জবির সমাবর্তনে অধ্যাপক অরুণ কুমার বসাকের বক্তৃতা

প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৯, ২০২০; সময়: ১:৪৪ অপরাহ্ণ |
জবির সমাবর্তনে অধ্যাপক অরুণ কুমার বসাকের বক্তৃতা

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাবি : বিশিষ্ট পদার্থ বিজ্ঞানী ও পদার্থ বিজ্ঞানে বাংলাদেশের একমাত্র অধ্যাপক এমিরেটাস ড. অরুণ কুমার বসাক। তিনি বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে এমিরেটাস অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।

সম্প্রতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) প্রথম সমাবর্তনে ‘সমাবর্তন বক্তা’ হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক অরুণ কুমার বসাক। অসাধারণ বক্তা তিনি। সমাবর্তনে তার বক্তৃতাটি হুবুহু তুলে ধরা হল-

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তনে আমাকে আমন্ত্রণ করার জন্য আমি বিনম্র চিত্তে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

আমি মাস্টারস শেষ করে ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বর মাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগদান করি। আমার প্রয়াত শিক্ষক প্রফেসর আহমদ হোসেন আমার মাস্টারস থিসিস সংশ্লিষ্ট গবেষণা ফলাফল ১৯৬৪ পিকিং আন্তর্জাতিক সিম্পোজিয়ামে পরিবেশন করেছিলেন। কাজটি তৎকালীন সময়ের প্রখ্যাত জাপানি বিজ্ঞানী সৌচি সাকাতা’র উচ্চসিত প্রশংসা অর্জন করে, যা আন্তর্জাতিক সায়েন্স ম্যাগাজিন ‘Science Chronicle’-এ উল্লিখিত হয়েছিল এবং তৎকালীন পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকাগুলিতে শীর্ষ খবর হিসেবে শোভিত হয়েছিল।

গবেষণা কাজটির সহলেখক হওয়া সত্তে¡ও পাকিস্তান সরকার ১৯৬৫ সালে উচ্চশিক্ষার্থে লন্ডন যাওয়ার প্রাক্কালে আমার পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করে। পাকিস্তান আমলে প্রতি বছর স্কলারশিপ পেয়েও বিদেশ যেতে পারি নি। আমার জীবনসূর্যের শুরুলগ্নে প্রতিকূলতা আমার মনকে বিষাদিত করলেও, শিক্ষকতার দায়িত্বে আমি কোন অবহেলা করি নি। বরং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদীয়মান পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে আমি প্রশিক্ষণ এবং গবেষণা উন্নয়নে সারাদিন কাজ করেছি। এই অভিজ্ঞতা আমাকে ভবিষ্যৎ জীবন গড়নে সহায়ক হয়েছে এবং বাংলাদেশের প্রতি মমত্ববোধ বৃদ্ধি করেছে।

১৯৭৬ সালে যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামে থাকাকালীন সময়ে বাংলাদেশের উপর সুপ্ত প্রাণের টান আমাকে স্মরণ করিয়ে দেয় : (১) ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদদের জীবনদান; (২) ৩০ লক্ষ নিরস্ত্র জনগণের রক্ত এবং বীরাঙ্গনা মায়েদের ইজ্জতের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন; (৩) পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর উপর বিভিন্ন প্রকার কারাবাসে নির্যাতন। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা; (৪) বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে আমার প্রথম বিদেশ যেতে পারা। এ সব ভাবনা আমাকে বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ফেলে দেশে প্রত্যাবর্তনে সাহস জুগিয়েছিল। এর প্রেক্ষাপটে সব বিবেচনায় আজ আমার জীবনের অন্তলগ্নে মহামান্য রাষ্ট্রপতির সামনে একজন সামান্য ব্যক্তি হয়েও জরুরিভাবে সামাজিক আত্ম-সমালোচনা করার তাগিদ অনুভব করছি।

