রহণ করবে বলে বিশ্বাস করি। আমরা সেই দিনটির অপেক্ষায় থাকলাম।

প্রক্টর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে