এনজিও থেকে ঋণ নিতে আ.লীগ নেতাকে লাখ টাকায় দিতে হয় ১৫ হাজার
নিজস্ব প্রতিবেদক, নাটোর : নাটোরের সিংড়ায় ‘কালব’(দি কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লীগ অব বাংলাদেশ লিঃ) নামে একটি এনজিও থেকে ঋণ নিতে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতাকে গ্রহিতাদের লাখ টাকার বিপরীতে দিতে হয় ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। নইলে মেলেনা প্রয়োজনীয় ঋনের টাকা।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আবু বক্করের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করেছেন ওই এনজিওর ঋণ গ্রহিতারা।
আওয়ামীলীগ নেতা আবু বক্কর এনজিও সংস্থা কালব’ এর সভাপতি হওয়ায় উৎকোচ হিসেবে লাখ টাকায় উল্লেখিত পরিমাণ টাকা দিতে হয় তাকে। ঋণ পেতে গ্রহিতাকে স্বাক্ষর করা ফাঁকা চেকের পাতা জমা দিতে হয়। উৎকোচের টাকা না দিলে ঋনের টাকার পরিমাণ দ্বিগুন হয়ে যাওয়ার হুমকি দেয়া হয়।
এমনকি ধারের কথা বলে মোটা অংকের টাকা নিয়ে তা ফেরত দেননা ওই আওয়ামী লীগ নেতা। তার স্বাক্ষর ছাড়া গ্রহিতাদের ঋণ দেয়া হয়না। ফলে গ্রহিতাদের অনেকেই বাধ্য হয়েই আওয়ামী লীগ নেতা আবু বক্করের দাবি পূরণ করে ঋণ নিয়ে থাকেন।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, উপজেলার চৌগ্রামে ২০২২ সালের ২১ মে কালব (দি কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লীগ অব বাংলাদেশ লিঃ)- এর চৌগ্রাম শাখা স্থাপন করা হয়। সে থেকেই আবু বক্কর সিদ্দিক ‘কালব’ এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
ইতোমধ্যে আবু বক্কর সিদ্দিকের সুপারিশে প্রায় ৬০ জনের মাঝে ৮০ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। ঋণ নেয়ার পর ঋণ গ্রহিতাদের প্রায় সকলেই আবু বক্কর সিদ্দিকের খপ্পরে পড়েছেন। স্বাক্ষরিত ফাঁকা চেক তার কাছে জমা দেয়ার কারণে তারা কেউ প্রতিবাদ করতে সাহস করেননা। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে দলীয়ভাবে হুমকি দেয়া হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।
ভুক্তভোগী অন্তত ১২ থেকে ১৩ জনের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। বেলাল শেখ নামে ভুক্তভোগী চৌগ্রামের এক ঋণ গ্রহিতা অভিযোগ করে বলেন, ক্যানসারে আক্রান্ত তার পিতা হামিদ শেখের চিকিৎসা করাতে টাকার প্রয়োজন হলে ‘কালব’ এর চৌগ্রাম কৃষিজীবি কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লিঃ শাখা থেকে ঋণ নেন তিনি।
ঋণ নেয়ার সময় স্বাক্ষর করাতে গিয়ে সমিতির সভাপতি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আবু বক্কর সিদ্দীককে উৎকোচ হিসেবে লাখ টাকায় ১৫ হাজার টাকা করে দিতে হয়েছে। ব্যাংক চেক জমা রেখে বাবার জীবনমৃত্যু সন্ধিক্ষনে বাধ্য হয়ে তাদের শর্তে রাজি হয়ে ৫০ হাজার টাকা ঘুষের বিনিময়ে ৫ লাখ টাকার ঋণ নেন তিনি।
টাকা উত্তোলনের সময় আওয়ামী লীগ নেতা আবু বক্কর প্রায় জোর করেই তার কাছে থেকে ২ লাখ টাকা ধার নেন। ধারের সমুদয় টাকা পরিশোধের জন্য তিনি এক সপ্তাহের জন্য সময় চেয়ে নেন। পরে সেই ধারের টাকা চাইতে গেলে বক্কর তার কাছে রাখা চেক দিয়ে মামলা করার হুমকি দেন। টাকা চাওয়ায় দলীয় প্রভাব খাটিয়েও তাকে হুমকি দেন আবু বক্কর।
বক্করের মানসিক নির্যাতন সহ্য করে চিকিৎসা শুরু করেও তিনি তার পিতাকে বাঁচাতে পারেননি। উল্টো টাকার জন্য বক্করের হুমকির মুখে তিনি প্রায় বছর ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এই এনজিও থেকে ঋন নিয়ে প্রায় অর্ধশত গ্রহিতাকে উৎকোচের টাকা গুনতে হচ্ছে।
বড়িয়া গ্রামের রাকিব, ছোট চৌগ্রামের হাবিবুর রহমান, স্থাপনদিঘী গ্রামের মানিক হোসেন, মামুন হোসেন, চৌগ্রামের রাব্বানী, একই এলাকার সুমন আলী, বিদুৎত হোসেন, হাফিজুর রহমান, লিটন মোল্লা, রুবেল হোসেন, রিপন শেখ, হাবিব শেখ, রফিক সহ অর্ধশত গ্রাহক অভিযোগ করেন,তাদের কাছে থেকে অতিরিক্ত অর্থ নেয়া হয়েছে।
স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী হওয়ায় আওয়ামী লীগ নেতা আবু বক্কর সিদ্দীর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিতেও ভয় পাচ্ছেন ভুক্তভোগীরা।
স্থাপনদীঘি গ্রামের ভুক্তভোগী ঋণ গ্রহিতা কৃষক মানিক হোসেন বলেন, ঋণ নিতে কালব অফিসে যোগাযোগ করলে অফিস থেকে বক্করের সুপারিশ লাগবে বলে জানানো হয়। বক্করের সুপারিশ নিতে গেলে ১ লাখ ৫০ হাজর টাকা ঋণ নিতে ১৫ হাজার টাকা ঘুষ এবং চেক জমা দিয়ে ঋণ পাশ করে নিতে হয়েছে।
ঋণের টাকা তুলতে গেলে আবু বক্কর ৫০ হাজার টাকা জোর করে ধার নেয়। পরে সেই টাকা আর পরিশোধ করেননা। সেই ধারের টাকা চাইতে গেলে তার কাছে জমা রাখা চেক দিয়ে মামলা করার হুমকি দেয়। নিরুপায় হয়ে অফিসে গেলে অফিসার কোন ব্যবস্থা নিতে পারবে না বলে জানালে দিশেহারা হয়ে পরেছেন তিনি।
ছোট চৌগ্রামের কৃষক হাবিবুর রহমান বলেন, ঋণ নিতে চৌগ্রাম কালব অফিসে গেলে অফিসার সভাপতি আবু বক্করের সাথে যোগাযোগ করে সুপারিশ নিতে বললে সভাপতির সুপারিশ নিতে গেলে ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা লোন পেতে ১৫ হাজার টাকা এবং সিংড়া রুপালী ব্যাংক এর চেক বই রেখে ঋণ পাশ করাই।
ঋণ পাওয়ার সময় বক্কর নিজে উপস্থিত থেকে আরো ১১ হাজার টাকা ধার নেয়। এখন সেই ধারের টাকা চাইতে গেলে তার কাছে রাখা চেক দিয়ে মামলা করার হুমকি দেয়। টাকা চাইতে বাসায় গেলে দলের ভয় দেখায়। মৌখিকভাবে অফিসারকেও বিষয়টি জানালে কোন ব্যবস্থা নেয়নি।
চৌগ্রাম গ্রামের রাব্বানী বলেন, কালব অফিস থেকে বক্করের সই ছাড়া লোন পাশ হয় না। ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঋন করতে ২৬ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। ৫ হাজার টাকা বাকী ছিল সেই টাকার জন্য বাজারে অসলেই মারধর করার হুমকি দেয়া হয়। পরে সেই টাকা দিলে বাজারে আসার সুযোগ পেযেছি। চৌগ্রাম কালব অফিসের অফিসার সোহান হোসেনকে জানালেও তিনি কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি।
চৌগ্রাম ‘কালব’ অফিস এর পোগ্রাম এসিস্টেন্ট সোহান হোসেন অভিযোগ পাওয়ার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, এই অফিস সিংড়া কালব অফিস এর রিডারসিপ অর্ন্তভুক্ত অফিস। চৌগ্রাম কৃষিজীবি কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লিঃ আর বক্কর স্যার লিডার পদে আছে তার তো লোন দেওয়ার দায়িত্ব আছে।
‘কালব’ এর ৬ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির সভাপতির আন্ডারে আমরা চলি। সভাপতি যাকে লোন দিতে বলে আমরা তাকে লোন দেই এখানে আমার কিছুই করার নেই। মৌখিকভাবে শুনেছি সভাপতির স্বাক্ষর নিতে টাকা দিতে হয়, তবে লিখিত অভিযোগ পেলে উর্দ্ধোতন কতৃপক্ষকে জানানো হবে।
এ বিষয়ে জানতে ‘কালবের’ সভাপতি ও অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতা আবু বক্কর সিদ্দিকির সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমাকে খুশি হয়ে অনেকেই বকশিস দিয়েছে। অনেকেই স্বাক্ষর নিতে বাসায় আসে তখন চেক বহি বাসায় থাকে। সময় মত সেগুলো ফেরত দেয়া হবে।
তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। তার সুনাম ক্ষুন্ন করতে একটি পক্ষ এমন মিথ্য অভিযোগ তুলে তা প্রচার করছে। কারা অভিযোগ করেছে তাদের নাম জানতে চান এই প্রতিবেদকের কাছে। জমা রাখা চেক দিয়ে মামলা দেওয়ার অভিযোগও অস্বীকার করেন তিনি।
স্থানীয় চৌগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘কালব’ এনজিও সভাপতি আবু বক্কর সিদ্দিকের বিরুদ্ধে অর্ধশতাধিক মানুষের অভিযোগ রয়েছে। ভু্ক্তভোগীদের ঋণ করে দেওয়ার জন্য স্বাক্ষর প্রতি অতিরিক্ত টাকা এবং চেক জমা নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এই এনজিও থেকে ঋন নিয়ে অনেক মানুষ নিঃস্ব হয়ে এলাকা ছাড়া। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
‘কালব’ সিংড়া প্রধান শাখার ব্যবস্থাপক ফরহাদ হোসেন বলেন, মৌখিকভাবে অভিযোগ পেয়েছি। তবে লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কমিটি ভেঙ্গে দেওয়া হবে। আর কেউ যদি টাকা দেয় আমার কি করার আছে। আমি সকল ঋণ গ্রহিতাকে বলে দিয়েছি ঋণের জন্য কাউকে কোন টাকা দিতে হয় না।