বাংলাদেশ বর্তমানে একই সঙ্গে সমস্যা ও সম্ভাবনার দেশ। সমাজ ও রাষ্ট্রের সামগ্রিক কল্যাণ নিহিত থাকে সৃষ্টির ধারাবাহিকতা রক্ষাকারী গর্ভধারিণী মা, জনগণ-নির্দেশক দেশমাতৃকা এবং মানুষের আবেগ ধারণকারী মাতৃভাষার মর্যাদার মাধ্যমে। সমস্যার দেশ এ কারণে যে, আমরা ত্রিরূপী ‘মা’য়ের সম্ভ্রম রক্ষার্থে ব্যর্থ হচ্ছি। এছাড়া দেশে চলছে ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি এবং এর ধারক ও বাহক শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ।

শিক্ষাঙ্গনে আমাদের সংকট, আমরা শিক্ষকবৃন্দ জ্ঞানদান করছি কিন্তু শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞানসৃষ্টি করতে পারছি না। এর কারণসমূহ: (১) শিক্ষার্থীরা অতি দুর্বল প্রশিক্ষণ নিয়ে শিক্ষায়তনে ঢুকছে; (২) আমরা শিক্ষকবৃন্দ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ‘শেখার আনন্দ’ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হচ্ছি; (৩) দীর্ঘকাল যাবৎ ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ অবহেলিত হচ্ছে সর্বস্তরে। এতে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে বিজ্ঞান শিক্ষা পাচ্ছে না।

বাংলাদেশ সম্ভাবনার দেশ তিনটি প্রধান কারণে: (১) এর ভৌগোলিক অবস্থান। দক্ষিণে সমুদ্র থাকাতে আমরা পণ্য-বিপণনে স্বাধীন এবং প্রতিবেশী দেশ আমাদের উপর নির্ভরশীল। (২) সর্বস্তওে আইসিটি’র প্রভাবে বাংলাদেশে আমাদের জীবনযাত্রার মান, গড় আয়ু এবং খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন বেড়েছে। (৩) আমি আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি, যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার প্রয়াত শিক্ষক প্রফেসর উইলিয়াম বারচাম কর্তৃক ১৯৭৬ সালের এক উক্তি, ‘উন্নত দেশের অর্থ সাহায্য তোমাদের দেশকে পঙ্গু করে রেখেছে। তোমরা যদি এই সাহায্য না নিতে তাহলে তোমরা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে।’

আজ আমি গর্ব অনুভব করছি, ‘আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে’। আমাদের আশা সঞ্চারিত হয়েছে!

আমাদের দুর্ভাগ্য যে বাংলাদেশের সম্ভাবনার গতি ব্যাহত হচ্ছে ডিজিটাল পদ্ধতির অপব্যবহারে। বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হয়েছে। পরীক্ষার ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস’এর রেশ এখনও চলছে। এ সবের কারণ ‘নৈতিকতা’ ও ‘মূল্যবোধের’ ঘাটতি। কম পরিশ্রমে লোভকে চরিতার্থ করতে আমরা, শিক্ষকবৃন্দ ও অভিভাবকবৃন্দ, মিথ্যা কথা বলি এবং ছল-চাতুরীর আশ্রয় নেই।

আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের মেধা উন্নত বিশ্বের ছেলে-মেয়েদের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। আমাদের দেশে অশিক্ষিত এবং স্বল্পশিক্ষিত কারিগরদল মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে বিদেশে রপ্তানীযোগ্য উন্নতমানের জাহাজ তৈরি করছে। প্রাইমারি ধাপ থেকেই আমাদের শিক্ষক ও অভিভাবকদের অসংযত জীবনধারা, অপ্রতুল প্রশিক্ষণ পরিবেশ ও দুর্বল শিক্ষক আমাদের ছেলে-মেয়েদেরকে সাধারণভাবে দুর্বল করছে।

