২৫শে মার্চ রাতে যেভাবে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু

প্রকাশিত: ২৬-০১-২০২০, সময়: ১২:৪৭ |

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ। পাকিস্তানি জেনারেল ইয়াহিয়া খান সেদিন গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। এর দশ দিন আগে তিনি এসেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী শহর ঢাকায়। সেদিন সন্ধ্যা ছ’টা নাগাদ ইয়াহিয়া খানের গাড়ির কনভয় স্টাফ হাউসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। অন্ধকার নামতেই সেই বহর আবার ফেরত গিয়েছিল প্রেসিডেন্ট হাউসের দিকে। কিন্তু সেই বহরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ছিলেন না। গাড়িতে তার জায়গায় বসেছিলেন ব্রিগেডিয়ার রফিক। পাকিস্তানি শাসকরা ভেবেছিল যে সবাইকে বুঝি ধোঁকা দেওয়া গেছে।

কিন্তু সেই সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক তার বই ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ এ লিখেছেন: ‘মুজিবের গোয়েন্দারা গোটা খেলাটা বুঝে গিয়েছিলেন। ইয়াহিয়া খানের নিরাপত্তা টিমে কর্মরত লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ আর চৌধুরী দেখে ফেলেছিলেন যে একটা ডজ গাড়িতে ইয়াহিয়া খানের মালপত্র বিমানবন্দরে পৌঁছেছে। তিনি সেটা শেখ মুজিবের কাছে জানিয়ে দিয়েছিলেন। সন্ধ্যা সাতটার সময়ে ইয়াহিয়া খান যখন বিমানে চড়ার জন্য এয়ারফোর্স গেট দিয়ে ঢুকছেন, তখন নিজের দপ্তরে বসে গোটা দৃশ্যটা দেখছিলেন উইং কমান্ডার এ কে খন্দকার। ফোন করে শেখ মুজিবকে খবরটা জানিয়ে দেন তিনি।’

মি. সালিক আরও লিখছেন, ‘ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল থেকে এক বিদেশী সাংবাদিক আমাকে ফোন করে জানতে চেয়েছিলেন যে ইয়াহিয়া খান ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন, এই খবরটা আমি নিশ্চিত করতে পারি কী না!’

রাত তখন বেশ গভীর। কে জানত যে ওই রাত এতোটা লম্বা হবে। বঙ্গবন্ধু আর ইয়াহিয়া খানের মধ্যে আলোচনার কী পরিণাম হয়, তা নিয়েই ওইদিন দুপুরে মেজর জেনারেল খাদিম হুসেইন নিজের দপ্তরে বসে ভাবছিলেন। হঠাৎই সামনে রাখা টেলিফোনটা বেজে উঠেছিল। লাইনের অন্য দিকে ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান। সরাসরি বলেছিলেন, ‘খাদিম, আজই করতে হবে কাজটা।’

খাদিম এই নির্দেশের জন্যেই অপেক্ষাই করছিল। নিজের কর্মচারীদের সঙ্গে সঙ্গেই ওই আদেশ পালনের কথা জানিয়ে দিয়েছিল সে।

সিদ্দিক সালিক লিখছেন, ‘আমি দেখছিলাম ২৯ ক্যাভালরির রেঞ্জাররা রংপুর থেকে আনানো পুরনো এম-২৪ ট্যাঙ্কগুলো অয়েলিং করছিল। ক্র্যাকডাউনের সময় ঠিক করা হয়েছিল ২৬শে মার্চ রাত একটায়। আশা করা হচ্ছিল যে ততক্ষণে ইয়াহিয়া খান করাচীতে পৌঁছে যাবেন।’

২৫ তারিখ রাত প্রায় সাড়ে এগারোটার সময় ঢাকার স্থানীয় কমান্ডার টিক্কা খানের কাছে অনুমোদন চেয়েছিলেন ক্র্যাকডাউনের সময়টা এগিয়ে আনার। এরকম খবর আসছিল যে ওরা ব্যাপক প্রতিরোধের জন্য তৈরি হচ্ছে।

সিদ্দিক সালিক আরও লিখেছেন, ‘সকলেই ঘড়ির দিকে তাকালাম। রাষ্ট্রপতি তখন সম্ভবত কলম্বো আর করাচীর মাঝামাঝি। জেনারেল টিক্কা আদেশ দিলেন ববিকে বলো যতটা সম্ভব দেরি করতে। রাত সাড়ে এগারোটায় পুরো শহরের ওপরে পাকিস্তানি বাহিনী হামলা করেছিল। অপারেশন সার্চলাইট শুরু হয়েছিল।’

সৈয়দ বদরুল আহসান নিজের বই ‘ফ্রম রেবেল টু ফাউন্ডিং ফাদার’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘শেখ মুজিবের বড় মেয়ে শেখ হাসিনা জানিয়েছিলেন যে গুলির আওয়াজ শুরু হতেই বঙ্গবন্ধু ওয়ারলেসের মাধ্যমে খবর পাঠিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেন।’

রাত প্রায় একটার সময়ে কর্নেল জেড এ খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটা দল ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে পৌঁছে গিয়েছিল। গেটে পৌঁছাতেই সেনাবাহিনীর সদস্যরা ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি চালাতে শুরু করেছিল। বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক স্থানীয় পুলিশ কর্মী সেই গুলিতে মারা যান।

দোতলায় বঙ্গবন্ধু স্ত্রী ও সন্তানদের একটা ঘরে রেখে বাইরে থেকে আটকিয়ে দেন, আর যতটা সম্ভব জোরে চেঁচিয়ে বলে ওঠেন ‘ফায়ারিং বন্ধ কর।’

প্রখ্যাত সাংবাদিক বি জেড খুসরু তার বই ‘মিথস্ এন্ড ফ্যাক্টস বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার’-এ লিখেছেন ‘গুলি বন্ধ হওয়ার পরে কর্নেল খান ঘরের ভেতরে ঢোকেন। নিচে কাউকে পাননি তিনি। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় যান, বঙ্গবন্ধু একটা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন এ সময়। বঙ্গবন্ধুকে তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য বলে কর্নেল। তখন বঙ্গবন্ধু জানতে চেয়েছিলেন পরিবারকে বিদায় জানিয়ে আসতে পারেন কী না। কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিবারের সবার সঙ্গে দেখা করে বেরিয়ে এসেছিলেন তিনি।’

জেড এ খান ‘দা ওয়ে ইট ওয়াজ’ বইতে লিখেছেন, ‘শেখ সাহেবকে গ্রেফতার করার পরে ৫৭ ব্রিগেডের মেজর জাফর ওয়ারলেস মেসেজ পাঠিয়েছিলেন ‘বিগ বার্ড ইন কেজ, স্মল বার্ডস হ্যাভ ফ্লোন’।

সিদ্দিক সালিক লিখছেন, ‘ওই রাতে শেখ মুজিবের সঙ্গে থাকা সব পুরুষ মানুষদের আমরা গ্রেপ্তার করে এনেছিলাম। পরে চাকরবাকরদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। আদমজী স্কুলে সবাইকে ওই রাতে রাখা হয়েছিল। পরের দিন ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তিনদিন পরে করাচী নিয়ে যাওয়া হয়। পরে আমার বন্ধু মেজর বিলালের কাছে জানতে চেয়েছিলাম গ্রেপ্তার করার সময়েই মুজিবকে খতম করে দিলে না কেন? বিলাল বলেছিল জেনারেল টিক্কা খান ব্যক্তিগতভাবে ওকে বলেছিলেন যে কোনও উপায়ে শেখ মুজিবকে জীবিত গ্রেফতার করতে হবে।’

ওই রাতেই এক পাকিস্তানি সেনা ক্যাপ্টেন ওয়ারলেসে মেসেজ পাঠিয়েছিলেন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল আর জগন্নাথ হল থেকে কড়া প্রতিরোধ আসছে।

সিদ্দিক সালিক লিখছেন, ‘এক সিনিয়র স্টাফ অফিসার আমার হাত থেকে ওয়ারলেস সেটটা কেড়ে নিয়ে জানিয়েছিলেন ওদের শেষ করতে তোমার আর কত সময় লাগবে? চার ঘণ্টা! .. যত্তসব.. তোমার কাছে কী অস্ত্র আছে? রকেট লঞ্চার. রিকয়েলস গান. মর্টার.. সব কিছু একসঙ্গে চালাও.. দু’ঘণ্টার মধ্যে পুরো এলাকা দখল করে রিপোর্ট কর।’

চারটের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর পাকিস্তানি সেনারা দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু বাঙালি জাতীয়তাবাদী ভাবনাকে পাকিস্তানি সেনারা দখল করতে পারেনি।

সকালে ভুট্টোকে ঢাকায় তার হোটেল থেকে উঠিয়ে নিয়ে বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বিমানে চড়ার আগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রশংসা করে তিনি বলেছিলেন, ‘ধন্যবাদ, পাকিস্তান বেঁচে গেল।’

পরের দিন সকালে সিদ্দিক সালিক ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু বাসভবনে গিয়েছিলেন তল্লাশি চালাতে। কিছুই পাওয়া যায়নি, সেখানে শুধু রবীন্দ্রনাথের একটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি ছাড়া। ফ্রেমের কাঁচটা বেশ কয়েক জায়গায় ভেঙে গিয়েছিল, কিন্তু ছবিটা একদম ঠিক ছিল।

ওদিকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার পরে বঙ্গবন্ধুকে মিয়াওয়ালী জেলের এক সেলে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। রেডিও তো দূরের কথা খবরের কাগজও দেওয়া হত না তাকে। প্রায় ন’মাস তিনি ওখানে ছিলেন। ৬ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে চলা এক সেনা ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল।

তারপরে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা গিয়েছিল জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে। মিয়াওয়ালী জেল থেকে বার করে বঙ্গবন্ধুকে রাওয়ালপিণ্ডির একটি গেস্ট হাউসে নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭২ সালের ৭ই জানুয়ারি রাতে বঙ্গবন্ধুকে রাওয়ালপিণ্ডির চকলালা বিমানঘাঁটিতে ছাড়তে নিজেই গিয়েছিলেন মি. ভুট্টো।

তিনিও কোনও কথা না বলে বঙ্গবন্ধুকে বিদায় জানিয়েছিলেন। পেছনের দিকে আর না তাকিয়ে সোজা বিমানের সিঁড়ি বেয়ে উঠে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। দু’দিন লন্ডনে কাটিয়ে ৯ই জানুয়ারি তিনি ঢাকার দিকে রওনা হয়েছিলেন। মাঝে কয়েক ঘণ্টার জন্য দিল্লিতে নেমেছিলেন তিনি।

১০ জানুয়ারি যখন বঙ্গবন্ধুর বিমান বাংলার মাটি স্পর্শ করে, তখন লাখ দশেক লোক তাঁকে স্বাগত জানায়।

উপরে