শহীদ কামারুজ্জামানের ফটকেই ঝুলছে রাজাকারের ছবি

প্রকাশিত: জানুয়ারি ৪, ২০২০; সময়: ১০:০০ অপরাহ্ণ |
শহীদ কামারুজ্জামানের ফটকেই ঝুলছে রাজাকারের ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক : মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন (এনএসএফ) রাজশাহীর প্রতিষ্ঠাতা জাফর ইমাম। স্বাধীনতা যুদ্ধে রাজশাহীর বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পেছনে অন্যতম প্রধান ভূমিকা ছিল এই সংগঠন সংশ্লিষ্টদের। স্থানীয় পর্যায়ে ঘৃণিত স্বাধীনতাবিরোধী এই ব্যাক্তিটি মৃত্যুর আগেও যেমন প্রভাবশালী ছিলেন, মৃত্যুর পরও তিনি সমান গুরুত্বপূর্ণ।

তা না হলে এখনো কী ভাবে এমন একজন স্বাধীনতা বিরোধীর ছবি জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান স্টেডিয়ামের প্রধান ফটকের সামনের দেয়ালে শোভা পাচ্ছে। এখানেই শেষ নয়; কুখ্যাত এই রাজাকারের নামে রাজশাহীতে এখনও রয়ে গেছে আন্তর্জাতিক টেনিস কমপ্লেক্স। মুক্তিযোদ্ধাদের শত আপত্তি, বিক্ষোভ, প্রতিবাদ-সমাবেশ সত্ত্বেও রাজশাহীতে এখানো দাপটেই আছে সেই জাফর ইমামের নাম।

রাজশাহীর মুক্তিযোদ্ধারা জানান, জাফর ইমাম বরাবরই খোলস বদল করে চলেছেন। ১৯৬৮ সালের দিকে তিনি রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে ক্রীড়া কর্মকর্তা পদে যোগ দেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকার জন্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তার চাকরি চলে যায়। পরে কিছুদিন আত্মগোপনে থাকেন। পরে ১৯৭৩ সালের দিকে আবারও তিনি চাকরি ফিরে পান। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তাকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। এর তিন বছর পর আওয়ামী লীগ সরকারই তাকে আবার শ্রেষ্ঠ ক্রীড়া সংগঠকের পুরস্কার প্রদান করে।

মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, আইয়ুব-মোনায়েম খানের মুসলিম লীগের সন্ত্রাসী সংগঠন এনএসএফ-এর রাজশাহীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এই জাফর ইমাম। মুক্তিযুদ্ধের আগে তার হামলার শিকার হয়েছেন রাজশাহীর শীর্ষ ছাত্রনেতারা। তার নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে ৬৯’এর গণআন্দোলনে ছাত্র-জনতা জাফর ইমামের রাজশাহীর কাজীহাটার বাড়িতে হামলা চালায়। তখন তিনি পালিয়ে রক্ষা পান। পরে আশ্রয় নেন তার স্ত্রী ডা. জোবায়দার কাদিরগঞ্জের বাড়িতে। সেখানে প্রতি সন্ধ্যায় পাকিস্তানি সেনাদের আড্ডা হতো। মুক্তিকামী বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রনেতাদের তালিকা হানাদারদের হাতে তুলে দিতেন এই জাফর ইমাম। তার তালিকা দেখেই চলতো গণহত্যা। বাবলাবন গণহত্যাও তার পরিকল্পনাতেই হয়েছে বলে মনে করেন মুক্তিযোদ্ধারা।

রাজশাহী জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সাইদুর রহমান বলেন, মোনায়েম খানের ছেলে খসরুর খুবই ঘনিষ্ঠজন ছিলেন জাফর ইমাম। তার হাত ধরেই রাজশাহীতে প্রতিষ্ঠা পায় এনএসএফ। এ সংগঠনটির হাতে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের শীর্ষ নেতারা প্রতিদিনই মার খেতেন। জাফর ইমামের হাতে ছাত্র ইউনিয়নের রুহুল আমিন প্রামাণিক থেকে শুরু করে সেকেন্দার আবু জাফর, ছাত্রলীগ নেতা মাহাবুব জামান ভুলু সবাই মার খেয়েছেন, অপমানিত হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, রাজশাহীতে যেসব বুদ্ধিজীবী, ছাত্রজনতাকে পাকিস্তানি আর্মিরা ধরে নিয়ে হত্যা করেছিল, তাদের অধিকাংশের নামের তালিকা জাফর ইমাম পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিত বলে আমাদের ধারণা।

মুক্তিযোদ্ধা সাইদুর আক্ষেপ করে বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য রাজশাহীতে এত মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবী শহীদ হলেন, তারপরও একজন রাজাকারের ছবি গুরুত্বপূর্ণ একটি স্টেডিয়ামের দেয়ালে শোভা পাচ্ছে। আবার টেনিস কমপ্লেক্সের নামকরণ করা হয়েছে। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা আন্দোলন করলাম, মিছিল সমাবেশ করলাম এই নাম বাতিলের জন্য, তবুও স্বাধীন দেশে এমন ঘৃণিত একজন রাজাকারের নামে আন্তর্জাতিক টেনিস কমপ্লেক্সের নাম রয়ে গেল।

মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আমিন প্রামাণিক বলেন, ‘৬৭ সালে জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি সেকেন্দার আবু জাফরকে মারধর করার খবর পেয়ে রাজশাহী কলেজে যাই। সেখানে যাওয়ার পর এনএসএফ সদস্যরা আমাকে আটক করে ‘পাগলা কুকুর’ পেটানোর মতো পেটায়। স্বাধীনতার সময় জাফর ইমাম পাকিস্তানি আর্মিদের সঙ্গে থেকে স্বাধীন বাংলাদেশী চেতনার বিপক্ষে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নিধন করেছেন। এই স্বাধীনতাবিরোধীর নামে দেশে কোনো স্থাপনা থাকা উচিত নয়।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাসহ রাজশাহীবাসীর দাবি স্বাধীনতা বিরোধী এই জাফর ইমামের ছবি ও নাম শহীদ কামারুজ্জামান স্টেডিয়ামসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন থেকে দ্রুতসময়ের মধ্যে সরিয়ে ফেলা হোক। আর তা এখন সম্ভব না হলে কখনই সম্বভ হবে না।

এ বিষয়ে বিভাগীয় ক্রিড়া সংস্থার সহসভাপতি ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার বলেন, আগামী বিভাগীয় সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে