মাসুদ আলী খান : বৈচিত্র্যময় চরিত্রে বিচরণ যার
পদ্মাাটইমস ডেস্ক : তারা খসে পড়ে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু দূর আকাশের সদা জ্বলজ্বলে উজ্জ্বল তারার ঝরে পড়া, সবসময় মেনে নেওয়া যায় না। আকাশের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন শূন্যতা অনুভব হয়। মাসুদ আলী খান তেমনি একজন উজ্জ্বল তারা, তারকা।
৩১ অক্টোবর ২০২৪ প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে প্রয়াত হলেন তিনি। আমরা মেনে নিতে বাধ্য। ৯৫ বছর বয়স হয়েছিল তার। আমরা সবাই জানি, তিনি অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু স্মৃতিবিভ্রম বা ভুলে যাওয়া রোগে আক্রান্ত ছিলেন না। এটা খুব ভালোলাগার বিষয় ছিল, যার সাথেই দেখা হতো তিনি অদ্ভুত সুন্দর, সরল হাসিমুখে সেই মানুষটার ভালো-মন্দের খবর নিতেন।
এই যে হাসিমুখের কথা লিখলাম। একজন মানুষের ঠোঁটের হাসি, তার অন্তর্নিহিত অনুভূতির সুস্পষ্ট প্রকাশ। তাকে আমি ‘আঙ্কেল’ বলে ডাকতাম। আঙ্কেল চেনা মানুষ পেলে গল্প করতে ভালোবাসতেন। সুমিষ্ট কথা, সুচিন্তার ধারক এবং মৃদুভাষী মানুষ ছিলেন তিনি। উনার সাথে কথা বলতে গেলে কখনো কখনো মনে হতো ‘আমি কী উচ্চস্বরে কথা বলছি’! না, কখনো তিনি অভিযোগ করেননি। বরং ‘পেকআপ’ শোনা অব্দি সবার সাথে মিলেমিশে কাজ করে গেছেন।
সহশিল্পীদের সাথে তিনি কেমন ছিলেন? এটা বোঝার জন্য তার কাজই বিবেচ্য। ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘পৌষ ফাগুনের পালা’-এর মতো ক্লাসিক নাটকে যেমন অভিনয় করেছেন তেমনি ‘একান্নবর্তী’, ‘69’-এর মতো নতুনধারার নাটকে নতুন অনেক সহশিল্পীর সাথেও কাজ করেছেন। যা ‘অতুলনীয়’।
‘অতুলনীয়’ এই বিশেষণটি লেখার কারণ যেকোনো জেলার, যেকোনো বয়সের মানুষ তার সাথে দ্বিধাহীনভাবে আলাপচারিতা শুরু করে কথোপকথন চালিয়ে যেতে পারত। আরও স্পষ্ট করে বললে, অনেক অগ্রজ আছেন যারা অপর ব্যক্তি একটি বাক্য বললেই উচ্চারণে ভুল ধরতে থাকেন।
ফলে বেশিক্ষণ সেইসব অগ্রজের সাথে কথা এগিয়ে নিতে কুণ্ঠাবোধ হয়। এটা খুব যন্ত্রণাদায়ক তা নয়। তবে, জেলাভিত্তিক কারণে সময় লাগে কথার শুদ্ধ উচ্চারণ আয়ত্ত করতে। মাসুদ আলী খান এসবের ঊর্ধ্বে ছিলেন। তাই তো তার সাথে কথোপকথনে কখনো সময়সীমা ছিল না।
বয়সে এবং কর্মে অগ্রজ হিসেবে সম্মান আদায় করার জন্য আলাদা ‘ভাব’ যেসব অগ্রজদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়নি তাদের মধ্যে মাসুদ আলী খান অন্যতম। তাই তো ভিজ্যুয়াল মিডিয়ায় তার কর্মজীবন কয়েক যুগ। তারা শুরু করেছিলেন, তারপর একের পর এক জেনারেশন এসেছে এবং পেশা হিসেবে অভিনয়কে বেছে নেওয়ার উৎসাহ কিন্তু তাদের কাছ থেকেই পাওয়া।
বয়সে এবং কর্মে অগ্রজ হিসেবে সম্মান আদায় করার জন্য আলাদা ‘ভাব’ যেসব অগ্রজদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়নি তাদের মধ্যে মাসুদ আলী খান অন্যতম। তাই তো ভিজ্যুয়াল মিডিয়ায় তার কর্মজীবন কয়েক যুগ।
মেক-আপ রুমে নায়ক-নায়িকা রেওয়াজ দেখিনি। বরং অগ্রজরা যেমন স্নেহের সাথে ‘স্বাগত’ জানিয়েছেন তেমন তারা ইউনিটে পা রাখলেই জায়গা ছেড়ে দেওয়া ছিল অঘোষিত নিয়ম। তাই তো মাসুদ আলী খান আঙ্কেলের প্রয়াণ কাঁদিয়েছে সহশিল্পীদের।
ফেব্রুয়ারি ২০২৪-এ ‘দেশ নাটক’-এর ইশরাত নিশাত নাট্যপুরস্কার-এ প্রধান অতিথি হিসেবে হুইল চেয়ারে এসেছিলেন তিনি। সবার সাথে কুশল বিনিময় করলেন এবং মতবিনিময় করলেন। আঙ্কেলকে একটা রুমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল যেন বিশ্রাম করতে পারেন। সাথে সাথে আপত্তি জানালেন এবং পুরোটা অনুষ্ঠান মঞ্চের উইংয়ে বসে উপভোগ করলেন। (হুইল চেয়ারসহ দর্শক আসনে নিয়ে যাওয়া এবং পুনরায় মঞ্চে নিয়ে আসা ছিল খুব কঠিন) কী প্রাণশক্তি!
দ্বিতীয় শ্রেণির শিশু মাসুদ আলী খান মঞ্চে পদার্পণ করে অভিনেতা হিসেবে। ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত থিয়েটার ‘ড্রামা সার্কেল’-এ ছিলেন যুক্ত। অভিনয়ের পাশাপাশি চাকরি করেছেন আমলা হিসেবে (বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন-এর সচিব)। চাকরি জীবনের ইতি টেনেছেন।
‘মাটির ময়না’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘দীপু নাম্বার টু’ ইত্যাদি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। কিন্তু কখনো অহমিকা দেখিনি তার আচরণে বা কথায়। বরং শিখেছি অনেক কিছু। শটে যাওয়ার আগে রিহার্সাল। ঐ যে ভাষা এবং উচ্চারণগত সমস্যাগুলো তখন ধরিয়ে দিতেন। কাজ এবং জীবনের যে অভিজ্ঞতা তিনি শেয়ার করতেন সেটাও ছিল শিক্ষ্যণীয়। মূলত মাসুদ আলী খান আঙ্কেলসহ একেকজন অগ্রজ, আমাদের কাছে যেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
স্বাধীন বাংলাদেশের এত বছরে আমরা অভিনয়শিল্পীদের পেনশন বা ভাতার ব্যবস্থা করতে পারিনি। অগ্রজরা অভিনয়কে পেশা হিসেবে নিয়ে ভালোবাসা এবং ভালোলাগার নেশা থেকে কেবল কাজই করে গেছেন। প্রতিদান হিসেবে কিছুই আশা করেননি। একসময় নিভৃতচারী জীবন বেছে নিয়েছেন। একজন অভিনয়শিল্পী হিসেবে এটা ভাবলে আমার নিজেরও কষ্ট হয়।
তাহলে উনারা কী কষ্ট পাননি? অবশ্যই কষ্ট পেয়েছেন। হয়তো কোনো না কোনোভাবে যুক্ত থাকতে চেয়েছিলেন। শরীর সায় দেয়নি। ফলে, অবসর নিয়েছেন। কিন্তু পেনশন ব্যবস্থা থাকলে তারা হয়তো খুশি হতেন সংশ্লিষ্টতা আছে ভেবে।
অভিনয় পেশা আমাদের অনেক সম্পর্ক তৈরি করেছে। বাবা, মা, আঙ্কেল, আন্টি, ভাই, বোন, বন্ধু আত্মিক সম্পর্কগুলোর মধ্যে থেকে মাসুদ আলী খান আঙ্কেলও কারও কাছে ‘বাবা’ হয়েছিলেন। এই স্নেহ, মমতার বন্ধন শুধু অভিনয় দিয়ে অর্জন করা যায় না। তা হৃদয়ের গভীর থেকে আসে।
‘মাটির ময়না’, ‘দুই দুয়ারী’, ‘দীপু নাম্বার টু’ ইত্যাদি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। কিন্তু কখনো অহমিকা দেখিনি তার আচরণে বা কথায়। বরং শিখেছি অনেক কিছু।
তাকে যখন ‘মাটির ময়না’ সিনেমার পাকিস্তানপন্থি খান বাহাদুর চরিত্রে দেখেছিলাম খুব অবাক হয়েছিলাম। কোনো অতিরঞ্জিত অভিনয় না করে, কত সাবলীলভাবে উচ্ছ্বসিত হয়ে পাকিস্তানের শাসক ও শাসনের ভূয়সী প্রশংসা করে চলেছেন! এটা দেখে, খান বাহাদুর চরিত্রটির প্রতি রাগ অনুভূত হয়েছিল।
আবার সিনেমাহলে ‘দুই দুয়ারী’ চলচ্চিত্রটি দেখতে গিয়ে পাগল বোনের প্রতি স্নেহ, ভালোবাসা ও মমতা দেখে চোখের জল আটকে রাখতে পারিনি। দর্শক হিসেবে এই যে কান্না-হাসি-ঘৃণা-মায়ার দোলাচল অনুভব করেছিলাম সেদিক থেকে মাসুদ আলী খান অভিনয়শিল্পী হিসেবে সার্থক।
অভিনয় শিল্পী হিসেবে ২০২৩ সালে তাকে ‘একুশে পদক’ দেওয়া হয়। নিঃসন্দেহে তিনি এই সম্মানের দাবিদার। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন- ‘যথেষ্ট পেয়েছি। আমি সন্তুষ্ট। জীবন নিয়ে কোনো খেদ নেই।’ এভাবে বলতে পারে ক’জন!
শিল্প ও শিল্পীদের সাথে ভালোলাগার জীবন যিনি কাটিয়ে গেলেন, পরপারেও নিশ্চয় ভালো থাকবেন তিনি। সেই প্রার্থনা সবসময়।
নাজনীন হাসান চুমকী ।। অভিনেত্রী, নাট্যকার ও পরিচালক