ভোগ্যপণ্যের দাম ইউরোপ অ্যামেরিকার চেয়েও বাংলাদেশে বেশি
পদ্মাটাইমস ডেস্ক : বাংলাদেশে কোনো কোনো ভোগ্যপণ্যের দাম এখন ইউরোপ-অ্যামেরিকার চেয়েও বেশি৷ কোনো পণ্যের দাম গত পাঁচ বছরের ৩০০ শতাংশের চেয়েও বেশি বেড়েছে৷ ফলে বাংলাদেশে ভোগ্যপণ্যও এখন বিলাসী পণ্যে পরিণত হয়েছে৷
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) “বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০২৩-২৪ : তৃতীয় অন্তর্বর্তীকালীন পর্যালোচনা” শীর্ষক ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের গত পাঁচ বছরের নিত্যপণ্যের বাজার পরিস্থিতি তুলে ধরেছে৷ সিপিডি মনে করে, ২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক পর্যায়ে রয়েছে৷ অনেক দিন ধরে এটা ৯-১০ শতাংশে রয়েছে৷ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখাতে না পারা সরকারের বড় ব্যর্থতা৷ বাজার মনিটরিং ব্যবস্থায় বড় দুর্বলতা আছে৷
গবেষণা পত্রটি উস্থাপন করে সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কাকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও ইতোমধ্যে দেশটি তা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে এবং বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে এখন শ্রীলঙ্কার চেয়ে পিছিয়ে৷
সিপিডি মনে করে, ২০২০-২১ অর্থবছরে করোনাভাইরাস মহামারিতে অর্থনীতিতে যে সংকট তৈরি হয়েছিল, পরের বছর কিছুটা কমে এলেও সঙ্গে যোগ হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি৷ এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নীতির দুর্বলতা, সুশাসনের অভাব ও প্রয়োজনীয় সংস্কারের ব্যর্থতা৷ এগুলো ধারাবাহিকভাবে চলেছে৷
বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখাই এখন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ৷ এর জন্য অর্থনীতির নীতি কাঠামো যেমন আছে তেমনি বাজার ব্যবস্থাপনা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ এইসব বিষয়ে সরকারের দীর্ঘ মেয়াদে কোনো পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয়না৷
চিনির দাম ইউরোপ-অ্যামেরিকার চেয়ে বেশি
সিপিডি বলছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নে এক কেজি চিনির দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৯ টাকা৷ আর যুক্তরাষ্ট্রে ৯৬ টাকা৷ অথচ বাংলাদেশে এক কেজি চিনির দাম ১৩০ টাকা৷ গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে চিনির দাম ১৫২ শতাংশ বেড়েছে৷ আর রসুনের দাম বেড়েছে ৩১০ শতাংশ৷ পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১৬৪ শতাংশ৷ আদা ২০৫ শতাংশ৷
মসুর ডাল ৯৫, আটা ৪০-৫৪, ময়দা ৬০, গুঁড়া দুধ ৪৬-৮০, পেঁয়াজ ১৬৪ ভাগ বেড়েছে৷ শুকনা মরিচের দাম দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে৷ খোলা সয়াবিন ৮৪, বোতলজাত সয়াবিন ৫৬ ও পামঅয়েলের দাম ১০৬ শতাংশ বেড়েছে, যা আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় অনেক বেশি৷
মিনিকেট চালের দাম বেড়েছে ১৭ শতাংশ, পাইজামের ১৫ ও মোটা চালের ৩০ শতাংশ৷ থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের চেয়ে দেশে এখন চালের দাম বেশি৷
খাবারের পিছনে ব্যয় বেশি
সিপিডির প্রতিবেদনে ১৭টি দেশের মানুষের মাথাপিছু জিডিপি এবং খাবারের পেছনে মাথাপিছু খরচের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়৷ এতে দেখা যায়, ওই সব দেশের মধ্যে বাংলাদেশে মানুষের মাথাপিছু জিডিপি সবচেয়ে কম, সাত হাজার ৮০৫ ডলার৷ অথচ খাবারের পেছনে ওই ১৭ দেশের মধ্যে বাংলাদেশে মাথাপিছু খরচ সবচেয়ে বেশি, ৯২৪ ডলার৷ তালিকার অন্য ১৬টি দেশ হলো ইরান, ভারত, লাওস, শ্রীলঙ্কা, উজবেকিস্তান, আলজেরিয়া, ভিয়েতনাম, টিউনিশিয়া, বলিভিয়া, মরক্কো, ইরাক, ইন্দোনেশিয়া, কলম্বিয়া, ব্রাজিল, জর্ডান ও দক্ষিণ আফ্রিকা৷ আয় কম কিন্তু খাবারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করতে হয় বাংলাদেশের মানুষকে ৷
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েন অব বাংলাদেশের(ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন , “বাজার নিয়ে আমরা কথা বলছি কিন্তু সেটা অনুযায়ী কোনো বাজার ব্যবস্থাপনা দেখছিনা৷ আর এটা শুধু বাজার ব্যবস্থাপনা নয়, পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করে৷ সবখানেই দুর্বলতা দেখতে পাচ্ছি৷ আর আমরা সাধারণ মানুষ এর চাপ বহন করছি৷”
তার কথা, “করোনা ও ইউক্রেন যুদ্ধের পর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের অনেক দেশ অনেক ব্যবস্থা নিয়েছে৷ তার সুফল তারা পাচ্ছে৷ আমরা তখন ব্যবস্থা নেইনি৷ আমরা উল্টোটা করেছি৷ আমরা যখন ব্যবস্থা নিই তখন আর সময় থাকেনা৷”
সমস্যা কোথায়
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, “বাংলাদেশে আমরা দীর্ঘদিন ধরেই দেখছি বাজারকে মেন্যুপুলেট করা হচ্ছে৷ এটা কোনেভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছেনা৷ ফলে এখানে অব্যাহতভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে৷
তার কথা, “নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার তুলনায় মানুষের আয় বাড়ছে না৷ আর খাদ্যপণ্যের দাম বেশি বাড়ায় এর প্রভাব পড়ছে কম আয়ের মানুষের ওপর৷ খাদ্য কিনতে গিয়েই তার আয় শেষ হয়ে যাচ্ছে৷ ফলে তারা কম খায় অথবা ঋণ করে৷ সে ঋণগ্রস্ত হয়৷ অন্যদিকে প্রয়োজনীয় খাদ্য না কিনতে পারায় অপুষ্টিতে ভোগে৷ এর প্রভাব স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা সবখানেই পড়ে৷
তিনি বলেন,” বাজার থেকে একটি মহল অব্যবস্থাপনার সুযোগ নিয়ে কোটি কোটি টাকা আয় করছে৷ তাদের কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা হচ্ছেনা৷
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “আমাদের এখানে কতিপয় বড় আমদানিকারক ও ব্যবসায়ী বাজারে সরবরাহ চেইন নিয়ন্ত্রণ করে৷ ফলে পণ্যমূল্য তারাই নিয়ন্ত্রণ করে৷ দ্রব্য মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে এটা ভাঙতে হবে৷ আর তার জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা৷
তার কথা, “সরকার হয়তো আমদানি শুল্ক কমালো কিন্তু ওই পণ্যের আমদানিকারক একজন৷ ফলে দাম কমেনা৷ ওই আমদানি কারক লাভবান হয়৷ আবার কৃষিপণ্যে আমরা অনেক ইনফরমাল লেনদেন দেখি৷ আলুর মৌসুমে কিছু বিত্তশালী কোল্ড স্টোরেজে আলু কিনে রাখেন৷ আলুর দাম বেড়ে গেলে তারা শুধু স্লিপ বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা আয় করেন৷ এগুলো বন্ধ করতে হবে৷
তিনি বলেন, “এই বাজারের সঙ্গে আমাদের অর্থনীতিতে সুনীতি এবং সুশাসনও দরকার৷ সরকার আইএমএফ-এর পরামর্শে হলেও এখন কিছু অর্থনৈতিক সংস্কার করছে৷ কিন্তু এর সুফল পেতে হলে পুরো নির্দেশনা মানতে হবে৷ তা না হলে এর সুফল পাওয়া যাবেনা৷ আমরা আগে দেখেছি কোনো সংস্কারই পূর্ণ হয়না৷ রাজনৈতিক কারণে সরকার প্রেসার গ্রুপের কাছে নতি স্বীকার করে৷ “অর্থনৈতিক সংস্কার করার জন্য যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং দৃঢ়তা দরকার তা আমি এখন পর্যন্ত সরকারের মধ্যে দেখছিনা.” বলেন এই অর্থনীতিবিদ৷.
সরকারও জানে সিন্ডিকেট, কিন্তু ধরবে কে?
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, “আমরা জানি বাজারে সিন্ডিকেট কাজ করে৷ তারা দাম বাড়িয়ে দেয়৷ আমরা এগুলোর কিছু চিহ্নিত করে ব্যবস্থাও নিয়েছি৷ কিন্তু সব তো আমরা পারিনা৷ আমাদের পর্যাপ্ত জনবলও নাই৷ আবার আইনও আমাদের সব দায়িত্ব দেয়নি৷ এরজন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় আছে, প্রতিযোগিতা কমিশন আছে৷ কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ২৯টি পণ্যের দাম ঠিক করে দিয়েছে৷ সেটা বাস্তবায়নের দায়িত্বও তাদের৷ আমাদের সরকার যা ঠিক করে দেয় তাই করতে পারি৷
তার কথা, “কোনো পণ্যের দাম বাড়ার যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে৷ কিন্তু ওই পণ্যের পরতে পরতে মুনাফা লোভীরা ঢুকে দিয়ে দাম আরো বাড়িয়ে দেয়৷ তারা অতি মুনাফা করে৷ ভোক্তা অধিদপ্তর তো কোনো পণ্যের দাম ঠিক করে দেয়না৷ কেউ যদি যৌক্তিক দামের বেশি নেয় তখন আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি৷ তবে যৌক্তিক দাম কোনটা তাও তো নির্ধারণ আমরা করি না৷