শ্বেতরোগী হয়েও তিনি বিশ্ব সুন্দরী হলেন যেভাবে

প্রকাশিত: ১৯-০৭-২০২০, সময়: ১৩:২৫ |

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : সারাবিশ্বেই রয়েছে সৌন্দর্যের বাড়তি কদর। বিভিন্ন সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বেছে নেয়া হয় বিশ্বের সেরা সুন্দরীকে। এসব প্রতিযোগিতায় অংশ নেন দেশের সেরা সুন্দরীরা।

আসলে সুন্দরের সংজ্ঞা কি? গায়ের রং সাদা মানেই কি সুন্দর? তবে একটু খেয়াল করলেই হয়তো দেখতে পাবেন, বিশ্বের বড় বড় সফল মডেলরা প্রায়ই কৃষ্ণাঙ্গ। তারা গায়ের রং দিয়ে নয় নিজেদের যোগ্যতা দিতেই পেয়েছেন বিখ্যাত হওয়ার তোকমা।

তেমনই একজন মডেলের কথা বলছি। যিনি প্রথমত একজন কৃষ্ণাঙ্গ এবং একজন শ্বেতরোগী। তিনি বিশ্বের সাড়া জাগানো অন্যতম একজন কানাডীয় মডেল উইনি হারলো। তারুণ্যে জনপ্রিয় মডেল হিসেবে পরিচিতি পেলেও অন্য আট-দশটা শিশুর মতো মোটেও স্বাভাবিক ছিল না তার শৈশব।

পুরো শরীরে সাদা দাগ ছোপের কারণে নানাভাবে তাকে হেনস্তা হতে হয়েছে। এই কারণে শৈশবেই তাকে ছাড়তে হয়েছে স্কুল। কারণ স্কুলের অনেকেই তাকে ডাকতো গরু কিংবা জেব্রা বলে। বিড়ম্বনার মাত্রা এতোটাই তীব্র পর্যায়ে পৌঁছায় যে, এক সময় স্কুল ছেড়ে বাড়িতেই পড়াশোনা শুরু করতে হয় তাকে।

উইনি জন্মগতভাবেই একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী। তবে জন্ম থেকেই এই রোগ ছিল না তার। উইনির বয়স যখন মাত্র চার বছর, তখনই তার শরীরে ধরা পড়ে ভিটিলিগো বা শ্বেতীরোগ। এটি এমন একটি চর্মরোগ, যার ফলে ত্বকের রং পরিবর্তিত হয়ে হালকা হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে সাদা রং ধারণ করে। আর এ রোগটিই যখন উইনির শরীরে বাসা বাঁধে তখন তার সমস্ত শরীরে সাদা সাদা ছোপ পড়ে যায়।

উইনির মতে, স্কুল থেকে বের হয়ে যাওয়াটাই তার জন্য সবচেয়ে ইতিবাচক হয়েছে। তিনি জানান এর মধ্য দিয়ে তিনি স্বকীয়তা খুঁজে পান। উইনি বলেন, আমি কে তা অন্য কারো মুখ থেকে শোনার চেয়ে আমি নিজেই উপলব্ধি করতে পারলাম যে আমি আসলে কে? আর এটি সত্যিকার অর্থে আমার জীবনের সব বাধা দূর করেছে।

সত্যিই নানা বাঁধা পেরিয়ে উইনি আজ বিশ্বের সেরা একজন মডেল। তার ছবি ছাপা হয় নামীদামী ব্র্যান্ডের প্রচ্ছদে। ইন্সটাগ্রামে উইনির ফলোয়ারের সংখ্যা এখন ১০ লাখেরও বেশি। স্প্যানিশ ফ্যাশন লেবেল ডেসিগুয়ালের পরিচিত মুখ তিনি। তার ছবি তুলেছেন বিখ্যাত ফ্যাশন ফটোগ্রাফার এবং শো স্টুডিওর পরিচালক নিক নাইট।

উইনি মার্কিন টেলিভিশন চ্যানেল সিএনএনকে এক সাক্ষাৎকারে তার শৈশবের কষ্ট, সংগ্রাম, বিড়ম্বনা আর তা জয়ের গল্প বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, অনেকের কাছে কুৎসিত বলে পরিচিতি পাওয়ার পর থেকে বিশ্বের ফ্যাশনের আলোচনায় আসা পর্যন্ত বন্ধুর পথ পাড়ি দেয়ার গল্প।

তবে উইনি কখনো ভাবেননি যে, তিনি মডেলিংয়ে আসবেন, র‍্যাম্পে হাঁটবেন। সবার এতো পরিচত মুখ হয়ে উঠবেন। নিজের গায়ের রং নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়লেও কখনো নিজেকে দমিয়ে রাখেননি তিনি। চেয়েছিলেন পরিবেশ বিষয়ক সাংবাদিক হতে। সে পথেই হাঁটছিলেন তিনি। সেসময় টরন্টোভিত্তিক ফটোগ্রাফার শ্যানন বুডরামের এক সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন উইনি।

আর তখনই শ্যানন তাকে মডেলিংয়ের প্রস্তাব দেন। প্রথমে রাজি ছিলেন না উইনি। পরে ভাবলেন আচ্ছা দেখাই যাক কী হয়? ব্যাপারটিকে বেশ চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলেন উইনি। সেই সঙ্গে শ্যানন বুডরামের জন্যও এটি বেশ চ্যালেঞ্জের কাজ। তখন থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের উপস্থিতি বাড়াতে শুরু করেন উইনি।

এরপর যখন আমেরিকা’স নেক্সট টপ মডেল (এএনটিএম) পরবর্তী শো-এর জন্য প্রতিযোগী আহ্বান করলো, সেসময় টায়রা ব্যাংকসকে ছবি ট্যাগ করার জন্য ভক্তদের অনলাইনে অনুরোধ জানান উইনি। উদ্দেশ্য ছিল টায়রা যেন তার ছবিগুলো দেখতে পান। টায়রা ছিলেন এই শোয়ের একজন প্রযোজক। উইনির অনুরোধে সাড়া দিয়েছিল তার ভক্তরা। এরপর তার বোনও ফেসবুকে একটি পেজ চালু করে। আর তা দেখে আগ্রহী হয়ে ওঠেন ওই শো-এর এক প্রযোজক।

সেসময়কার অনুভূতির কথা জানাতে গিয়ে উইনি বলেন, শুরুতে আমার বিশ্বাসই হচ্ছিলো না, তবে শেষ পর্যন্ত সিজন ২১-এর শোতে অংশ নিই আমি। মূলত টায়রার কাছ থেকে সুযোগ পাওয়ার পরই আমার নতুন পথচলা শুরু। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি উইনিকে। একের পর এক র‍্যাম্প শো আর ফটোস্যুটে পার হয়েছে বছরের পর বছর।

উইনির লক্ষ্য ছিল তিনি পরবর্তীতে বিনোদন সাংবাদিক হবেন। তবে জনপ্রিয়তা এতটাই বৃদ্ধি পায় যে, তিনি এই কাজের সুযোগই পাননি। উইনি নিজেকে একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন। উইনির আসল নাম কিন্তু উইনি নয়। তার জন্মসূত্রে পাওয়া নাম চ্যান্ডেলে ব্রাউন ইয়ং। তার উইনি নামের পেছনে একটি মজার ঘটনা আছে।

একবার তার ফোনে একজন কল করেন। উইনি তাকে তার পরিচয় দিতে চাইছিল না। সেসময় তার সামনে তার বন্ধু ছিল। সে একটি টি শার্ট পরেছিল। যার গায়ে লেখাছিল উইনি পো। সেটা দেখেই সে তার নাম উইনি বলে। এরপর বন্ধুমহলে তার নাম উইনি হয়ে যায়। এরপরই চ্যান্ডেলে ব্রাউন ইয়ংথেকে তার নাম হয় উইনি হারলো।

পেশাগত জীবন থেকে ব্যক্তি জীবনকে আলাদা রাখতেই তিনি এই নামটি তার সঙ্গে জুড়ে নেন। আর হারলো এসেছে মেরোলিন মোনরো থেকে। উইনি মেরোলিন মোনরোর একজন ভক্ত। এছাড়াও জিন হারলোর ভক্ত তিনি। তাই এদের নামের সঙ্গে মিলিয়ে নিজের নাম রাখেন হারলো। দুটো মিলিয়ে হয় উইনি হারলো।

উইনি খুবই হাস্যোজ্জবল স্বভাবের। যেখানে তার বন্ধু বা কলিগরা ফিটনেস ধরে রাখতে রাতদিন পাড় করছেন ডায়েট করে, সেখানে ওইসবের ধার ধারেন না উইনি। পেট পুরে পছন্দের খাবার খান তিনি। তবে প্রতিদিনের ওয়ার্ক আউট ভুলে যাননা তিনি। যাই খান না কেন তা হতে হবে পুষ্টিকর এবং স্বাস্থ্যসম্মত। খাবারের মধ্যে সবজি, সামুদ্রিক মাছ থাকে সবচেয়ে বেশি।

বেশিরভাগ মানুষই উইনিকে সাহসী উপাধি দিয়ে থাকেন। তবে উইনি হারলো তা মানতে নারাজ। তিনি বলেন, তার যতটুকু করার ছিল তিনি করেছেন। তিনি অন্যদের জন্য রোল মডেল এটিও মানতে পারেন না। তার মতে, অন্যরা তার থেকেও বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন। যে কেউ চাইলেই নিজের ইচ্ছাশক্তি দিয়ে সবকিছু করতে পারে।

আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত, সফল ফটোগ্রাফারের সঙ্গে কাজ করেছেন হারলো। উইনি এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চান। তিনি মৌমাছি আর মৌয়ালদের সুরক্ষায় কাজ তরেন। উইনি ছোটবেলা থেকেই মৌমাছি ভয় পেতেন। তবে এদের প্রকৃতিতে কতোটা প্রয়োজন তা তিনি জানেন, আর এজন্যই তিনি এই উদ্যোগ নেন।

২০১৮ সালে উইনি খলিফা নামের একজন র‍্যাপারের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান। ইনস্টাগ্রামে নিজেদের ছবি দিয়ে সবাইকে জানান এ সম্পর্কের কথা। তবে পরের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালেই এ সম্পর্ক ভেঙে যায়। উইনি হারলো বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম একজন সেরা মডেল। তিনি আমেরিকার অন্যান্য মডেলদের থেকেও বেশি কাজ করেন।

উপরে