বিশ্বের প্রথম গাড়ি চালক, তার হাত ধরেই আজকের মার্সিডিস বেঞ্জ
পদ্মাটাইমস ডেস্ক : বিশ্ব ইতিহাসে নারীর স্থান একেবারেই কম নয়! বরং ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, প্রায় সব জায়গাতেই রয়েছে নারীর বিচরণ। বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্প, প্রশাসন, ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য সবকিছুতেই রয়েছে নারীর সমান অবদান।
জানেন কি? অটোমোবাইল জগতেও রয়েছে নারীর পদচারণা। ভাবতেই নিশ্চয় অবাক হচ্ছেন? হ্যাঁ, একজন নারীই ছিলেন বিশ্বের সর্বপ্রথম গাড়ি চালক ও মেকানিক। এমনকি গাড়ি তৈরিতেও মূল্যবান পরামর্শ দিয়ে অবদান রেখেছেন ইতিহাসে। তার কল্যাণেই আজকে এতো নাম করা গাড়ির ব্র্যান্ড মার্সিডিস বেঞ্জ। আজকের লেখায় থাকছে বিশ্বের প্রথম গাড়ি চালকের আদ্যোপান্ত।
তিনি বার্থা বেঞ্জ। ১৮৪৯ সালে জার্মানির ফোরজেইম শহরে এক ধনাঢ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৭২ সালে কার্ল বেঞ্জের বয়স যখন ২৩ বছর তখন তার বিয়ে হয়। কার্ল পেশায় ছিলেন একজন মেকানিকেল ইঞ্জিনিয়ার। নিজের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করার স্বপ্ন ছিল কার্লের। তবে অর্থাভাবে বারবারই স্বপ্নভঙ্গ হত তার।
বিয়ের আগে থেকেই বার্থা তার হবু স্বামীর নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন। এজন্য আর্থিক সাহায্য করেছেন অনেকবার। বিয়ের সময়ও বার্থার পরিবার থেকে যৌতুক হিসেবে বেশ অনেকগুলো অর্থ দেয়া হয় কার্লকে। তবে সেই ব্যবসায় সফল হতে পারেননি কার্ল। বিয়ের পর কার্ল মেকানিকেল যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান বেঞ্জ এবং কাই প্রতিষ্ঠা করেন। এবারও তাকে অর্থের যোগান দেন স্ত্রী বার্থা।
এই ব্যবসা সফল হওয়ায় কার্ল তার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন, যন্ত্রচালিত গাড়ি তৈরির গবেষণা শুরু করেন। ১৮৮৫ সালে সর্বপ্রথম মোটরচালিত গাড়ি তৈরি করতে সক্ষম হন কার্ল। তিন চাকার এ গাড়িটি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২৫ মাইল বেগে চলত। জার্মান আইন অনুযায়ী সেসময় কোনো বিবাহিত নারী প্রতিষ্ঠানের মালিক হতে পারবেন না।
তাই পরবর্তী বছর কার্ল যখন মোটরগাড়িটির স্বত্ত্ব লাভ করেন তখন তা নিজের নামেই নিবন্ধন করেন। বাস্তবে যে প্রতিষ্ঠানের অধীনে তিনি গাড়িটি নির্মাণ করেন, সেটির পেছনে বার্থার অর্থনৈতিক অবদানই ছিল সবচেয়ে বেশি। তবে কার্লের তৈরি সদ্য মোটরচালিত গাড়িটি মানুষের তেমন একটা নজর কাড়তে পারেনি।
১৮৮৮ সালের এক ভোরে বার্থা তার দুই ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। দিনটি ছিল ৫ আগস্ট। সঙ্গে নেন কার্লের তৈরি করা তিন চাকার মডেল-৩ গাড়িটি। বার্থার ছেলেদের বয়স তখন মাত্র ১৩ ও ১৫। কার্লের জন্য একটি চিঠি লিখে বেরিয়ে পড়েন তিনজনে। কার্ল তখন গভীর ঘুমে অচেতন।
বাবার যাতে ঘুম ভেঙে না যায় এজন্য ছেলেরা ঠেলে গ্যারেজ থেকে বের করে রাস্তায় নিয়ে আসে। বাসা থেকে যথেষ্ট দূরে যাওয়ার পরে বার্থা গাড়িটির এক দশমিক ছয় লিটারের ইঞ্জিনটি চালু করেন। সে সময়ে গাড়ি চলাচলের জন্য রাস্তা খুব একটা উপযোগী ছিল না। পথে নেই কোনো পেট্রোল স্টেশন বা ওয়ার্কশপ। এমনকি এই গাড়ি সঙ্গে দুই সন্তানসহ কতটুকু চলতে পারবেন সেই বিষয়েও নিশ্চিত ছিলেন না।
যাত্রাপথে শুরু হয় নানা বিপত্তি ইঞ্জিন গরম হয়ে যাওয়া, পেট্রোল শেষ হয়ে যাওয়া, ব্রেক শু খয়ে যাওয়া ইত্যাদি। ইঞ্জিন ঠাণ্ডা রাখার জন্য বার্থার ছেলেরা মাঝপথে নেমে পানির সন্ধান করে। পানি এনে ইঞ্জিনে ঢেলে তা ঠাণ্ডা রাখতে হয়েছিল। পেট্রোল শেষ হয়ে গেলে বার্থা ওয়েইজ্লচ শহরের এক ফার্মেসিতে নেমে ১০ লিটার বেনজিন কিনতে চাইলেন।
তখন সেখানকার কেমিস্ট মনে করলেন তিনি বুঝি তার জামার ময়লা পরিষ্কারের জন্য বেনজিন চাচ্ছেন। তিনি বার্থাকে বললেন, এক লিটার বেনজিনই তার জন্য যথেষ্ট হবে। কেমিস্টকে অবাক করে দিয়ে বার্থা ফার্মেসিতে থাকা বেনজিনের সম্পূর্ণ সংগ্রহই কিনে নিলেন। ওয়েইজ্লচ শহরের সেই ফার্মেসিই পরিণত হলো বিশ্বের প্রথম পেট্রোল স্টেশনে!
ইঞ্জিনের যে জায়গা দিয়ে তেল সরবরাহ করে সে জায়গায় ময়লা জমে আটকে গেলে বার্থা তার হ্যাট থেকে একটি পিন খুলে নিয়ে জায়গাটি পরিষ্কার করে নেন। ইঞ্জিনের একটি তার বারবার উত্তপ্ত হয়ে যাচ্ছিল বার্থা তখন তার মোজার রাবার দিয়ে সেটাও ঠিক করে ফেলেন। বলা যায় বার্থা একইসঙ্গে প্রথম গাড়ি মেকানিকও।
গাড়ির ব্রেক-শু যখন ক্ষয় হয়ে আসছিল তখন বার্থা স্থানীয় এক মুচির দোকানে নিয়ে সেটা ঠিক করিয়ে নেন। সেখানে চামড়ার তৈরি বেল্টটিকেও টাইট করে নিতে হয়েছিল। এটিই ছিল বিশ্বের প্রথম গাড়ি মেরামতকারী দোকান। অবশেষে সব বাঁধা অতিক্রম করে বার্থা ও তার দুই ছেলে পৌঁছান গন্তব্যে।
বার্থা টানা ১৫ ঘণ্টা চালিয়েছিলেন গাড়িটি। ঘটনাবহুল দীর্ঘ এ যাত্রায় একইসঙ্গে রচিত হয় বিশ্বের প্রথম গাড়ির বিজ্ঞাপন প্রদর্শন, প্রথম গাড়ি বিকল হওয়া, প্রথম গাড়ি মেরামত করা এবং প্রথম ফিলিং স্টেশনের ব্যবহারের ইতিহাস। একইসঙ্গে এটি ছিল স্বামীর অনুমতি ছাড়া গাড়ি নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাওয়ারও প্রথম ঘটনা! বার্থার এই দুঃসাহসিক অভিযান নিয়ে হলিউডে তৈরি হয় সিনেমা।
আবিষ্কারের পর দু’বছর পেরিয়ে গেলেও কার্ল সেটিকে বাণিজ্যিকভাবে বাজারে উন্মুক্ত করতে পারেননি। বরং তিনি সেটিকে কীভাবে আরো উন্নত করা যায়, তা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। এর মধ্যে অবশ্য তিনি অল্প কিছু প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। তবে সেগুলো ছিল তার ওয়ার্কশপের আঙিনায় স্বল্প দূরত্বে চালানোর প্রদর্শনী।
সেগুলো কাউকে প্রভাবিত করতে পারেনি। তবে বার্থার এই ঘটনার পর বেঞ্জ মিউখীনে গাড়ির একটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন। তার সেই প্রদর্শনী এত বেশি জনপ্রিয় হয় যে বেঞ্জ দম্পত্তি গোল্ড মেডেল অর্জন করেন। বেঞ্জ দম্পত্তি নির্মিত প্রতিষ্ঠান আজকের মার্সিডিস বেঞ্জ। বার্থা বেঞ্জ ও তার সেই দুঃসাহসিক অভিযানের কারণে বাণিজ্যিকভাবে সফল গাড়িটি সবার নজরে আসে।
বেঞ্জ গাড়ির সফলতা শুধু একা কার্ল বেঞ্জের না, বার্থা বেঞ্জেরও সমান অর্জন ছিল। এরপর থেকে বেঞ্জ দম্পতিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তাদের নির্মিত প্রতিষ্ঠানটিকেই আমরা আজ মার্সিডিজ বেঞ্জ হিসেবে চিনি। বার্থা বেঞ্জ, যে দূরদর্শী এবং অসাধারণ উদ্যোগী নারীর দুঃসাহসী অভিযানের কল্যাণে পৃথিবী প্রথম বাণিজ্যিকভাবে নির্মিত উপহার পেয়েছে।
বার্থা একজন সহধর্মিণী হিসেবে স্বামীকে তার স্বপ্ন পূরণে সাহায্য করেছেন, পাশে থেকেছেন আজীবন। বেঞ্জকে তার গাড়ি তৈরির জন্য অনেক ধরনের উপদেশ দিতেন বার্থা। তার মধ্যে একটি উপদেশ ছিল, গাড়ি নিচু গিয়ারে ভালো চলবে। তার উপদেশ মেনে বেঞ্জ গাড়ির ভেতর অনেক ধরনের পরিবর্তন ও উন্নয়ন ঘটান। ১৯৪৪ সালের ৫ মে ৯৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন ইতিহাসের প্রথম নারী গাড়ি চালক বার্থা।