‘শূন্য’র জায়গায় ভুলে ‘এক’ লেখায় মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে কারাগারে

প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২১; সময়: ১০:৪৩ পূর্বাহ্ণ |
‘শূন্য’র জায়গায় ভুলে ‘এক’ লেখায় মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে কারাগারে

পদ্মাটাইমস ডেস্ক : সবকিছু ঠিকই ছিল। কেবল ‘শূন্য’র জায়গায় ভুল করে লেখা হয়েছিল ‘এক’। শুধু এই ভুলের কারণে এখন ফাঁসির আসামি হয়ে কনডেমড সেলে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন ঝালকাঠির শেখেরহাটের খায়রুল হাসান ওরফে শেখ হাসান এবং মো. পিল্টন ওরফে পিল্টু সরদার।

২০১৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ঝালকাঠির অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে এই দুজনের। অথচ যে হত্যার ঘটনায় এই মৃত্যুদণ্ড সেই হত্যা মামলারই বাদী ছিলেন শেখ হাসান। পিল্টু সরদার ছিলেন সাক্ষী। তাদের পরিবারের দাবি, বিএনপি শাসনামলে দায়ের হওয়া ওই মামলার আসামিরা সবাই ওই দলের নেতাকর্মী।

তাদের একজনের ভগ্নিপতি ছিলেন সে সময়কার প্রতিমন্ত্রী। ফলে হত্যার অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে খুব একটা সময় লাগেনি। মাঝে থেকে বাদী ও সাক্ষী হয়ে যান আসামি। যার সর্বশেষ পরিণতি মৃত্যুদণ্ডের রায়।

২০০২ সালের ১৭ মে। শেখেরহাট থানার রাজপাশা গ্রামে খুন হন আনোয়ারা বেগম নামে এক মধ্যবয়সী নারী। ওই ঘটনায় হওয়া মামলায় বাদী হন তার আত্মীয় শেখ হাসান। আসামি করা হয় স্থানীয় বিএনপির প্রভাবশালী নেতা নান্টু মেম্বারসহ মোট ৫ জনকে।

মামলার তদন্ত কার্যক্রমও শুরু করে পুলিশ। রাষ্ট্রপতিসহ বিভিন্ন দপ্তরে শেখ হাসানের স্ত্রী নার্গিস খানমের দেওয়া আবেদন অনুযায়ী, ‘নান্টু মেম্বারের ভগ্নিপতি আনোয়ারুল কবির তালুকদার তখন ছিলেন বিএনপি সরকারের প্রতিমন্ত্রী।

অপরদিকে শেখ হাসান ছিলেন শেখেরহাট যুবলীগ নেতা। দল ক্ষমতায় থাকার সুবাদে নিজের আত্মীয়স্বজনকে বাঁচাতে মাঠে নামেন আনোয়ারুল। প্রভাব খাটিয়ে মামলার তদন্তভার নেওয়া হয় সিআইডিতে। এরপর থেকেই পালটে যেতে থাকে সব। শেখ হাসান বাদী হয়ে দায়েরকৃত মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল হয় আদালতে।

পাশাপাশি হত্যা ঘটনার ১৬ মাস পর সিআইডির পরিদর্শক মোজাম্মেল হক বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন শেখ হাসান এবং পিল্টু সরদারসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে।

২০০৩ সালের ১৪ অক্টোবর দায়ের হওয়া দ্বিতীয় ওই মামলায় বাদী-সাক্ষী থেকে আনোয়ারা বেগম হত্যা মামলার আসামি হয়ে যান শেখ হাসান ও পিল্টু। ২০০৪ সালের ২১ নভেম্বর এই দুজনসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির আরেক পরিদর্শক নির্মল চন্দ্র বিশ্বাস।

শেখ হাসানের স্ত্রী নার্গিস বেগম ও পিল্টু সরদারের বাবা জালাল সরদার বলেন, ‘সিআইডির হাতে মামলা যাওয়ার পর আমাদের কথা আর কেউ শোনেনি। বাড়াবাড়ি করলে প্রাণনাশের হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়।

একদিকে আমরা আওয়ামী লীগের সমর্থক, অন্যদিকে বিএনপি ক্ষমতায়। তাছাড়া প্রথম মামলার আসামি নান্টু মেম্বারের ভগ্নিপতি আনোয়ারুল কবির প্রতিমন্ত্রী। সবমিলিয়ে তখন মামলা চালানো তো দূর, এলাকায় টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে পড়ে আমাদের জন্য।’

২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। কিছুটা হলেও আশার আলো দেখতে পায় শেখ হাসান এবং পিল্টু সরদারের পরিবার। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা হিসেবে হাসান এবং পিল্টুর নাম আসামির তালিকা থেকে বাদ দিতে আবেদন করা হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। আবেদনের সপক্ষে স্থানীয় আওয়ামী লীগের সুপারিশের পাশাপাশি নানা তথ্য-উপাত্তও দেওয়া হয়।

