রাজশাহী হার্ট ফাউন্ডেশনের কোটি টাকার যন্ত্রপাতি বাক্সবন্দি

প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৭, ২০২০; সময়: ১০:৪৩ পূর্বাহ্ণ |
রাজশাহী হার্ট ফাউন্ডেশনের কোটি টাকার যন্ত্রপাতি বাক্সবন্দি

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজশাহী ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে সরকারি অনুদানে কোটি কোটি টাকা দিয়ে ক্রয় করা যন্ত্রপাতি বছরের পর বছর ধরে বাক্সবন্দি পড়ে আছে। জনবল সংকটসহ নানা খোঁড়া অজুহাতে দীর্ঘ সময় ধরে এসব যন্ত্রপাতি ফেলে রাখা হয়েছে। এতে রোগিরা সেবা নিতে নানা দুর্ভোগে পড়ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া মেয়াদ উত্তীর্ণ বর্তমান কমিটির স্বেচ্ছাচারিতায় প্রকৃত ভাড়ার চেয়ে বেশি টাকায় অস্থায়ী বাড়ি ভাড়া, নির্বাহী কমিটির প্রায় ৭০ শতাংশ সদস্যকে না জানিয়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ, তিন বছরে একটিও সাধারণ সভা বাস্তবায়ন না করাসহ ফাউন্ডেশনের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে- এমন ব্যক্তিদের অবমূল্যায়ন করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

কতিপয় সমাজসেবী ব্যক্তির প্রচেষ্টায় রাজশাহীতে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের একটি শাখা ১৯৮৪ সালে অনুমোদন পায়। এ শাখা এফিলিয়েটেড বডি হিসেবে স্থানীয় জনগণের চিকিৎসা সেবা প্রদানের কাজ শুরু করে। এই সংগঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা নগরের অলকা মোড় এলাকার বাসিন্দা চিকিৎসক প্রয়াত ডা. আব্দুল খালেক। তিনি লক্ষ্মীপুর বাকীরমোড়ের কাছে এক বিঘা জমি হার্টের রোগিদের সু চিকিৎসা ও পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল নির্মাণের জন্য দান করেন। ওই জমির ওপর চারটি ঘর তৈরি করে আউট ডোর চালু করে রোগিদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়।

তিনি বেঁচে থাকা পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠান থেকে রোগিরা কম খরচে চিকিৎসাসেবা পেয়ে আসছিলো। কিন্তু তার মৃত্যুর পরে একটি স্বার্থান্বেষী মহল তা দখল করতে উদ্যোগি হয়। এমনকি সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে সাইনবোর্ড টাঙ্গানো পর্যন্ত হয়েছিলো। বিষয়টি ডা. খালেকের পরিবারের সদস্যদের নজরে আসলে তা পুনুরুদ্ধারের জন্য ঢাকার কেন্দ্রীয় হার্ট ফাউন্ডেশনে লিখিত অভিযোগ করেন। এই হস্তক্ষেপের ফলে আবার সেই পুরাতন নামে সংগঠনটি চলতে থাকে।
২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে প্রয়াত ডা. খালেকের পরিবারের সদস্যদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় একটি নতুন করে নির্বাহী কমিটি করার উদ্যোগ নেয়া হয়। কমিটিতে সরকারিভাবে ২ থেকে ৩ জন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এতে যুক্ত হন।

তারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটা বড় অংকের অর্থ অনুদানের ব্যবস্থা করেন। একই সাথে পাবলিক প্রাইভেট পাটনারশিপ (পিপিপি) এর আওতায় একটা পূর্ণাঙ্গ হার্ট হাসপাতাল নির্মাণের জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি ডিপিপি প্রণয়ন করলে প্রায় পঞ্চাশ কোটি টাকা ব্যয়ে হার্ট হাসপাতাল তৈরি করার অনুমোদন লাভ করে। যেখানে সরকারের ৬০ শতাংশ এবং স্থানীয়ভাবে ৪০ শতাংশ টাকা যোগান দেবার কথা রয়েছে। ২০১৮ সালে এই হাসপাতালের নির্মাণ কাজ শুরু হয় যা ২০২১ সালের জুন মাসে শেষ হবার কথা রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, রাজশাহী ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী কমিটি গঠন হয়েছিল ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে। তিন বছর মেয়াদি এই নির্বাহী কমিটি গঠন করার সময় ডা. খালেকের পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়াও ২৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতে অবদান রাখতে পারে রাজশাহীর এমন অনেককেই সদস্য রাখা হয়নি। ঢাকায় বসবাসকারি মোট আট জনকে সদস্য করা হয়েছে। যাদের অনেকেই নির্বাহী কমিটির সভায় গড় হাজির থেকেছেন। ওই সময় বলা হয়েছিলো, হার্ট হাসপাতাল তৈরি করার জন্য সংস্থার অংশে যে বিশাল পরিমাণ অর্থ সরকারকে প্রদান করতে হবে- সেটা ঢাকার এই সদস্যরা যোগান দিবেন। কিন্তু তিন বছরেও ওই অর্থ যোগাড় করা সম্ভব হয়নি। এমনকি এই তিন বছরে নির্বাহী কমিটি ফাউন্ডেশনের একটিও বার্ষিক সাধারণ সভা করতে পারেনি।

বর্তমান কমিটি ৩ নভেম্বর ২০১৭ দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং গঠন্তন্ত্র অনুযায়ী ২ নভেম্বর ২০২০ এই কমিটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। কিন্তু এখনো নতুন কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এতে সদস্যদের মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। এছাড়াও বাড়ি ভাড়া নেবার ক্ষেত্রে অধিকাংশ সদস্যর সাথে আলাপ বা পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না করাসহ বিধিমতে গণর্পূত বা পিডব্লিউডির মতামত না নেয়ায় নির্বাহী কমিটির সদস্যরাও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নির্বাহী কমিটির একাধিক সদস্য জানান, সর্বশেষ যে সভায় বাড়ি ভাড়া সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় অর্থাৎ ২৮ মে ও ৭ অক্টোবর ২০২০ অনুষ্ঠিত অনলাইন বা ভার্চুয়াল সভা সম্পর্কে কোনো নোটিশ প্রদান করা হয়নি। অথচ প্রায় দ্বিগুন ভাড়ায় একটি বাড়িভাড়া নেয়ার মত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত জনাকয়েক সদস্য মিলে নিয়েছেন। যা স্বেচ্ছাচারিতার বহিঃপ্রকাশ। সূত্র জানাচ্ছে, নবনির্মিত হাসপাতাল ভবনটি আর আট মাসের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ হয়ে যাবে। ফলে সেখানেই সকল কাজ শুরু করা যেতে পারে। কিন্তু দ্বিগুণ ভাড়ায় ২০২৫ সাল পর্যন্ত চুক্তিতে প্রস্তাবিত এই ব্যয়বহুল বাড়ি ভাড়া নেয়া হয়েছে। বাড়িটিতে আগে যে ভাড়াটিয়া থাকতেন তারা মাসে ৭০ হাজার টাকা করে দিতেন বলে জানা গেছে। কিন্তু হাসপাতালটির জন্য বাড়িটির ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে মাসে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা।

একেবারে দ্বিগুন হারে অফিস ভাড়া নেয়ার বিষয়টি নির্বাহী কমিটির অনেককেই বিস্মিত করেছে। এখনও অফিস স্থান্তর হয়নি- যদিও ১ ডিসেম্বর থেকে ভাড়া কার্যকর হয়েছে। বর্তমানে চন্ডিপুরের অফিসের ভাড়া ৫০ হাজার টাকা।
এ বিষয়ে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেন রওশান জানান, হাসপাতালে কোটি টাকার যন্ত্রপাতি বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে আছে এটা সত্য। তবে সেগুলো খুব বেশি সময় ধরে নেই। গত বছরে কেনা একটি এক্সরে মেশিন আছে, আর এ বছরে এক কোটি টাকার কিছু বেশি দামের মেশিন অব্যবহৃত আছে। আসলে আমাদের সেবা কার্যক্রম এখন অস্থায়ী ভাড়া বাড়িতে চলছে। ভাড়া বাড়িতে জায়গার অভাব ও বাড়ির মালিক অনুমতি না দেয়ায় এসব মেশিন স্থাপন করতে পারিনি। তবে এখন নতুন বিল্ডিং ভাড়া নেয়া হয়েছে। সেখানে কিছু মেশিন আমরা চালু করতে পারবো। আর কিছু মেশিন যে বিল্ডিং নির্মাণ করা হচ্ছে সেটা পেলে ওখানে স্থায়ীভাবে বসানো হবে।

তিনি আরো বলেন, বর্তমান কমিটি ৩ নভেম্বর ২০১৭ তে দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং গঠন্তন্ত্র অনুযায়ী ২ নভেম্বর ২০২০ এই কমিটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। তবে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বর্তমান কমিটি ৬ মাস সময় বাড়াতে পারবে। আমরা এই সময়টা বাড়িয়েছি। এই সময়ের মধ্যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। আর যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে নির্বাহী সদস্যদের জানানো হয় না এটাও ঠিক না। মূলত তাদের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। আর নতুন বাড়ি ভাড়া নেয়ার বিষয়ে ফাউন্ডেশনের যুগ্ম সম্পাদক-২ মাকসুদুল করিম স¤্রাটকে আহ্বায়ক করে কমিটি করা হয়েছিলো। এ বিষয়টা তারাই দেখেছে। আর ভাড়া আসলেই বেশি হয়েছে। আমিও বলেছিলাম। কিন্তু তারা বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে ভাড়া নিয়েছেন।

তিনি জানান, নতুন যে বিল্ডিংটি ভাড়া নেয়া হয়েছে সেটা ৫ বছরের জন্য নয়। আমরা যেকোনো সময় নোটিশ দিয়ে এটা ছেড়ে দিতে পারবো। তবে আমরা এখানে ইচ্ছে করলে ৫ বছর পর্যন্ত থাকতে পারবো। আর আমরা তিন বছরে একটিও বার্ষিক সভা করতে পারিনি বিভিন্ন কারণে। তবে বার্ষিক সভা নির্বাচনের আগেই করে ফেলবো। তিনি আরো জানান, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ডা. খালেকের পরিবারের সদস্যদের কমিটিতে রাখার বাধ্যবাধকতা নেই। তবে আমাদের বর্তমান কমিটিতে সহ-সভাপতি পদে তাঁর এক মেয়ে আছেন।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে