পদ্মা সেতুর স্বপ্ন যেভাবে সত্যি হলো
পদ্মাটাইমস ডেস্ক : অবশেষে দুই তীর এক হলো পদ্মার। ৪১ তম স্প্যানটি বসানোর মাধ্যমে বৃহস্পতিবার সকালে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া থেকে শরীয়তপুরের জাজিরা পর্যন্ত ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পদ্মা সেতু পুরোপুরি দৃশ্যমান হল।
রাজধানীর সঙ্গে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের কোটি মানুষের যোগাযোগের জন্য তৈরি করা এই সেতুটি নির্মাণের যাত্রা ছিলো বেশ দীর্ঘ। সময়ের পালাবদলে বাধাও এসেছে বহুবার। তবে সবকিছু পেরিয়ে বৃহস্পতিবার সকালে পদ্মার বুকে শেষ স্প্যান বসানোর মাধ্যমে নতুন সময়ের পথে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ।
১৯৯৯ সালে সর্বপ্রথম পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রাক সম্ভাব্যতা যাচাই করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। ২০০১ সালের ৪ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। তখন থেকেই মূলত স্বপ্ন বুনতে থাকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমের মানুষ।
এরপর আরও গবেষণা এবং বিশ্লেষণ শেষে ২০০৪ সালে জাপানি দাতা সংস্থা জাইকা মাওয়া-জাজিরার শেষ প্রান্তে পদ্মা সেতু নির্মাণের সুপারিশ করে।
বাংলাদেশী কর্মকর্তার সঙ্গে কানাডিয়ান একটি ফার্মের কর্মকর্তাদের দুর্নীতির অভিযোগ উঠায় ২০১২ সালে পদ্মা সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংকের ১.২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ সহায়তা নিয়ে বাংলাদেশ ও সংস্থাটির মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়। বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে নানা চাপের পর বাংলাদেশ ঋণ সহায়তার অনুরোধ ‘না’ করে দেয়।
এরপর নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর মূল সেতু নির্মাণের কাজ উদ্বোধন করেন তিনি।
কাজ কতোদূর এগোল?
পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যানটি বসানো হয়েছিলো ২০১৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। বাকি ৪০ টি স্প্যান বসাতে সময় লেগেছে প্রায় তিন বছর দুই মাস। বন্যার পরিস্থিতি এবং কোভিড মহামারীর কারণে কাজে বিরতি আসে। ফলে গত দুই মাসে ১০টি স্প্যান বসানো হয়। আজ বৃহস্পতিবার (১০ ডিসেম্বর) ৪১ তম স্প্যানটি স্থাপনের ফলে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া থেকে শরীয়তপুরের জাজিরা পর্যন্ত পুরো ৬.১৫ কিলোমিটার ব্রিজটি দৃশ্যমান হল।
২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষ্যে পদ্মা সেতুটি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করার পরিকল্পনা করছে সরকার। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এতে আরও কিছুটা সময় লাগতে পারে।
চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি নামের একটি চীনা ফার্মের সঙ্গে বাংলাদেশ ১২,১৩৩ কোটি টাকার একটি চুক্তি করেছিলো ২০১৪ সালে। সে বছর নভেম্বরের মধ্যে নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ২০১৮’র মধ্যে শেষ হবে বলে চুক্তি হয় তখন। তবে কাজ শুরুর পর মাওয়া অঞ্চলের কিছু অংশ নদীভাঙনের শিকার হয়। ফলে কাজটি শেষ হতে প্রায় এক বছর বেশি সময় নিয়েছে। ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মূল সেতুর ৯১ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
ব্যয়
২০০৮ সালে একনেক কর্তৃক পাস হওয়া পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। ২০১১ সালে সেই ব্যয় বাড়িয়ে হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে দ্বিতীয় পর্বের বাজেট সংশোধনীর পরে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা।
পরে ২০১৭ সালের জুন মাসে প্রকল্পের প্রস্তাবনা সংশোধন না করেই ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। প্রকল্পটি শেষ হওয়ার আগে আরও একটি সংশোধনী প্রয়োজন হতে পারে।
পদ্মা সেতুতে যানবাহন চলাচল শুরু হলে দেশের জিডিপি ১ দশমিক ২৩ শতাংশ হারে বাড়বে। বিশেষত, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম
অঞ্চলের জিডিপি বৃদ্ধি পাবে ২ দশমিক ৩ শতাংশ হারে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা
দক্ষিণের ২১ টি জেলাকে সংযুক্ত করবে এই পদ্মা সেতু। এছাড়াও রাজধানী ও বন্দর নগরী চট্টগ্রামের মধ্য দিয়েই মংলা বন্দর এবং বেনাপোল স্থলবন্দরের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে।
রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের মতে, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত রেলপথ চালু করা হবে। এছাড়াও চলমান কাজ ২০২৪ সালের মধ্যে শেষ করা হলে থেকে ঢাকা যশোরে যাওয়ার রেলপথটি চালু হয়ে যাবে।
কী দিয়ে বানানো পদ্মা সেতু?
ইস্পাত এবং কংক্রিটের মিশ্রণ দিয়ে তৈরি এই সেতু। সেতুর মূল কাঠামো স্প্যানগুলো ইস্পাত দিয়ে এবং খুঁটি ও যানবাহনের পথগুলি কংক্রিটের তৈরি।
দৈর্ঘ্য
পদ্মা নদীর মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। তবে এরই মধ্যে দু’দিকে প্রায় আরও চার কিলোমিটার সেতু নির্মিত হয়েছে। রাস্তা বা রেলপথের জন্য দীর্ঘ সেতু এটি। একে ভাইডাক্ট বলা হয়।
নকশা
এটি দ্বিতল সেতু হবে। স্প্যানগুলোতে তৈরি কংক্রিটের ফলকের ওপর যানবাহন চলবে এবং স্প্যান দিয়ে ট্রেন চলাচল করবে। চার লেনে বিভক্ত ২২ মিটার প্রশস্ত রাস্তা হবে। রেলপথে চলবে মিটার-গেজ এবং ব্রড-গেজ
ট্রেন উভয়ই। উভয় পথ যখন ভায়াডাক্টে পৌঁছাবে, যানবাহন এবং ট্রেনের পথটি মাটির সাথে পৃথকভাবে একত্র করা হবে।
গাড়ি চলাচল ব্যবস্থা
২০০৯ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) একটি বিশদ জরিপ চালিয়েছিল। সেখানে দেখানো হয়েছিলো, দৈনিক প্রায় ২৪ হাজার গাড়ি সেতুটি দিয়ে যাবে যদি ২০২২ সালের শুরুতেই সেতুটি উদ্বোধন করা হয়।
২০৫০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ৬৭ হাজারে পৌঁছাবে।
6