চিকিৎসক হতে চলেছে সেই উর্মি
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, বাঘা : অজপাড়া গাঁয়ের মেয়ে বলে, এসএসসি পাশের পর বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন মা-বাবা। মুখ ফুটে তাদের কিছু বলতে না পারলেও পড়া লেখা করে বড় কিছু হওয়ার আগ্রহটা প্রকাশ করেছিলেন সাক্ষরজ্ঞান দাদির কাছে। তাই ইচ্ছা পূরণের আগে বিয়ে নয় বলে বাঁধ সেধেছিলেন দাদী। তিনি বলেছিলেন তোমরা লেখাপড়ার খরচ চালাতে না পারলেও যেভাবেই হোক টাকার যোগান আমি দিব।
দাদির এমন অনুপ্রেরণা পেয়ে ভর্তি হয়েছিলেন গ্রামের কলেজে। সেই কলেজে পড়েই ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় চাঞ্চ পেয়েছেন কৃষক পরিবারের মেয়ে উরপীতা খাতুন উর্মি। চাঁদপুর সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন তিনি। ১০০ নম্বরের১ ঘন্টার এমসিকিউ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে৬৭ দশমিক ৭৫ নম্বর পেয়ে মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। ভর্তি হতে হবে এ মাসের ২০ ও ২২ তারিখে । তাতে তার টাকা লাগবে সাড়ে ২২(বাইশ) হাজার।
তবে দুঃচিন্তা পেছনে ফেলে তার সাফল্যে পরিবারের মুখে শোভা পাচ্ছে তৃপ্তির হাসি। আনন্দঘন পরিবেশ বিরাজ করছে স্বজনদের মাঝে । যদিও অর্থ সংকট পিছু ছাড়ছেনা পরিবারটির। ভর্তির টাকা জোগাড়ে জমিও লিজ দিয়েছেন তার বাবা। তাতেও রয়ে গেছে সমস্যা।
উরপীতা খাতুন উর্মি, নিজ এলাকার দিঘা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ থেকে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে উপজেলায় সেরা হন। ২০১৪ সালে নিজ গ্রামের ধন্দহ অমরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। পাশর্^বর্তী নাটোরের লালপুর উপজেলার বোয়ালিয়াপাড়া এম .এম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জেএসসি ও এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। ভালো ফলাফলে লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগ বাড়ে তার। লেখাপড়ার খরচ চালানোর সংগতি ছিলনা বলে,দাদি হাতের কাজ করে আর মা বাড়িতে হাঁসমুরগি পালন করে টাকা যুগিয়েছেন। কোন উপায় না পেয়ে ৬ মাস আগেও বিআরডিবি থেকে মাসিক কিস্তিতে ৩০ হাজার টাকা ঋণ করেছে পরিবার ।
উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে উরপীতা খাতুন উর্মি বলেন,ব্যক্তিগত জীবনে মা-বাবা,চাচার পরে দাদি আমার সবচেয়ে বড় অনুেেপ্ররণা। সব বিষয়েই দাদির সাপোর্ট বেশি পেয়েছি। মেডিকেলে ভর্তির প্রস্তুতির সময় হতাশায় থাকতাম। তখন আমাকে সাহস যুগিয়েছেন। তাদের সহযোগিতাই ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নকে বাস্তবে রুপান্তর করার চেষ্টা করেছি। আত্মীয়-স্বজন ও এলাকার মধ্যে আমি প্রথম ডাক্তার হতে যাচ্ছি।
তিনি জানান,অস্বচ্ছল সংসারে মা-বাবার কাছে কিছু চাইতে পারেননি। দাদি রেহেনা বেগমের সঞ্চিত কিছু টাকা নিয়ে রাজশাহীতে এক আত্নীয় বাসায় থেকে রেটিনা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে কোচিং করেছেন। সেই বাসা থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার দুরে কোর্চিং করেছেন বেশিরভাগ সময় পাঁয়ে হেঁটে। কোচিং এ যাবার সময় যে বাটুল ফোনটি দিয়েছিলেন,সেটি তার ছোট ফুফু তার দাদিকে দিয়েছিলেন। ফোনে টাকা রিসার্চ না করে শুধুমাত্র বাড়ির ফোনের অপেক্ষায় থাকতেন।
এসব কথা জানিয়ে বলেন, প্রাইভেট পড়ায়ে কোনো টাকা-পয়সা নিতেন না শিক্ষকরা।আমার শ্রম আর সকলের সহযোগিতায় ডাক্তার হয়ে অতীতের কথা ভুলে যাবনা। তার ইচ্ছা ডাক্তারি বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করা এবং আত্নীয়স্বজন ও দরিদ্র মানুষকে বিনা টাকায় চিকিৎসা সেবা প্রদানসহ তাদের পাশে দাড়িয়ে সহযোগিতা করা। পরিশ্রম করলে যে সফলতা আসবে তা আমার নিজেকে দিয়ে বুঝতে পেরেছি।
রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাউসা ইউনিয়নের ধন্দহ গ্রামের আতাউর রহমান ও গৃহিনী হাফিজা বেগমের ১ছেলে ও ১ মেয়ের মধ্যে উরপীতা খাতুন উর্মি বড়। ছোট ভাই সিফাত রহমান লালপুর উপজেলার বোয়ালিয়াপাড়া এম .এম উচ্চ বিদ্যালয়ে ৯বম শ্রেণীতে লেখাপড়া করে।
সোমবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) হাফিজা বেগম বলেন, পড়ালেখার ইচ্ছা ছাড়া তার কোন বিশেষ চাহিদা ছিলনা। তার সামান্য চাহিদাও পূরণ করতে পারিনি। তার সাফল্যে নিজেদের সফল মনে হচ্ছে।
দাদি রেহেনা বেগম বলেন, তার প্রবল ইচ্ছা ছিল ডাক্তারী পড়ার। আল্লাহ তার আশা পূরণ করেছেন। তার বিশেষ প্রয়োজনে মা-বাবার দিকে চেয়ে থাকিনি। তাকে যে ফোনটা দিয়েছি,সেটা আমার ছোট মেয়ে আমাকে দিয়েছিল। খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য সেটা তাকে দিয়ে দিয়েছি।
বাবা আতাউর রহমান বলেন,ফলাফল প্রকাশের পর থেকেই আত্মীয় স্বজনসহ অনেকেই খোঁজ খবর নিচ্ছেন, এ যেন এক পরম পাওয়া। মেয়ে একজন মানবিক ডাক্তার হয়ে সেবা করতে পারলে পিতা হিসেবে সার্থক মনে করবো।
তিনি জানান, দুই ভাইয়ের যৌথ পরিবার। মা-বাবাসহ মোট লোকসংখ্যা ১০জন। পৈত্রিক সূত্রে দেড় বিঘা করে মোট ৩বিঘা জমির মালিক তিনি ও অপর ভাই মতিউর রহমান। সেই জমির আয়ে সংসার চলেনা। অন্যর জমি বর্গা নিয়ে দুই ভাই মিলে চাষাবাদ করেন। নিজের নামেও ঋণ রয়েছে।
চাচা মতিউর রহমান বলেন, সে আমাদের গর্ব। প্রাথমিকে ভর্তির পর থেকেই ভালো ফলাফলে উৎসাহিত করেছি। সর্বোপরি আমাদের সহযোগিতা আর তার প্রচেষ্টাকে কাজে লাগিয়ে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নপূরণ করতে পেরেছে,এতে অন্যরকম এক শান্তি অনুভব হচ্ছে। তার ১ ছেলে ১ মেয়ে।
তারা বলেন, লালিত স্বপ্ন পূরণের মাধ্যমে সে ডাক্তার হয়ে মানুষের কল্যাণে কাজ করবে এটাই আমাদের বড় চাওয়া ও প্রত্যাশা । দিঘা উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ জহুরুল ইসলাম বলেন, উর্মি খুবই মেধাবী ছাত্রী। তার কৃতিত্বে আমরা গর্বিত।