আবেদন বিবেচনায় নিয়ে শেখ হাসান ও পিল্টুকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ সংক্রান্ত চিঠি পাঠানো হয় ঝালকাঠির জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে।

২০১০ সালের ১০ নভেম্বর পাঠানো ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করেন আইন শাখা-১ এর সহকারী সচিব মোহাম্মদ আবু সাইদ মোল্লা। কিন্তু জটিলতা বাধে অন্যত্র। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো ওই চিঠিতে মামলার যে নম্বরটি উল্লেখ করা হয় তা ছিল ভুল। মামলা নম্বর ০৮-এর স্থলে ১৮ লিখে পাঠানো হয় চিঠি। ফলে আটকে যায় সব।

চিঠিতে শেখ হাসান ও পিল্টু সরদারের নাম আসামির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে মামলা পরিচালনা প্রশ্নে প্রয়োজনীয় পরামর্শ চাওয়া হয়েছিল ঝালকাঠির পাবলিক প্রসিকিউটরের কাছে।

একই সঙ্গে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে। ২০১১ সালের ৯ জুন ঝালকাঠির তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অশোক কুমার বিশ্বাসের দেওয়া জবাবে উল্লেখিত ১৮নং মামলা স্থানীয় কোনো আদালতে বিচারাধীন নেই মর্মে জানানো হয়।

আসামির তালিকা থেকে দুজনকে বাদ দেওয়া সংক্রান্ত চিঠিতে মামলা নম্বর ভুল হওয়ার বিষয়টি জানতে পেরে তা সংশোধনের জন্য নতুন করে আবেদন করে শেখ হাসান এবং পিল্টু সরদারের পরিবার। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের ৬ এপ্রিল রাষ্ট্রপতির দপ্তর থেকে মামলা নম্বর সংশোধন বিষয়ে চিঠি পাঠানো হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। দ্বিতীয় দফায় শুরু হয় নম্বর সংশোধন কার্যক্রম।

আবারও চলে রাজধানী ঢাকা থেকে জেলা শহর ঝালকাঠিতে চিঠি চালাচালি। ২০১২ সালের ১৬ এপ্রিল ঝালকাঠির পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল মান্নান রসুলের দেওয়া এক চিঠিতে পুরো বিষয়টির বিস্তারিত উল্লেখের পাশাপাশি বলা হয় ১৮ নয়, শেখ হাসান ও পিল্টু সরদারের বিরুদ্ধে যে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে তার নম্বর ০৮।

এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধও করেন তিনি। বছরের পর বছর ধরে এভাবে চিঠি চালাচালির পাশাপাশি চলতে থাকে বিচার কার্যক্রম। রায় প্রদানের সময় ঘনিয়ে এলে জামিন বাতিল করে জেলহাজতে নেওয়া হয় দুজনকে।

তারা জেলাহাজতে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে থেমে যায় মামলা প্রত্যাহার সংক্রান্ত সব তদবির। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর দেওয়া রায়ে হাসান ও পিল্টুকে মৃত্যুদণ্ড দেন বিচারক। বাকি ৫ আসামির ৩ জনকে যাবজ্জীবন ও ২ জনকে খালাস দেওয়া হয়। দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা সবাই বর্তমানে জেলে রয়েছেন।

বর্তমানে বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসির প্রকোষ্ঠে থাকা শেখ হাসানের স্ত্রী নার্গিস বেগম বলেন, ‘পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি জেলে থাকায় ৩ মেয়ে ও ১ ছেলে নিয়ে ভীষণ কষ্টে তাদের দিন চলছে।

ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা তো দূর, ৩ বেলার খাবার জোগাড় করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। তারপরও আমরা আশা ছাড়িনি। রাষ্ট্রপতির কাছে আবারও আবেদন করেছি। মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছি উচ্চ আদালতে।

যে রাতে হত্যার ঘটনা ঘটে সেদিন আমার স্বামী ঘরেই ছিল। সকালে সার্কেল এএসপির সঙ্গে তিনি খুন হওয়ার জায়গায় যান। আমার স্বামী আওয়ামী লীগ করতেন। আসামিরা ছিল বিএনপির। ক্ষমতায়ও ছিল তারা। যে কারণে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে আজ তাকে এই অবস্থায় আনা হয়েছে।’

মৃত্যুদণ্ড পাওয়া অপরজন পিল্টু সরদারের অবস্থা আরও করুণ। এরই মধ্যে তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গেছে। কোনো সন্তান না থাকায় তার হয়ে মামলা পরিচালনার মতো কেউ নেই। ভাইয়েরা খবর নেন না। বৃদ্ধ বাবা-মার পক্ষেও ছোটাছুটি করা সম্ভব নয়। সব মিলিয়ে এই দুটি পরিবার এখন ভাসছে অকূল সাগরে।

  • 273
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে