সুদের হার কমলেও ১০ বিপদ
পদ্মাটাইমস ডেস্ক : দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ১ এপ্রিল থেকে ব্যবসায়ীদের সুদের হার কমিয়ে সিঙ্গেল ডিজিট সুদে ঋণ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই সুদহার বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদও আগের চেয়ে প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে। এদিকে আমানতের সুদহার কমে গেলে ব্যাংকের আমানত কমে যাওয়াসহ ১০ ধরনের নতুন বিপদের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এসব আশঙ্কার কথা মাথায় রেখেই ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ছয় শতাংশের বেশি সুদে কোনও ব্যাংক আমানত গ্রহণ করবে না। মেয়াদি স্কিম ছাড়া সব ধরনের আমানতের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য হবে। তবে যেসব আমানতের মেয়াদ শেষ হবে, সেগুলোর মেয়াদ বাড়ানোর ক্ষেত্রেও একই সিদ্ধান্ত অর্থাৎ ছয় শতাংশ সুদ কার্যকর হবে।
জানা গেছে, যে ব্যাংক চলতি মাসে (জানুয়ারিতে) ১২ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করেছে, সেই ব্যাংকও ছয় শতাংশের বেশি সুদে আমানত গ্রহণ করবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসে বেশ কয়েকটি ব্যাংক ১১ থেকে ১৩ শতাংশে সুদে আমানত নিচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে এবিবি’র সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, আমানত কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকলেও এই মুহূর্তে আমানতের সুদ কমানোর কোনও বিকল্প নেই। কারণ, আগামী ১ এপ্রিল থেকে ব্যবসায়ীদের ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিতে হবে। এটি বাস্তবায়ন করতে ব্যাংকগুলোর আগাম প্রস্তুতি হিসেবে ফেব্রুয়ারি থেকে ছয় শতাংশ সুদে আমানত নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
এদিকে আমানতে সুদহার কমে গেলে এতদিন ব্যাংকে এক লাখ টাকা আমানত রেখে যিনি মাসে এক হাজারের মতো টাকা পেয়েছেন, তিনি ফেব্রুয়ারি মাসে এক লাখ টাকা আমানত রাখলে পাবেন ৫০০ টাকার মতো।
এরআগে, একাধিকবার ব্যবসায়ীর জন্য সিঙ্গেল ডিজিট সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে ব্যাংকগুলোকে আগাম প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। সিঙ্গেল ডিজিট সুদে ঋণ বিতরণ বাধ্যতামূলক করতে সরকারের পক্ষ থেকেও নির্দেশনা রয়েছে।
এসব বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ১ এপ্রিল থেকে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিতে হলে এখন থেকেই আমানতের সুদ ৭ শতাংশে আনতে হবে। তবে এই মুহূর্তে আমানতের সুদ কমে গেলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্যাংকের আমানতকারীরা। এর বিরূপ প্রভাব পড়বে পুরো অর্থনীতিতে।
তিনি আরও বলেন, আমানতের সুদহার কমে গেলে ১০টি বিপদ আসতে পারে। প্রথমত, আমানতকারীরা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেবেন। এতে এক. ব্যাংক খাতে টাকার সংকট ভয়াবহ রূপ নেবে। দুই. আমানত কমে গেলে ব্যাংকগুলো উদ্যোক্তাদের ঋণই দিতে পারবে না। তিন. ঋণ দিতে না পারলে সব পরিকল্পনাই ভেস্তে যাবে। বেসরকারি খাত আরও স্থবির হবে। চার. ব্যাংকের আমানতের সুদহার কমে গেলে কিছু টাকা সঞ্চয়পত্রে যাবে। এতে সরকারের ব্যয় বাড়বে। পাঁচ. আমানতের সুদ কমে গেলে অধিকাংশই চলে যাবে বিভিন্ন হায় হায় কোম্পানি তথা ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায়। ছয়. আর ঝুঁকিপূর্ণ কারবারের সঙ্গে যুক্তরা এই টাকা ডলারে রূপান্তর করে হুন্ডিতে বিদেশে পাচার করবে। সাত. এমন পরিস্থিতিতে হুন্ডিতে ডলারের মূল্যও বেড়ে যাবে। আট. ডলারের মূল্য বেড়ে গেলে ব্যাংক ব্যবস্থায় রেমিট্যান্স প্রবাহও কমে আসবে। কারণ, ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠালে প্রবাসীরা পায় ৮৪ টাকা। অথচ হুন্ডিতে পাঠালে পায় ৮৮ টাকা। ২ শতাংশ প্রণোদনা দিয়েও কাজ হবে না। আগামীতে রেমিট্যান্স কমে যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি বলেন, নয় নম্বর বিপদ হলো—খেলাপি ঋণ আদায় না করে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিতে গিয়ে ব্যাংক খাতে অস্থিরতা আরও বাড়বে। এতে পুরো অর্থনীতিতে বড় ধরনের আঘাত আসতে পারে বলেও মনে করেন তিনি। আর দশ নম্বর বিপদ হলো—৯ শতাংশ সুদ বাধ্যতামূলক হলে ব্যাংক এসএমই খাতে হয়তো ঋণ দেওয়াই বন্ধ করে দেবে। এতে এসএমই খাতের উদ্যোক্তারা ঋণ না পেলে এই খাতেও অস্থিরতা দেখা দেবে।
ড. আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন ব্যাংকের এমডিরাও। তারা নাম প্রকাশ না করে বলেছেন, বড় ঋণে ৯ শতাংশ সুদহার কার্যকর সম্ভব হলেও এসএমই ঋণে তা কার্যকর করা কঠিন হবে। ফলে এসএমই খাতে ঋণ প্রবাহ কমে যাবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিতে গিয়ে ব্যাংক খাতে দুটি ক্ষতি হবে। প্রথমত, সীমিত আয়ের সঞ্চয়কারীরা ক্ষতির মুখে পড়বেন। দ্বিতীয়ত, ভোক্তা বা ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ৯ শতাংশ সুদে ঋণ পাবেন না।
এরআগে, মঙ্গলবার রাতে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) এক বৈঠকে ৬ শতাংশ সুদে আমানত নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে আমানতের সর্বোচ্চ সুদহার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার বিষয়ে এমডিরা একমত হন। মেয়াদি আমানতের (এফডি) মেয়াদ তিন মাস থেকে তিন বছর পর্যন্ত হলেও সুদহার হবে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ।
তবে সর্বনিম্ন সুদের বিষয়ে কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। ব্যাংক নিজেদের সামর্থ্য ও সক্ষমতা অনুযায়ী সর্বনিম্ন সুদে আমানত সংগ্রহ করতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত স্প্রেড (ঋণ ও আমানতের সুদহারের ব্যবধান) মানতে হবে।
এদিকে সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণের সুদহার নামাতে সরকারের আমানতের সুদহার নির্দিষ্ট করে সম্প্রতি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। এতে সরকারের নিজস্ব অর্থের ৫০ শতাংশ বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে রাখার বিধান রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সরকারি ব্যাংকের চেয়ে বেসরকারি ব্যাংক যাতে সরকারি আমানত বেশি পায়, তার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অর্থ বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে আমানত হিসেবে রাখলে সর্বোচ্চ সুদ পাবে ৬ শতাংশ। আর এই অর্থ যদি সরকারি ব্যাংকে আমানত হিসেবে রাখে তাহলে সর্বোচ্চ সুদ পাবে সাড়ে ৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, বর্তমানে বেশিরভাগ বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পে ১০ শতাংশের বেশি সুদে ঋণ বিতরণ করছে। কোনও কোনও ব্যাংক ১৬-১৭ শতাংশ সুদেও ঋণ দিচ্ছে। এসএমই ঋণে সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ সুদেও ঋণ বিতরণ করছে কোনও কোনও ব্যাংক।