উদ্বোধনের অপেক্ষায় মুরইল শহীদ স্মৃতিসৌধ

প্রকাশিত: মে ৩১, ২০২১; সময়: ১০:৪৭ অপরাহ্ণ |
উদ্বোধনের অপেক্ষায় মুরইল শহীদ স্মৃতিসৌধ

সরকার দুলাল মাহবুব : পবার পালোপাড়া গ্রামের মহুয়া খাতুন শিমু ও সাব্বির আহমেদ দুজনই মদনহাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তারা একটি বাইসাইকেলে পাশের মোহনপুর উপজেলার গ্রামে শহীদ স্মৃতিসৌধ দেখতে এসেছে। এই নির্মাণটি কি তোমরা জান? এমন প্রশ্ন করলে তারা উত্তর দেয় জানি। সাব্বির বলে যুদ্ধে এখানে অনেককে মেরে ফেলেছে। যারা স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন। তুমি কি করে জানলে? এমন প্রশ্ন করলে সাব্বির বলে এর আগে এখানে এসে আমি জেনেছি। আজকে আমার ক্লাসের শিমুকে দেখাতে নিয়ে এসেছি।

এরইমধ্যে এসে গেলেন স্মৃতিসৌধ দেখভাল করেন মুক্তিযোদ্ধা ইয়াছিন আলীর ছেলে শেখ কামাল। কামালের নিজের চাচা ইদ্রিশ শেখ সেদিন এখানে পাক-বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন। তিনি এসে পুরো স্থাপনাটি দেখানোর জন্য গেট খুলে দিলেন। ওই শিক্ষার্থীদের সাথে আমিও ভিতরে ঢুকলাম। সত্যিই স্মৃতিসৌধটি দৃষ্টিনন্দন হয়েছে।

দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর মোহনপুর ও পবার ১৫ জন শহীদের রক্তে ভেজা স্থানটিতে হয়েছে দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিসৌধ। এতদিন স্মৃতিসৌধ না থাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর হত্যা, নির্যাতন ও লটপাটের দিনটি নীরবেই চলে যেত। এই স্মৃতিসৌধটির দিকে তাকালেই শহীদ স্মরণ ও পাকিস্তানের বর্বরতার কথা মনে করিয়ে দিবে। যার নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। তবে লাগানো হয়নি শহীদদের নামের তালিকা। এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎ সংযোগ হয়নি ও কাঁচা রাস্তা রয়েছে। বিদ্যুৎ সংযোগ ও কাঁচা রাস্তা পাকাকরণের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার মুগরইল গ্রাম। গ্রামটি মোহনপুর ও পবা উপজেলার সীমান্ত এলাকা। পবার মদনহাটি গ্রামের পাকা রাস্তা থেকে স্মৃতিসৌধটির দুরত্ব প্রায় ৪০ মিটার। আর মোহনপুর এলাকার মুগরইল গ্রামের পাকা রাস্তা থেকে যার দুরত্ব প্রায় ৪শ’ মিটার। রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের রহমান কোল্ড স্টোরের সামনে থেকে যার দুরত্ব প্রায় ২ কি.মি আর রাজশাহী-তানোর রাস্তার বাগধানি থেকে যার দুরত্ব প্রায় ১ কিলোমিটার।

জানা গেছে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে পাক-হানাদার বাহিনী মুগরইল গ্রামে তাণ্ডব চালায়। ৩০ নভেম্বর মুগরইল গ্রামে ওই ভয়ঙ্কর ঘটনাটি ঘটে। একসঙ্গে হত্যা করে ১৫ জনকে। দিনব্যাপি চলে লুটপাট। তাণ্ডব চালিয়ে পাক-বাহিনীর সদস্যরা সারা গ্রামে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় বাংলাদেশের যে কয়েকটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটে তার মধ্যে রাজশাহী জেলার মুগরইল গ্রামে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি অন্যতম।

ঘটনার দিন পাক হানাদার বাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে গ্রামবাসীরা এদিকে সেদিকে ছুটে পালায়। অনেকেই আশ্রয় নেয় পাশের জঙ্গলে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। পাক বাহিনী অনেক আগেই জঙ্গলসহ গ্রাম ঘিরে ফেলেছিল। রাজাকারদের সহায়তায় পুরো গ্রামে চলে বাড়ি বাড়ি অভিযান। পাক হানাদেরদের দোসর স্থানীয় রাজাকার দাউদ আলী, নুরে আনোয়ারসহ বেশ কয়েকজন রাজাকারের প্রত্যক্ষ মদদে সেদিন মুগরইল গ্রামের নজরুল শেখ, ইদ্রিস শেখ, হাবিবুর রহমান, রশিদ শেখ, জেকের আলী শেখ, বছির আলী শেখ, মফির উদ্দিন, ফফির উদ্দিন, ইয়ানুচ আলী, নুরুজ্জামান, সেকু সরদার এবং পবা উপজেলার মদনহাটি গ্রামের কুশব আলী মণ্ডল, মেছের আলী মণ্ডল, রিয়াজ আলী সরদার এবং শ্রী বৈদ্যনাথ ঋষিসহ ১৫ জনকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার অপরাধে হাত পা বেধে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল।

শুধু তাই না পাক-বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে মুগরইল গ্রামে চালায় লুটতারাজ। সোনার গহনা ও টাকা পয়সা লুটপাট। গ্রামবাসীদের উপর অত্যাচারসহ আগুন ধরিয়ে ভস্মিভূত করা হয় পুরো গ্রামকে। ধংসযজ্ঞ থামার পরে যারা জীবিত ছিলেন তারা গ্রামে ফিরে আসেন। তখন নিহতদের দাফনের জন্য গ্রামবাসী কাফনের কাপড়ও জোটাতে পেরেছিল না। কাফন ছাড়াই মাটি খনন করে বাসের ছাওনি বিহিন ঢালা মাটি দিয়ে দাফন করা হয় শহীদের মৃত্যদেহ গুলোকে।

শহীদদের স্মৃতিতে ১৮ বছর আগে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছিল। দেখভালের অভাবে এবং নিরাপত্তা প্রাচির না থাকায় অনেকে গরু ছাগল বেধে রাখতো। এছাড়াও এলাকাবাসী ধান, গমসহ কৃষি ফসল শুকাতো।

সংসদ সদস্য আয়েন উদ্দিনের উদ্যোগে আজ আবারও পূর্ণ নির্মাণ করা হয় নতুন আঙ্গিকের এই দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিসৌধ। স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ হওয়ার ১৮ বছর পেরিয়ে গেলেও সেখানে যাওয়া মোহনপুরের রাস্তাটি এখনো পাকা হয়নি। বর্ষার সময় রাস্তাটি চলাচলের জন্য একেবারেই অনুপযোগী হয়ে পড়ে। ফলে শহীদ পরিবারসহ গ্রামবাসীর চলাচলে ভীষণ দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

বিদ্যুৎ ও রাস্তা পাকাকরণ শীঘ্রই হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আয়েন উদ্দিন। তিনি বলেন, পাক হানাদার বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদদের সন্মানে এবং তাঁদের স্মৃতি ধরে রাখতে এই স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করা হয়েছে। পাশাপাশি নতুন প্রজন্ম স্মৃতিসৌধের মাধ্যমে জানতে পারবে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট এবং তাদের মধ্যে দেশপ্রেম সৃষ্টি হবে। এছাড়াও নতুন প্রজন্ম দেশ ও জাতির কল্যাণে সৃজলশীল হবে।

  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
পদ্মাটাইমস ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
topউপরে