আমাদের সন্তানেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে, অনেক পড়াশুনা করেও জ্ঞান অর্জনে ব্যর্থতা বোধ করছে। বিশ্বের বর্তমান অগ্রগতি ক্রমেই দ্রুততর হচ্ছে। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে আমাদের সন্তানদেরকে দিন দিনই বেশি দক্ষতা অর্জন করতে হবে। উন্নত প্রশিক্ষণে দক্ষতা ও নৈতিকতা উভয়ই বৃদ্ধি হয়।

বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে ফলপ্রসূ করতে আমি বিনীত নিবেদন রাখছি। (১) কোয়ালিটি শিক্ষণ-প্রশিক্ষণে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ‘দ্বিমুখী আলোচনা’ উভয় পক্ষের জ্ঞান আহরণে প্রভূত সহায়ক হতে পারে, যা উন্নত দেশে অনুসরণ করা হয়; (২) বর্তমান পরীক্ষা পদ্ধতিতে পরীক্ষার ফলাফল শুধু মুখস্থ শক্তির পরিচায়ক, শিক্ষার্থীর মেধা এবং সৃজনশীলতার নির্দেশক নয়। এই পরীক্ষা পদ্ধতিকে অর্থবহ করতে পরীক্ষার দিনগুলি ষাট দশকের ন্যায় বিরামহীন করতে হবে এস.এস.সি. পরীক্ষার পূর্বেই। এরূপ বিরামহীন পরীক্ষাতে সৃজনশীলতা ও কনসেপ্টের বিকাশ ছাড়া ভাল রেজাল্ট করা সম্ভব নয়। এতে শিক্ষার্থী জ্ঞান আহরণে স্বাবলম্বী হতে বাধ্য হবে এবং শিক্ষককেও পঠন-পাঠনে ব্যস্ত রাখবে। (৩) বর্তমানে যেহেতু পরীক্ষার রেজাল্ট শিক্ষার্থীর মেধা ও জ্ঞানের পরিচায়ক নয়, তাৎক্ষণিক হস্তলিখিত ২০ মিনিটের লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা জরুরী।

দেশের স্থায়ী উন্নতির জন্য বিজ্ঞান চেতনার বিকাশ অপরিহার্য। কবি ও সাহিত্যিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আনন্দ সুধা পরিবেশন করে মানুষের হৃদয়কে হরণ করেন। বিজ্ঞানী যন্ত্রের মাধ্যমে অর্র্জিত ফলাফল দিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণ এবং অন্তর্নিহিত সত্যকে উদ্ঘাটন করেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘গণিতের ছন্দ সমগ্র প্রকৃতির মধ্যে নিহিত আছে’। অন্যদিকে আইস্টাইন বলেছিলেন, ‘সৃষ্টিকর্তার ভাষা বুঝতে তাঁর সৃষ্টির রহস্য উন্মোচন করতে হবে বিজ্ঞানের আলোকে’।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর ‘যুগান্তকারী’ (Ground-breaking) মানের আবিষ্কার দেশের সম্মান ও শক্তি এনে দিতে পারে, যেমনটি ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপান, চীন, ইসরাইল, কোরিয়া এবং ভারতে। তবেই উন্নত দেশ আমাদেরকে গণ্য করবে। তখনই অর্জিত হবে বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলা’।

প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয় তথা প্রতিষ্ঠানের তিনটি পর্যায় থাকে : (১) গড়নের পর্যায়, (২) পর্যবেক্ষণ ও সমালোচনার পর্যায় এবং (৩) স্বীকৃতির পর্যায়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠান ২য় পর্যায়ের আনুষ্ঠানিক সূচনা। আমি আশা রাখছি, ভাল ভাল শিক্ষক সংগ্রহ অব্যাহত রেখে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় অল্প সময়েই বৈশ্বিক স্বীকৃতির পর্যায়ে পৌঁছাতে সক্ষম হবে।

সনদপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদেরকে অভিনন্দন জানাই এবং তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি।

পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে