ফটোকপির দোকান দিয়ে চলছে বাস্কেটবল খেলোয়ার প্রতিবন্ধী মায়ার সংসার

প্রকাশিত: ০৫-০২-২০২১, সময়: ১৬:৩১ |

ডি এম কপোত নবী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ : কথায় আছে, মানুষ স্বপ্নের সমান। অনেকেই আবার বলেন, মানুষ স্বপ্নের চেয়েও বড়। বির্তক প্রতিযোগিতায় জয় হবে সম্ভবত পরেরটার। কারণ আমাদের সমাজে হাতেগোনা কিছু অদম্য, হাল না ছাড়া, কঠোর পরিশ্রমী মানুষ রয়েছে, যারা শত প্রতিবন্ধকতা স্বত্বেও প্রমাণ করে প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকলে মানুষ স্বপ্নের চেয়েও বড় হয়।

তেমনি এক প্রতিবন্ধী মেয়ে আমের রাজধানী খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার নয়াদিয়াড়ী-মিস্ত্রীপাড়া গ্রামের মৃত আবু বাক্কারের মেয়ে মোসা. মোয়াজ্জেমা খাতুন মায়া (২৯)।

খুব ছোট্ট অবস্থায় বাবাকে হারিয়েছেন, ৬ মাস বয়সে পোলিও’তে বাম পা হয়েছে কর্মক্ষম, পরিনত বয়স হলে তিন মা ও মোয়াজ্জেমাকে আলাদা করে নিজেদের সংসার করছে। ৩ ভাই ও একমাত্র ছোট বোন হলেও ভাইদের সহযোগিতা না পেয়ে শুধুমাত্র নিজের ইচ্ছাশক্তি দিয়ে মাকে নিয়ে সংসার পরিচালনা করতে দিনভর করে চলছে পরিশ্রম।

মোয়াজ্জেমার স্বপ্ন ছিলো প্রতিবন্ধীদের নিয়ে গঠিত খেলাধূলায় অংশ নেয়ার। সেই স্বপ্ন আজ বাস্তবে রূপান্তর করে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা হুইলচেয়ার বাস্কেটবল দলে গত ২ বছর ধরে খেলছেন মায়া। প্রাণঘাতী করোনার কারনে গত এক বছর খেলা বন্ধ থাকলেও ইতোমধ্যে মায়া ৩টি দলের সাথে খেলেছেন কয়েকটি আন্তর্জাতিক ম্যাচ।

বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে মোকাবেলা করেছেন ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও নেপালের সাথে। পুরস্কার নিয়েছেন জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর হাত থেকে। এমনকি মহিলা হুইলচেয়ার ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রংপুরসহ ঢাকায় কয়েকটি খেলায় অংশ নিয়েছে মায়া। প্রাণঘাতী করোনায় খেলাধূলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়লে গ্রামের বাজারে ফটোকপির দোকান দিয়েই এখন চলছে মা-মেয়ের সংসার।

মোয়াজ্জেমা খাতুন মায়া গোমস্তাপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় হতে ২০১২ সালে মাধ্যমিক পাশ করে। ২০১৪ সালে রহনপুর ইউসুফ আলী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও ২০১৯ সালে সেখান থেকেই ডিগ্রি পাশ করেন মায়া।

এরমধ্যে পড়াশোনার মাঝে মাঝে কয়েকটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়ে রাখেন তিনি। আর সেগুলোই এখন উর্পাজনের অবলম্বন হিসেবে কাজ করছে। গ্রামে মোয়াজ্জেমা নামে পরিচিত হলেও সংগ্রামী এই মেয়েটিকে জাতীয় দলের সকলে ডাকে মায়া নামে।

মায়া বলেন, ছোট বেলা থেকেই আমি খেলাধুলা পছন্দ করি। কিন্তু ছোট থেকেই সকল সহপাঠীরা খেলা করলেও আমি তাদের সাথে খেলতে পারতাম না। টেলিভিশনে খেলা দেখলে ভাবিরা বলত, খেলা দেখে কি হবে? তুমি তো কখনো খেলতেই পারবে না, তোমার দ্বারা তো কিছুই সম্ভব না। তখন আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু ঝরতো। তাদের কথা শুনে মনে মনে ভাবতাম, তোমাদের আমি খেলাধুলা করে দেখিয়ে দিবো যে আমিও পারি। ঠিক তখন থেকেই আমি চেষ্টা করতে থাকি।

তিনি আরো বলেন, এরপর আমার পরিচিত নারী হুইলচেয়ার বাস্কেটবল দলের খেলোয়াড় মিতুর সাথে এনিয়ে কথা বললে, সে বলে কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে জানাবে। বেশ কিছু দিন পরে মিতু বাস্কেটবল টিমের কোচ বুলবুল স্যারের নাম্বারসহ আমাকে এসএমএস দিয়ে বলল, আমাদের টিমে নতুন প্লেয়ার নিবে তুমি স্যারের সাথে যোগাযোগ কর। আমি তোমার সম্পর্কে বুলবুল (কোচ) স্যারকে সব কিছু বললাম। কিছুদিন পরে হঠাৎ একদিন বুলবুল স্যার আমাকে কল দিয়ে বললেন, সামনের ১২ তারিখ আমাদের ক্যাম্প আছে তুমি চলে এসো। এ কথা শুনে আমি খুব খুশি হলাম এই ভেবে যে, হয়তো আশার আলো ধরা দিচ্ছে।

বিষয়টা বাড়ির সবাইকে জানাতেই অনেক বাঁধা বিপত্তি শুরু হলো। কারণ, তারা সেটা পছন্দ করত না। আমি আম্মাকে খেলার বিষয়ে বললে তিনি আমাকে খেলতে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। তাই আমি নির্ধারিত সময়ের একদিন আগে অর্থাৎ ১১ তারিখ সকাল ৮ টায় সাভার সিআরপির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

পরের দিন সকালে আমি আমার ইউনিফর্ম পরে যখন মাঠে যাচ্ছিলাম তখন মনে মনে ভাবছিলাম, আমি কি সত্যিই খেলোয়াড়। এভাবেই কয়েকটা টুর্নামেন্ট খেললাম। একদিন হঠাৎ এ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার সেলিম রহমান স্যার আমাদেরকে জানালেন, ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর মাননীয় স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী, মেয়েদের বাস্কেটবল খেলা দেখতে আসবেন। আমি তো সেই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম। কারণ, আমার এলাকার কোথাও যদি মাননীয় স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী আসেন আমি তো চোখের দেখাটাও দেখতে পাবো না প্রতিবন্ধী বলে। আর সে আমি খেলোয়াড় হয়ে তার হাতে পুরস্কার নিবো, কেন জানি ভাবতেই অবাক লাগছিলো।

মায়া বলেন, ফাইনাল মাননীয় স্পিকার শিরিন শারমিন চৌধুরী যখন আমার হাতে ট্রফি তুলে দিলেন, তখন আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। কেন জানি মনে হচ্ছে আমি কি সত্যিই পেরেছি?

মাননীয় স্পিকারের একটা কথা আমার কানে সব সময়েই বাজে, “তোমাদের খেলা আমি খুব মনযোগ সহকারে দেখেছি আমি যেন চোখের পলক ফেলতে চাইনি। কারণ, চোখের পলক ফেললে আমি যেন কিছু মিস করে ফেলবো”। আমি খুব আনন্দিত হয়েছিলাম, যে আমার প্রথম খেলার প্রথম সম্মানীর টাকায় আমি আমার আম্মাকে শাড়ী উপহার দিতে পেরেছি। আমার আম্মা আমাকে সাপোর্ট না করলে হয়তো আমার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যেত।

করোনার পরে খেলাধূলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে একটি ফটোকপির দোকান দিয়ে চলছে তার সংসার। এমনকি এখন পর্যন্ত কোন আর্থিক সহায়তা পায়নি মায়া ও তার পরিবার। মায়ার মা মেয়ের এই সাফল্যে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, খুব ভালো লাগে, যখন ও ঢাকায় গিয়ে দেশের হয়ে খেলায় অংশ নেয়। আল্লাহ তার মঙ্গল করুন। কথা হয় কয়েকজন প্রতিবেশীর সাথে।

তারা বলেন, ছোট থেকেই মোয়াজ্জেমা খুবই পরিশ্রমী ও মেধাবী মেয়ে। খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলতে চলতে সে আজ দেশের গর্বে পরিনত হয়েছে। সরকার তার এই দুরাবস্থার পাশে দাঁড়ালে সে আরো ভালো করবে। স্থানীয় জেলা প্রশাসন বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন এটাই প্রত্যাশা।

উপরে