জীব বৈচিত্র্য যেভাবে পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখে
পদ্মাটাইমস ডেস্ক : প্রশান্ত মহাসাগরের একটি নির্জন অংশে, চুনিপাথরের মনোমুগ্ধকর খাঁড়া খাদ ও ফিরোজা-নীলরঙা পানির ভেতর পালাউয়ের আশ্চর্যজনক সামুদ্রিক হ্রদের দেখা পাবেন আপনি। মহাসমুদ্রের পারে অতিকায় পাথরের ফাটল ও চিড় পেরিয়ে গড়ে ওঠা দারুণ সব দ্বীপ সেখানে। স্নরকেল ও মাস্কে নিজেকে সুরক্ষিত করে, যদি ডুব দেওয়ার শখ জাগে, এক অবিশ্বাস্য রকমের সৌন্দর্য্যের পাবেন দেখা।
পানির উষ্ণ উপরিতলে লাখ লাখ নিরীহ জেলিফিশ সেখানে আপনমনে খেলা করে। সরাসরি রোদ থেকে ওরা শক্তি যোগায়। ওরা এই পৃথিবীর বিস্ময়কর জীবসত্তার এক শ্বাসরুদ্ধকর উদাহরণ।
সমুদ্রের গভীরে দৃশ্যমান জীবসত্তার পাশাপাশি রয়েছে অগুণতি অদৃশ্য ভাইরাস
সামুদ্রিক জীবনের রঙ্গমঞ্চে তিমি, হাঙ্গর ও কচ্ছপের মতো তারকা চরিত্রগুলোর পাশে জেলিফিশ সাধারণত এক ধরনের চলচ্চিত্রের ‘এক্সট্রা’ শিল্পীর ভূমিকা পালন করে!
তবে আরও গভীরে রয়েছে আরেক অভিনেতা, যার দেখা আমরা পাই না, যার কথা বা শব্দ শুনি না, তবু সামষ্টিক সামুদ্রিক জীবসত্তার চেয়েও অনেক বড় ভূমিকায় সে অবতীর্ণ। বলছি মাইক্রবস বা জীবাণুর কথা। এদের সংখ্যা কোটি কোটি।
মহাসমুদ্রে যত প্রাণসত্তা রয়েছে, তার শতকরা নব্বই ভাগই মাইক্রোবিয়াল বা জীবাণু। বড় প্রাণীগুলো, যেমন তিমি ও অন্যান্য সুদর্শন প্রাণীজগত- সেগুলো আসলে সামগ্রিক জীবসমষ্টির হিসেবে সংখ্যায় একেবারেই নগণ্য।
এক কথায় ‘জীবাণু’ নামে পরিচিত ওইসব অদৃশ্য সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রাণসত্তাই এই গ্রহে অর্ধেক অক্সিজেনের যোগান দেয়- যা প্রতি সেকেণ্ডে ফুসফুসে টেনে নিয়ে প্রাণ বাঁচে আমাদের।
চলমান করোনাভাইরাসের দিনগুলোতে, জানলে হয়তো অবাক হবেন, এই পৃথিবীর প্রাণসত্তার একটি বড় অংশই ভাইরাসে গড়া; আর চারপাশে থাকা অগুণতি ভাইরাসের মধ্যে একেবারেই সামান্যসংখ্যক ছাড়া বাকিগুলো একদম নিরীহ; আমাদের কোনো ক্ষতিই করে না। যদি সমুদ্র থেকে স্রেফ এক লিটার পানি তুলে নেন, সেখানে যে পরিমাণ ভাইরাসের বসবাস, তা এই গ্রহের সব মানুষের চেয়েও সংখ্যায় বেশি। আবার, সমগ্র মহাবিশ্বে যত নক্ষত্র রয়েছে, পৃথিবীর মহাসমুদ্রগুলোতে থাকা ভাইরাসের সংখ্যা তারও চেয়ে বেশি।
ভাইরাস এবং পরিবেশে ভাইরাসের ভূমিকা নিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে অগ্রগণ্য বিশেষজ্ঞদের একজন, ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়ার অধ্যাপক কার্টিস সাটলের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। পৃথিবীর ইকোসিস্টেমে ভাইরাসগুলো কী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, সে কথা তিনি আমাকে জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘পানিতে আমরা ভাইরাসের মধ্যেই গোসল করি; আমাদের চারপাশের বাতাস ভরা ভাইরাস। তবে কোন ভাইরাস কোন জিনিসকে সংক্রমিত করে, তা কিন্তু একেবারেই সুনির্দিষ্ট; ফলে আমাদের চারপাশের বেশিরভাগ ভাইরাসই মানুষের জন্য মোটেও ক্ষতিকর নয়। তবে প্রতিদিন তারা মহাসমুদ্রে প্রায় ২০ শতাংশ জীবসত্তার প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।’
‘ভাইরাস জীবসত্তাকে আক্রান্ত করে, তারপর প্রতিলিপি করে এবং অনিবার্যভাবে জীবসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে। মৃত্যু ছাড়া জীবন নেই; আর এ কারণেই ভাইরাসগুলো অনিবার্য; কেননা, মহাসমুদ্রের জীবসত্তাগুলোর জীব বৈচিত্র্যের দায়ভার ওদেরই।’
জীবনের এই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত জালই আমাদের প্রাকৃতিক পৃথিবীকে জ্যান্ত রাখে। তবে বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আমরা ঠিকই জানি, পৃথিবীর জীব বৈচিত্র্য এখন হুমকির মুখে। ২০১৯ সালে প্রকাশিত জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে ১০ লাখেরও বেশি প্রজাতির প্রাণসত্তা।
জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক প্রধানকর্তা ইঙ্গার অ্যান্ডারসন আমাকে বলেছেন, এ একেবারেই শোচনীয় ব্যাপার; কেননা, জীব বৈচিত্র্যই প্রাকৃতিক পৃথিবীর মূল ভিত্তি।
তিনি বলেন, ‘প্রকৃতির শৃঙ্খলা দারুণ; এখানে প্রতিটি প্রজাতিই একটি সামগ্রিক পাজলের মধ্যে নিজ নিজ ভূমিকা পালন করে। এ কারণেই জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণে কার্যকর ভূমিকা রাখার আহ্বান জানাচ্ছি আমরা। আপনি যদি প্রকৃতিকে এ রকম চাপের মধ্যে রাখেন, তাহলে সেটি অক্ষত থাকবে না; আর সেটি আমাদের এক কঠিন বার্তা ঠিকই দেবে।’
‘আমাদের বুঝতে হবে, কোভিড-১৯ তেমনই একটি বার্তা। প্রকৃতির ওপর আমরা এ রকম জুলুম অব্যাহত রেখে ফিরতি হিসেবে সেটির কাছে স্বাভাবিক আচরণ প্রত্যাশা নিশ্চয়ই করতে পারি না।’
সুদীর্ঘকাল ধরেই পৃথিবীতে জীবাণুগুলোর বসবাস; মানুষের অনেক আগেই এগুলোর আবির্ভাব, এবং মানুষ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার সুদীর্ঘকাল পরেও এগুলো টিকে রবে- এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই।
তবে যথেষ্ট স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে, আমার ও আপনার এবং পৃথিবীর বিস্ময়কর জীব বৈচিত্র্যের বাকিদের জন্য পৃথিবীর বুকে হাজারও কোটি বছরের সার্বিক প্রাকৃতিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে আমাদের অবশ্যই এখনই কাজ করতে হবে।
জর্জ ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে উত্তাল যুক্তরাষ্ট্রে প্ল্যাকার্ড হাতে বাংলাদেশি তরুণী ফামি মুমতাহিনা।
মানবজাতি কি শেষ হয়ে যাবে?
প্রাইমাটোলজিস্ট জেন গুডাল আশঙ্কা করছেন, আমরা নিজেদের খাদ্যাভ্যাস পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ঢেলে সাজাতে ব্যর্থ হলে সে কারণে ভবিষ্যতে আবির্ভূত কোনো বৈশ্বিক মহামারি আমাদের বিলুপ্ত করে দিতে পারে।
কালো মানুষের আন্দোলনের সঙ্গে সবুজ সংহতি
‘বর্ণবাদী বিশ্লেষণ বাদ দিয়ে জলবায়ুর ন্যায়বিচার সম্ভব নয়’- যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে চলমান বিক্ষোভে যোগ দিয়ে মঙ্গলবার এমনটাই বলেছেন দেশটির ক্যাম্পেইন গ্রুপ ‘৩৫০’-এর সদস্য ট্যামারা টোলস ও’লাফলিন। ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউট, গ্রিনপিস, অ্যাকশনএইড ও ইউএস ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক-সহ অন্য সংগঠনগুলোও ‘পুনর্ভাবনা ও পরিবর্তনে’র দাবিতে আওয়াজ তুলছেন।
যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য বাণিজ্য
লন্ডন-ওয়াশিংটন বাণিজ্যের আলাপেও নজর রাখা দরকার। ট্রাম্প কার্ডটি যুক্তরাষ্ট্রের হাতে, তবে খাদ্যের মান ও পরিবেশের প্রশ্নে যুক্তরাজ্য রয়েছে রেড লাইনে : কৃষক, আস্থাশীল দল, ডানপন্থী সংবাদপত্রগুলোর একটি অদৃশ্য অথচ শক্তিশালী জোট এবং প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিলের নাতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে খাদ্য আমদানীর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির আওয়াজ তুলছেন। ৯ জুন এ নিয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে।
বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সূর্য ও সামুদ্রিক ঝড়
মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে পূর্ব আফ্রিকায় মারাত্মক বন্যা আঘাত হানে। মে মাসের শেষ দিকে বাংলাদেশ ও ভারতে তীব্র আঘাত হানে সুপার সাইক্লোন আম্পান; ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষকে বিদ্যুৎবিহীন করে দেয়, প্রাণ কেড়ে নেয় শতাধিক মানুষের। মেট অফিসের তথ্যমতে, যুক্তরাজ্যে সূর্যের দাপট বেড়ে গেছে। এক গবেষক বলেছেন, ‘আমাদের সানশাইন স্কেলের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে রোদ।’ যুক্তরাষ্ট্র ও ক্যারিবিয়ান দীপপুঞ্জে হ্যারিকেন বা সামুদ্রিক ঝড়ের মৌসুম শুরু হয়েছে ১ জুন; আবহাওয়াবিদরা সতর্ক করে দিয়েছেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর ঝড়ের আঘাত অনেক বেশি মারাত্মক হতে পারে। উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে বরাবরের মতো মে মাস থেকেই শুরু হয়েছে টাইফুনের আঘাত; চলবে আরও কিছু দিন।
২০১৯ সালে ১ কোটি ১৯ লাখ হেক্টর পরিমাণ গাছ হারিয়েছে গ্রীষ্মমণ্ডল। প্রাথমিক বনাঞ্চলের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ; তার মানে প্রতি ছয় সেকেণ্ডে প্রাথমিক বনাঞ্চল থেকে একটি ফুটবল স্টেডিয়ামের সমপরিমাণ জায়গা বৃক্ষশূন্য হয়ে গেছে। তবে সবচেয়ে বড় জায়গাগুলো হলো : কলম্বিয়া, ঘানা ও আইভরি কোস্টের প্রাথমিক বনাঞ্চলের ঘটেছে উল্লেখযোগ্য বিনাশ। এমন বৃক্ষ-বিনাশের প্রভাব ভবিষ্যতের ওপর কী রকম পড়তে পারে, ‘গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ’-এর তথ্য বিশ্লেষণ করে তা নিয়ে এক লেখায় বিশদ তুলে ধরেছেন বিশেষজ্ঞ মিকায়েলা ওয়েসি ও এলিজাবেথ ডো।
শেষ কথা
জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী নিল ডিগ্রাস টাইসন বলেন, ‘ইন-চার্জ কে, এই প্রশ্ন আপনি তুলতেই পারেন। প্রচুর মানুষ ভাবে, আমরা মানুষ, আমরা প্রাণীজগতের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও সুসম্পন্ন; অতএব, আমরাই ইন-চার্জ। ব্যাকটেরিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি হয়তো একেবারেই ভিন্ন : একজন মানুষের শরীরের ভেতর মাত্র এক সেন্টিমিটার সরলরেখায় যে পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া জীবন কাটায় ও কার্যক্রম চালায়, তার সংখ্যা সৃষ্টির শুরু থেকে পৃথিবীতে এ পর্যন্ত জন্ম নেওয়া মানুষের চেয়েও বেশি। আর এদের কারণেই আপনার খাদ্য হজম ঠিকঠাক হচ্ছে। আমরাই কি ইন-চার্জ? নাকি আমরা স্রেফ ব্যাকটেরিয়ার অতিথি? উত্তর কী- সেটা আপনার দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করছে।’
নিক ক্লার্ক
লেখক: ‘আল জাজিরা ইংলিশ’-এর পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক
‘আল জাজিরা’ থেকে অনুবাদ: রুদ্র আরিফ