ভারতে ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ মন্ত্রিসভায় অনুমোদন
পদ্মাটাইমস ডেস্ক : প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের জোরালো আপত্তির মুখে ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রস্তাব পাস করেছে ভারতের মন্ত্রিসভা।
এই প্রস্তাব অনুযায়ী, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশটির লোকসভা অর্থাৎ সাধারণ নির্বাচন এবং সব বিধানসভার নির্বাচন একযোগে আয়োজনা করা হবে, যার বিল পার্লামেন্টের শীতকালীন অধিবেশনে তোলা হতে পারে।
ইন্ডিয়া টুডে লিখেছে, ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি একযোগে নির্বাচন আয়োজনের ওপর প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর বুধবার সেটির প্রস্তাব কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় তোলা হলে সেটি অনুমোদন পায়।
হিন্দুস্তান টাইমস লিখেছে, মন্ত্রিসভার এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে ভারতের কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব বলেন, ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ ব্যবস্থা দুটি ধাপে বাস্তবায়িত হবে। এই প্রস্তাব বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের সমর্থন পেয়েছে।
তিনি বলেন, “বিরোধীরা অভ্যন্তরীণ চাপ অনুভব শুরু করতে পারে (এক দেশ, এক নির্বাচন সম্পর্কে)। কারণ পরামর্শ কমিটি কাজ শুরু করার পর জরিপে অংশ নেওয়া ৮০ শতাংশেরও বেশি মানুষ এই প্রস্তাবের পক্ষে ইতিবাচক সমর্থন দিয়েছেন, বিশেষ করে তরুণরা।
কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি ও শিবসেনাসহ (উদ্ধব) বেশ কয়েকটি বিরোধী দল একসঙ্গে সব নির্বাচন আয়োজনের বিরোধিতা করে অভিযোগ করেছে যে, এটি কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলকে উপকৃত করবে। তবে জেডি (ইউ) এবং চিরাগ পাসোয়ানের পার্টির মত এনডিএর মিত্ররা এই ধারণাটিকে সমর্থন করেছে।
“সমস্ত নির্বাচনের জন্য একটি সাধারণ ভোটার তালিকা তৈরি করা হবে। কোবিন্দ প্যানেলের সুপারিশমালা এগিয়ে নেওয়ার জন্য একটি বাস্তবায়ন টিম গঠন করা হবে,” বলেন বৈষ্ণব।
নরেন্দ্র মোদীর দ্বিতীয় মেয়াদের সরকারের সময় একসঙ্গে সব নির্বাচন আয়োজনের সম্ভাব্যতা পরীক্ষার জন্য প্যানেল গঠন করা হয়েছিল, যা বিজেপির লোকসভা নির্বাচনের ইশতেহারে দেওয়া মূল প্রতিশ্রুতিগুলোর মধ্যে একটি। প্যানেলটি চলতি বছরের মার্চে রাষ্ট্রপতির কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়।
প্রতিবেদনটি অমিত শাহকে সঙ্গে নিয়ে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কাছেও পেশ করেন সাবেক রাষ্ট্রপতি কোবিন্দ।
এটিকে একটি যুগান্তকারী নির্বাচনী সংস্কার প্রস্তাব বলে অভিহিত করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, “এটি স্বচ্ছ ও আর্থিকভাবে দক্ষতা কেন্দ্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে আমাদের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে এবং সম্পদের আরও উত্পাদনশীল বরাদ্দের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করতে প্রধানমন্ত্রী মোদীর প্রবল ইচ্ছাকে প্রতিফলিত করে।”
‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ যেভাবে বাস্তবায়ন হবে
রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বের কমিটি ১৮ হাজার ৬২৬ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, যেখানে প্রথম ধাপে লোকসভা ও সব রাজ্যের বিধানসভায় একযোগে নির্বাচন আয়োজনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
২০২৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর প্যানেল কমিটি গঠনের পর অংশীজনদের সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনা-পর্যালোচনা এবং ১৯১ দিনের গবেষণা শেষে প্রতিবেদনটি জমা দেওয়া হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, এই ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে সংবিধান সংশোধনের জন্য রাজ্যগুলোর অনুমোদনের প্রয়োজন নেই।
দ্বিতীয় ধাপে পৌরসভা এবং পঞ্চায়েত নির্বাচনকে লোকসভা এবং বিধানসভার নির্বাচনের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। এটি এমনভাবে করা হবে, যাতে সাধারণ নির্বাচনের ১০০ দিনের মধ্যে স্থানীয় নির্বাচন হয়ে যায়।
এই ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য অর্ধেকের কম রাজ্যের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে বলে মন্ত্রিসভায় পাস হওয়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে।
‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ ব্যবস্থাটি প্রবর্তনের জন্য ১৮টি সাংবিধানিক পরিবর্তনের সুপারিশ করেছে কমিটি।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে বিজেপি ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ এর জন্য তাদের আওয়াজ জোরালো করেছে; যা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার স্বাধীনতা দিবসের ভাষণেও তুলে ধরেছিলেন।
একযোগে ভোট হওয়া ‘সময়ের প্রয়োজন” বলে বর্ণনা করে প্রধানমন্ত্রী মোদী দাবি করেছিলেন যে, ঘন ঘন ভোট দেশের অগ্রগতিতে বাধা তৈরি করছে।
এই সপ্তাহের শুরুতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এই বিষয়ে দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বলেছিলেন, এনডিএর (বিজেপির নেতৃত্বাধীন জোট) বর্তমান মেয়াদের মধ্যেই ‘ওয়ান নেশন, ওয়ান ইলেকশন’ ব্যবস্থা কার্যকর করা হবে।
ভারতের আগামী লোকসভা নির্বাচন হওয়ার কথা ২০২৯ সালে।
‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ নিয়ে ভারতে প্রথম আলোচনা শুরু হয়েছিল ১৯৮০-এর দশকে। ১৯৯৯ সালেও এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন নিয়ে একবার তোড়জোড় হয়েছিল।
‘বিজেপির আরেক জুমলা’
কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেছেন, “আমরা এর সঙ্গে নেই। ‘এক জাতি, এক নির্বাচন’ গণতন্ত্রে কাজ করতে পারে না। আমরা যদি আমাদের গণতন্ত্রে টিকে থাকতে চাই, তবে প্রয়োজন মত নির্বাচন হওয়া দরকার।”
এর আগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও একযোগে নির্বাচনের ধারণার বিরোধিতা করেছিলেন।
আম আদমি পার্টি এই ব্যবস্থা প্রবর্তনের চেষ্টাকে বিজেপির আরেকটি ‘জুমলা’ হিসেবে বর্ণনা করে একে প্রত্যাখ্যান করে বলেছিল, এ বিষয়ে বিরোধীদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি।
হিন্দি ভাষাভাষীরা ‘মিথ্যা প্রতিশ্রুতি’ অর্থে জুমলা শব্দের ব্যবহার করে থাকে।
অরবিন্দ কেজরিওয়ালের পার্টির ভাষ্য – তারা মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড, জম্মু ও কাশ্মীর, হরিয়ানার নির্বাচন একসঙ্গে পরিচালনা করতে পারেনি। তাদের মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খণ্ডের সঙ্গে দিল্লির নির্বাচন করতে বলা হয়েছিল। তাদের উচিত, আগে নিজেদের প্রমাণ করা।
তৃণমূলের রাজ্যসভার নেতা ডেরেক ও ব্রায়েনও বিজেপির এই পদক্ষেপকে ‘জুমলা’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেছেন, “গণতন্ত্রবিরোধী বিজেপির আরেকটি সস্তা স্টান্ট হল ‘এক দেশ, এক ভোট’। কেন হরিয়ানা এবং জম্মু ও কাশ্মীরের নির্বাচনের সঙ্গে মহারাষ্ট্রের নির্বাচন ঘোষণা করা হয়নি? মহারাষ্ট্র সরকার এই জুনের বাজেটে ‘লাড়কি বহিন’ প্রকল্প ঘোষণা করেছে। প্রথম ধাপ অগাস্টে মহিলাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পৌঁছেছে এবং দ্বিতীয় ধাপ অক্টোবরে সুবিধাভোগীদের কাছে পৌঁছবে। আপনারা এক সঙ্গে তিনটি রাজ্যের ভোট করাতে পারেন না আর ‘এক দেশ, এক ভোটে’র কথা বলছেন।”
বিরোধীরা কড়া ভাষায় প্রতিবাদ করলেও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব দাবি করেছেন, কোবিন্দ কমিটির কাছে ৪৭টি স্বীকৃত রাজনৈতিক দল মতামত জানিয়েছিল, যার মধ্যে ৩২টি দল ‘এক দেশ, এক ভোট’ সমর্থন করেছে; বিরোধিতা করেছে ১৫টি রাজনৈতিক দল।
কংগ্রেস, তৃণমূল, সমাজবাদী পার্টি, আরজেডি, শিবসেনা (উদ্ধব), সিপিএমসহ বিরোধী দলগুলো শুরু থেকেই ‘এক দেশ, এক ভোট’ পদ্ধতির সমালোচনায় মুখর।
তাদের ভাষ্য- এই নীতি নিয়ে মোদী সরকার ঘুরপথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ধাঁচের ব্যবস্থা চালু করতে চাইছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং সংসদীয় গণতান্ত্রিক ভাবনার পরিপন্থি।
আম আদমি পার্টির সন্দীপ পাঠক বলেন, “যদি কোনো বিধানসভার মেয়াদের মাঝামাঝি কোনো রাজ্যে সরকার পতন হয়, তাহলে বিজেপি কি তার ‘গুন্ডাগার্ডি’ দিয়ে রাজ্য চালাবে?”
দ্য হিন্দু লিখেছে, পার্লামেন্টে যেহেতু বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই; ফলে সেখানে বিল উঠলে ধাক্কা খেতে পারে তারা।
ভারতের সংবিধানে কোনো সংশোধন আনতে পার্লামেন্টের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন প্রয়োজন হয়; যা এই মুহূর্তে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের শরিকদের মিলিয়েও নিশ্চিত করতে পারবে না মোদীর দল। ফলে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ‘ইন্ডিয়া’ জোটের শরিকদেরও সমর্থন দরকার হবে বিজেপির।